You dont have javascript enabled! Please enable it!

১৯৪০ সালের আজাদ পত্রিকা

রাজনৈতিক

লীগের লাহোর অধিবেশন

আগামী ২২শে মার্চ হইতে লাহােরে নিখিল-ভারত মােছলেম লীগের বার্ষিক অধিবেশন আরম্ভ হইবে। এই অধিবেশন তিন দিন পর্যন্ত চলিবে। ভারতীয় সমস্যা এখন যেরূপ জটিলতম অবস্থায় পৌছিয়াছে, সেদিক দিয়া বিবেচনা করিলে লীগের এই লাহাের অধিবেশন মােছলেম ভারতের পক্ষে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ হইবে, তাহাতে সন্দেহ থাকে না। এই তিন দিনে মােছলেম-ভারতের প্রতিনিধিগণ যে ভাবী কর্মপন্থার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন, ভারতের মুছলমানদের রাজনৈতিক ভাগ্য নির্ধারণের উপর অবশ্যম্ভাবীরূপে তার প্রভাব পড়িবে অনেক খানি। কাজেই এই অধিবেশনের গুরুত্ব এককথায় বলিয়া শেষ করা কঠিন।

বৃটীশ গভর্ণমেন্ট ভারতবর্ষকে ডমিনিয়ান স্টেটাস প্রদান করিবেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার অব্যবহিত পরেই, বড়লাটের সাম্প্রতিক বােম্বাই ঘােষণা হইতেই তাহা সুস্পষ্ট হইয়াছে। অনেক পেশাদার ‘এজিটেটর বড়লাটের এই ঘােষণাকে যথােপযুক্তরূপে গুরুত্ব প্রদান করিতে অস্বীকৃত হইয়াছেন, ইহা আমরা দেখিয়াছি। ইহারা পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতিরেকে সন্তুষ্ট হইবেন না, ইহাও আমরা তাদের মুখে শুনিয়াছি। ইহাদের এই লম্বাচৌড়া কথা শুনিয়া সম্মােহিত হইবার কোন হেতু নাই,কারণ ‘পূর্ণ-স্বাধীনতা’ কথাটা যেমন লম্বাচৌড়, তাহা নিজেরা যে তেমন লম্বা-চৌড়া নহেন, এই বােধ পৰ্য্যন্ত ইহাদের নাই। যে পূর্ণ স্বাধীনতার গালভরা কথা তারা বলিতেছেন, তাহা দরখাস্ত করিয়াও পাওয়া যায় না, আপােষ-আলােচনায়ও তাহা মিলে না- এমনকি, চরকা ঘুরাইয়া, খদ্দর বুনিয়া কিম্বা অহিংস সত্যাগ্রহ করিয়া তাহা পাইবার উপায় নাই। তাহা আসিতে পারে মাত্র দেশব্যাপী রাষ্ট্রনৈতিক বিপ্লবের ভিতর দিয়া। চরকা বা সত্যাগ্রহের সাধনা এই। বিপ্লবের সাধনা নহে-ব্যাপক বিপ্লব অন্য পদার্থ। তার সাথে ভারতবাসীর কোনাে পরিচয় নাই- তার সাথে পরিচয় অদূর বা দূরভবিষ্যতে ভারতবাসীর হইবে, এমন সম্ভাবনাও আপাততঃ কল্পনাতীত। কাজেই পূর্ণ স্বাধীনতার বুলি এই এজিটেটরদের ফাকা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই নয়।

তাছাড়া, ডমিনিয়ন ষ্টেটাস একেবারে আনকোরা পূর্ণ স্বাধীনতা না হইতে পারে, কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনের প্রায় সমস্ত অধিকারই তাে উহাতে স্বীকৃত- এমন কি, সম্পর্কচ্ছেদের (Cessation) অধিকার পর্যন্ত। কাজেই ভারতের মত ‘নিধিরাম সর্দারে’র দেশের পক্ষে ডমিনিয়ন-ষ্টেটাস’ গ্রহণে অস্বীকার করা শুধু প্রকাণ্ড ফুল নয়দৃঢ়তার নিদর্শনও বটে। আসল কথা এই যে, ‘পূর্ণ স্বাধীনতা’-কণ্ঠ যে সত্যিকারভাবে ইহা গ্রহণে অস্বীকার করিতে উদ্যত হইয়াছেন, আমরা তা মনে করি না। তাঁদের আপত্তি হইতেছে বড়লাটের এই শর্ত যে বৃটিশ ও কেন্দ্রীয় ভারতের সম্মিলিতভাবে গ্রহণ-বর্জনের উপর ইহার প্রবর্তন নির্ভ করিতেছে। অর্থাৎ বৃটিশ ভারতের সমস্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধতা ও দেশীয় ভারতের সাথে তার মতানৈক্যহীনতা এর এজিটেটরগণ চাহেন, সমস্ত অধিকার তাদের হাতেই দেওয়া হােক, অর্থাৎ ভারতের শাসন কর্তৃত্ব তাদেরই একচেটিয়া হইবে।
ভারতের শাসন-কর্তৃত্ব বর্তমানে যাঁদের হাতে ন্যস্ত আছে, তারা নিজদিগকে একেবারে দেউলিয়া মনে না করিলে, কোনাে দল-বিশেষের এই অন্যায় আব্দার মানিয়া লইতে পারে না। বৃটিশ সরকারও তা মানিয়া নেন নাই। কিন্তু এক দলের এরূপ অন্যায় একগুঁয়েমীর ফলে যদি এই সুযােগ ভারতের আয়ত্তচ্যুত হয়, তবে তার চাইতে দুঃখের বিষয় আর কী হইতে পারে? তাই এই দল তার একগুয়েমী লইয়া অভিশপ্ত হইয়া বসিয়া থাকুক, তার দিকে কাহারাে হৃক্ষেপ করার দরকার নাই। এই দল-বহির্ভূত বিশাল ভারতের বাকী সকলেই যাহাতে দেশের বৃহত্তর মঙ্গলের জন্য এই স্বর্ণ-সুযােগের সদ্ব্যবহার করিতে পারেন, তদ্বিষয়ে সকলকে মনােযােগী হইতে হইবে, প্রস্তুত হইতে হইবে। বস্তুতঃ অ-কংগ্রেসী ভারতের ঐক্যবদ্ধতা এ-সময়ে যেরূপ অপরিহার্য হইয়া উঠিয়াছে, এমন আর কখনাে নহে। কারণ এর উপরেই ভারতের ডমিনিয়ন অধিকার লাভ বর্তমানে নির্ভর করিতেছে। | লাহাের লীগ-অধিবেশনের সম্মুখে অ-কংগ্রেসী ভারতের ঐক্যবদ্ধতার গুরুতর প্রশ্নই সমুপস্থিত। এই ঐক্যবদ্ধতাকে কার্যকরী ও সার্থক করিবার ভার প্রধানতঃ মােছলেম লীগের উপর। নাজাত-দিবসে এই ঐক্যবদ্ধতার প্রাথমিক সূচনা দেখা গিয়াছে। সূচনা যার সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে, পরিণতিও তার সার্থক হইবে, সারা ভারত ইহা আশা করিতেছে। তাই লাহাের লীগের কর্মপন্থা নির্ধারণের দিকে সারা ভারতের উৎসুক দৃষ্টি আজ নিপতিত হইয়াছে। লাহােরের নির্ধারণ সকলের এই উৎসুক দৃষ্টিকে হাস্য-প্রফুল্প করিয়া তুলুক-ভারতীয় ঐক্য-সম্ভাবনাকে সাফল্যের আলােকে আলােকিত করুক, ইহাই আমাদের পরম কামনা।

লাহাের অধিবেশনের গুরুত্ব ইহা হইতেই সুস্পষ্ট হইবে। ইহা ছাড়া এর গুরুত্বের আরাে অনেক বিষয় আছে, আপাততঃ তার উল্লেখ নিপ্রয়ােজন। শুধু এই গুরুত্বের উল্লেখই এই অধিবেশনের অসামান্যতা প্রমাণের পক্ষে যথেষ্ট। এমন অধিবেশনের নেতৃত্ব-ভার যে ভারতের যােগ্যতম রাষ্ট্রধুরন্ধরের হাতে থাকা উচিত, তাহা বােধহয় কেহই অস্বীকার করিতে পারিবেন না। বিহার ও সীমান্ত প্রদেশের মােছলেম লীগ ইতিমধ্যেই লাহাের অধিবেশনের নেতৃত্বের জন্য মিঃ জিন্নার নাম করিয়াছেন দেখিয়া আমরা মােটেই বিস্মিত হই নাই। মিঃ জিন্না পূর্ববর্তী তিন বৎসর লীগ-অধিবেশনে নেতৃত্ব করিয়াছেন; আবার তাঁহাকেই এবারও নেতা মনােনয়ন করা হইতেছে দেখিয়া কেহ কেহ বিস্মিত হইতে পারেন বটে; কিন্তু যারা এই অধিবেশনের গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক চিন্তা করিয়াছেন, তাঁরাই ইহাতে বিস্মিত হইবার কিছুই পাইবেন না। বস্তুতঃ মিঃ জিয়ার ন্যায় সৰ্ব্বতােমুখী রাজনৈতিক প্রতিভা বর্তমানে ভারতবর্ষে আর নাই। তার ন্যায় কুশাগ্রবুদ্ধি রাজনীতিক নেতা ভারতের আর জন্মিয়াছে কিনা, সন্দেহ। কাজেই আলােচ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লীগ-অধিবেশনের নেতৃত্বের জন্য তার নাম প্রস্তাবিত হইবে, ইহাই স্বাভাবিক। আমাদের মতে, বিহার ও সীমান্ত প্রদেশের ন্যায় ভারতের অন্যান্য প্রদেশও এই প্রস্তাবই সর্বসম্মতিক্রমে করিবেন। ইহা পরীক্ষিত সত্য যে, মিঃ জিন্নার হাতে নেতৃত্বভার দিয়া এখনাে পর্যন্ত মােছলেম ভারতের পস্তাইবার কোনাে কারণ উপস্থিত হয় নাই। আমাদের বিশ্বাস, সমগ্র অ-কংগ্রেসী ভারত ও তার নেতৃত্বে লাভবানই হইবে।

এই গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে শুধু যােগ্যতম নেতা নির্বাচনই বড় কথা নহে। ইহাতে বিভিন্ন প্রদেশের লীগ-নেতৃবৃন্দের দলে দলে যােগদানও ইহার সাফল্যের জন্য অপরিহার্য। আমরা আশাকরি, লাহাের অধিবেশন লীগ-নেতৃসমাগমের দিক দিয়া ইতিহাস সৃষ্টি করিবে। কিন্তু সত্যের অনুরােধে আমরা বলিতে বাধ্য, বাঙ্গলার লীগ সংগঠন নানা কারণে খুব সাফল্যমণ্ডিত হইতে পারে নাই। বাঙ্গলার অধিবাসী লীগ-মনা নিশ্চয়ই, কিন্তু প্রতিষ্ঠানিক সবলতা বাঙ্গলার লীগ অর্জন করিতে পারে নাই। এদুর্বলতা দূরীকরণে বাঙ্গলার লীগ-কর্মীবৃন্দকে অবিলম্বে সবিশেষ অবহিত হইতে হইবে। ঘরের কোণে বসিয়া হায়, আফছােছ’ না করিয়া তাহাদিগকে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে বাহির হইয়া আসিতে হইবে। দরকার হইলে বাঙ্গলার লীগ-কর্ণধারগণকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূরীকরণে বাধ্য করিতে হইবে। বাঙ্গলার অবিসম্বাদী লীগ-নেতা মাননীয় এ, কে, ফজলুল হক ছাহেব সেদিন মাদারীপুরে বাংলার জনগণকে কষুকণ্ঠে আহ্বান জানাইয়াছেন অবিলম্বে লীগ-পতাকাতলে সমবেত হইতে। আমরা জানি, বাঙ্গলার জনগণ এ-আহ্বানে সাড়া দিতে প্রস্তুত হইয়াই আছে। তারা যে লীগ-মনা, একথা আগেই বলিয়াছি কিন্তু এই মন লইয়া শুধু ঘরে বসিয়া থাকিলে চলিবে না- এবার বাহিরে আসিতে হইবে, লীগ পতাকা বহন করিয়া সদর্পে সম্মুখে আগাইয়া চলিতে হইবে। প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূরীকরণের জন্য প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের মুখের দিকে হা। করিয়া চাহিয়া থাকিবার দিন চলিয়া গিয়াছে। এ-দুর্বলতা দূর করিতে তাহাদিগকেই অগ্রসর হইতে হইবে। তারা যদি সত্যিকারভাবে অগ্রসর হইয়া আসিতে পারেন, তবে প্রতিষ্ঠানিক দুর্বলতা একদিনেই দূর হইয়া যাইতে পারে।

১৬ জানুয়ারি ১৯৪০, ২ মার্চ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

লীগের প্রচার-কাৰ্য্য

বর্তমান যুগ প্রচার ও সংগঠনের যুগ বলিয়াই অভিহিত হয়। প্রচার ও সংগঠনই অধুনা শক্তি। এই শক্তিকে অস্বীকার করা প্রকৃতপক্ষে আত্মহত্যারই নামান্তর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হইলেও অস্বীকার করার উপায় নাই যে, নানা কারণে গত অসহযােগ আন্দোলনের পর হইতে ভারতীয় মুছলমান যেন প্রচার ও সংগঠনের প্রয়ােজনীয়তাই ভুলিয়া গিয়াছিলেন। এমনকি, স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দের “শুদ্ধি” ও পণ্ডিত মদনমােহনের “সংগঠন আন্দোলনের (১৯২৪) কশাঘাতেও তাঁহারা এই প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেন নাই। অবশ্য, “তনজীম” “তনজীম” বলিয়া চীৎকার মুছলমানরা একেবারে করে নাই বলিলে তাহা ভুল হইবে । কিন্তু তাহা ছিল সাময়িক উত্তেজনা এবং উত্তেজনা-প্রসূত উল্লাস। এ-কথা সপ্রমাণ করার জন্য যুক্তির অবতারণা অনাবশ্যক। “তনজীম” আন্দোলনের পরিণতিই ইহার প্রমাণ। সাময়িক উচ্ছ্বাসের বুদ্বুদের অবসানে সঙ্গে সঙ্গে “তনজীম” আন্দোলনের অবসান ঘটে।

অধিক সাইমন-কমিশনের (১৯২৭) আগমনের সাথে সাথে ভারতীয় মুছলমানরা অধিকতর বিচ্ছিন্ন হইয়া পরস্পর সম্রামে লিপ্ত হয়। বৃটিশভক্তদের “অল মােছলেমকনফারেন্স” ও কংগ্রেসভক্তদের “মােছলেম ন্যাশনালিস্ট পার্টি এবং তাহাদের সংঘাতসংঘর্ষের মৰ্ম্মদ ইতিহাস নূতন করিয়া আলােচনা করার কোন প্রয়ােজন নাই। যে গৃহবিচ্ছেদের ফলে মােছলেম-ভারতের যে সব অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হইয়াছে, তাহাও স্মরণ করাইয়া দেওয়ার দরকার করে না। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে মুছলমানদের প্রতি যেসব অকথ্য অত্যাচার গত কয়েক বৎসরের মধ্যে অনুষ্ঠিত হইয়াছে, তাহা প্রকৃতপক্ষে আমাদের সে গৃহবিবাদেরই স্বাভাবিক পরিণতি।

তবে প্রাদেশিক শাসন-সংস্কার প্রবর্তনের তথা প্রাদেশিক আইন-সভাসমূহের গত নির্বাচনের পূর্ব হইতে আমীরে মিল্লাত মােহাম্মদ আলী জিন্না ও খাদেমে শওকত আলী মুছলমানদিগকে সংহতির উদাত্ত আহ্বান জানাইয়া আসিয়াছেন। তাহাদের সে আহ্বান ব্যর্থ হয় নাই। ভারতীয় মুছলমান মর্মে মর্মে সংহতির আবশ্যকতা বুঝিয়াছে। এবং মােছলেম-লীগের পতাকাতলে সমবেত হইয়াছে। যাহারা মােছলেম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয় নাই, তাহারা আজ সমাজচ্যুত, সমাজে আর তাহাদের স্থান নাই। বস্তুতঃ ১৯৩৬ সালের তুলনায় মুছলমান সমাজ আজ অধিকতর সংহত, সেবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।।

কিন্তু এই সংহতিকে সুদৃঢ় করিয়া অভীষ্ট সিদ্ধির জন্য যে প্রচারকার্যের আবশ্যকতা, তাহা যেন আমাদের সমাজ-আজও যথাযথভাবে উপলব্ধি করিয়া উঠিতে পারে নাই। প্রমাণ, আজ পর্যন্ত ভারতের বাহিরে মােছলেম-লীগের একটি প্রতিনিধি দল প্রেরণ করা সম্ভব হইয়া ওঠে নাই, বিদেশে মােছলেম-ভারতের আশা-আকাক্ষার বিষয় প্রচারের উপযােগী একখানি ইংরেজী দৈনিক কাগজ বাহির হয় নাই, একটি “মােছলেম-নিউজ-এজেন্সী” বা “সংবাদ সগ্রহ ও প্রচার-সংঘ” প্রতিষ্ঠিত হয় নাই।

সুখের বিষয়, বােম্বাই-মুছলমানদের দৃষ্টি সম্প্রতি এদিকে আকৃষ্ট হইয়াছে। বােম্বাই-মােছলেম লীগ “প্রেস ও প্রােপাগান্ডা-ফন্ড” নামে একটি তহবিল গঠন করিয়াছেন। ইতিমধ্যে মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে ইহার প্রতিনিধিরা প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করিয়াছেন। কি বৃটিশ, কি দেশীয় রাজ্য, যেখানেই প্রতিনিধিদল পৌছিয়াছেন, সেখানেই তাঁহারা রাজকীয় সম্বর্ধনা লাভ করিয়াছেন। সম্বর্ধনাই ইহার প্রধান কথা নয়, সম্বৰ্ধনার সহিত কার্যকরী সহানুভূতিও মুছলমানরা প্রদর্শন করিয়াছেন। | কাথিওয়াড় ছফর শেষ করিয়া আহমদাবাদ যাত্রার প্রাক্কালে প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ জিন্না এ-সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। গত ২৭শে জানুয়ারী। ইহা হইতে জানা গিয়াছে যে, “প্রেস ও প্রােপাগান্ডা-তহবিলে” সে-পৰ্য্যন্ত ১,৫০,০০০ দেড় লক্ষ টাকা চাঁদা সংগৃহীত হইয়াছে। সংবাদপত্রের প্রয়ােজনীয়তা বােম্বাইয়ের মুছলমানরা বুঝিতে পারিয়াছেন, সংগৃহীত অর্থ তাহারই প্রমাণ। আশা করি, অন্যান্য প্রদেশের মুছলমানরাও এই প্রয়ােজন যথাযথভাবে অনুভব করিবেন। উপযুক্ত প্রচারকাৰ্য ব্যতীত অভীষ্ট সিদ্ধি সম্ভব নয়, ভারতীয় মুছলমানকে আজ তাহা উত্তমরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে হইবে।

৩০ জানুয়ারি ১৯৪০, ১৬ মাঘ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

গুরুতর পরিস্থিতি

“ষ্টার অব ইন্ডিয়া”র নয়াদিল্লীস্থিত সংবাদদাতা প্রেরিত ভারতীয় সরকারী মহলের নূতন জল্পনা-কল্পনার যে আভাস গতকাল্যকার ‘আজাদে’ প্রকাশিত হইয়াছে, তাহা নিশ্চয়ই প্রতি চিন্তাশীল ব্যক্তির বিশেষ করিয়া, মুছলমানের দৃষ্টি আকৃষ্ট করিয়াছে। উহাতে দেখা যায়, মােছলেম লীগকে একরূপ বাদ দিয়াই গবর্ণমেন্ট কংগ্রেসের সাথে আপােষ করার মতলব আঁটিতেছেন। ক্রমশঃ গবর্ণমেন্ট ও কংগ্রেসের মধ্যে আসন্ন চুক্তিতে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান বা মাইনরিটীকে সন্তুষ্ট করার কোনাে চেষ্টাই স্থান পাইবেনা।

আরাে প্রকাশঃ এই চুক্তির ফলে কংগ্রেসের তরফ হইতে গান্ধীজী বহু-বিঘঘাষিত স্বাধীনতার দাবী পরিত্যাগ করিয়া (১) ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসন স্বীকার করিয়া লইবেন এবং গণ-পরিষদের দাবী “চিরকালের মতাে” ছাড়িয়া দিবেন। যুদ্ধের পরে যখন ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসন ভারতে প্রবর্তিত হইবে, সেই সময়ে “সকল সংখ্যালঘু দলের প্রতিনিধিগণ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্ত শাসনের প্রাথমিক কাৰ্য্যস্বরূপ রক্ষাকবচাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করিবেন।” (২) তবে মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ যুদ্ধের সময়ে, কংগ্রেসী মন্ত্রীগণ আবার কাৰ্যভার গ্রহণ করিয়া প্রাদেশিক শাসন চালু করিবেন। কিন্তু এবার প্রাদেশিক কংগ্রেসী মন্ত্রীসভাকে দুইজন করিয়া বিরােধীদলে (মােছলেম লীগের?) প্রতিনিধিকে দফতরহীন মন্ত্রী হিসাবে গ্রহণ করিতে হইবে। (৩) কেন্দ্রে বড়লাটের মন্ত্রীসভাকে প্রসারিত করার জন্য জনপ্রিয় প্রতিনিধিগণ গৃহীত হইবেন ঃ

“স্টার অব ইন্ডিয়ার সংবাদদাতার উপরােক্ত সংবাদ যদি সত্য হয়, তবে স্বীকার করিতেই হইবে, মােছলেম-লীগের দাবী উপেক্ষা করিতেই কর্তৃপক্ষ বদ্ধপরিকর হইয়াছেন। প্রথমতঃ ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসন ভারতে প্রবর্তনে হয়ত মােছলেম-লীগের আপত্তির কারণ নাই। কিন্তু ইহার প্রকৃতি সম্বন্ধে মােছলেম-লীগের তরফ হইতে গুরুতর প্রশ্ন আছে। ফেডারেশনের ভিত্তিতে ইহার প্রবর্তনে মােছলেম লীগের গুরুতর আপত্তি। মােছলেম-লীগ পুনঃ পুনঃ ঘােষণা করিয়াছে প্রস্তাবিত ফেডারেশন-পরিকল্পনা মােছলেম-লীগ গ্রহণ করিতে পারে না- ভারতীয় মুছলমান কখননা গ্রহণ করিবে না। কারণ ইহার ফলে কেন্দ্রে ম্যাজরিটী শাসন প্রবর্তিত হইবে; আর ভারতে ম্যাজরিটী শাসনের প্রতিষ্ঠা মানেই হইতেছে “হিন্দুরাজের প্রতিষ্ঠা। ভারতীয় মুছলমান প্রাণ থাকিতে ইহা গ্রহণ করিতে পারে না। কাজেই ভাবী কেন্দ্রীয় শাসনতন্ত্রে হয় মুছলমানকে সম্পূর্ণ পৃথক জাতি হিসাবে পূর্ণ শাসনতান্ত্রিক রক্ষাকবচ দিতে হইবে, কিংবা ভারতে দুইটি বা ততােধিক স্বতন্ত্র ফেডারেশন স্থাপন করিতে হইবে। ষ্টারের সংবাদে দেখা যায়, কর্তৃপক্ষ মােছলেম লীগের এই সঙ্গত আপত্তি গ্রাহ্য করিতে স্বীকৃত নহেন। শুধু এইটুকু করিতে তারা রাজী যে, “যুদ্ধের পর সকল সংখ্যালঘু দলগুলির প্রতিনিধিরা ঔপনিবেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক কাৰ্য্যস্বরূপ রক্ষাকবচাদি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত করিবেন।” মােছলেম-লীগ ইহার উপর মােটেই গুরুত্ব আরােপ করিতে পারে । কারণ মােছলেম লীগের দাবী মাইনরিটী হিসাবে নহে- স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে।

দ্বিতীয়তঃ মধ্যবর্তী সময়ে অর্থাৎ যুদ্ধের সময়ে আবার কংগ্রেসী মন্ত্রীরা আসিয়া প্রাদেশিক শাসনতন্ত্রে বার দিবেন। ইহাও মােছলেম-লীগ মানিয়া লইতে পারে না । কারণ সারা ভারতে নাজাত-দিবসের অনুষ্ঠান করিয়া মুছলমানগণ এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিয়াছেন যে, অত্যাচারী মােছলেম বিদ্বেষী কংগ্রেসী মন্ত্রীত্ব তাঁরা আর বরদাশত করিবেন না- তৎপরিবর্তে তারা কামনা করিয়াছেন প্রদেশে প্রদেশে অনুমান গবর্ণমেন্ট, কোনাে একদলের গবর্ণমেন্ট নহে। বিরােধীদলের দুইজন প্রতিনিধিকে দফতরহীন মন্ত্রী হিসাবে কংগ্রেসী মন্ত্রীসভা গ্রহণ করিবেন, মােছলেম লীগ ইহাতেই সন্তুষ্ট হইতে পারে না।

কারণ যাদের আমলে মুছলমানদের উপর অমানুষিক অবিচার-অত্যাচার চলিয়াছিল এবং যাদের বিরুদ্ধে সে সব অভিযােগের পূর্ণ তদন্তের জন্য রয়েল-কমিশন মুছলমানরা দাবী করিয়াছিল, তাহাদিগকেই আবার প্রাদেশিক কর্তৃত্ব দেওয়া হইবে। মুছলমানদের তদন্তের দাবী উপেক্ষা করিয়া মুছলমানরা আত্মসম্মান বজায় রাখিয়া কোন অবস্থাতেই ইহা স্বীকার করিয়া লইতে পারে না। দফতরহীন মন্ত্রীত্ব-খয়রাতকে তারা অপমান বলিয়াই মনে করিবে।।

তৃতীয়তঃ কেন্দ্রে বড়লাটের মন্ত্রীসভাকে প্রসারিত করার জন্য “জনপ্রিয় প্রতিনিধি গ্রহণ প্রস্তাবকেও মুছলমানরা মানিয়া লইতে পারে না; কারণ প্রাদেশিক শাসনের গদীতে কংগ্রেসী মন্ত্রীত্বের পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর কেন্দ্রের কথা মুছলমান ভাবিতেই পারে না।

ভারতীয় মুছলমানদের মনােভাব কায়েদে আজম মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্নার বিবৃতিতেই সুস্পষ্টভাবে প্রকাশিত হইয়াছে। মুছলমান ও মাইনরিটী দলগুলির উদ্দেশে উচ্চারিত প্রতিশ্রুতি ভুলিয়া যদি বৃটিশ সরকার সত্যসত্যই কংগ্রেসের সাথে আপােষ করিয়া ফেলেন, তবে ভারতে ভীষণ শাসন-সঙ্কট দেখা দিবে, মােছলেম লীগ নব শাসনতন্ত্রকে বাধা দিতে কোনাে চেষ্টাই বাকী রাখিবে না- মিঃ জিন্নার এই সাবধানবাণী যারা লঘু চিত্ততাবশে উড়াইয়া দিতে সাহসী হইবেন, তাঁরা সত্যই কৃপার পাত্র। ভারতের মুছলমানদের বর্তমান মনােভাব সম্বন্ধে তাদের কোন ধারণাই নাই । মিঃ জিন্না আরও বলিয়াছেন : “ব্রিটিশ গবর্ণমেন্টের আওতায় মুছলমানদের অনুমােদন ও সম্মতি ছাড়া তাহাদের উপর কোন চুক্তি জোর করিয়া চাপাইয়া দেওয়া চলিতে পারে, লন্ডন টাইমস’ যদি এরূপ ধারণা করিয়া থাকেন, তবে উহার বিষম ভ্রান্তি হইয়াছে। মুছলমানরা তাহাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার আর কাহারও হাতে দিতে প্রস্তুত নহে, তাহাদের পক্ষে কোনটা ভাল বা মন্দ, তাহা স্থির করিবার চূড়ান্ত ক্ষমতা তাহাদের নিজেদের হাতে রহিয়াছে। যাহারা ভারতের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনা করিবেন, তাঁহাদিগকে মুছলমানদের দায়িত্বশীলতা মানিয়া লইয়া তাহাদের সহিত সসম্মানআচরণ করিতে হইবে।”

বস্তুতঃ ইহা ভারতীয় মুছলমানদের রাজনৈতিক জীবন-মরণের প্রশ্ন-আত্মসম্মানের প্রশ্ন। মুছলমান এ-প্রশ্নে অনবহিত হইতে পারে না। যে অবস্থায় নয় কোটি একটা বিরাট জাতির উপর তাদের বিনা সম্মতিতে জোর করিয়া যে-কোনাে শাসনতন্ত্র চাপাইয়া দেওয়া চলে, ভারতীয় মুছলমানদের সে-অবস্থা এখন আর নাই। ভারতেই একদিন বৃটেন তার ইচ্ছামত আমলাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিল বটে, কিন্তু সেদিন গত হইয়াছে। কংগ্রেসী হিন্দুদের সহিত আপােষের প্রয়ােজন যদি এখন বৃটেনের হইয়া থাকে, তবে ভারতীয় মুছলমানদের সহিতও সে প্রয়ােজন তার কম নয়। সে প্রয়ােজন তাদের যুদ্ধরত অস্থির মস্তিষ্কে এখন অনুভূত না হইতে পারে, কিন্তু সেদিন বেশী দূরে নয়, যে দিন বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়া তাদিগকে ইহা বুঝিতে হইবে। কংগ্রেসের অসম্মতিতে এদেশের কোনাে শাসনতন্ত্রের প্রবর্তন তাদের অসম্ভব মনে হইতে পারে, কিন্তু নয় কোটীর মুছলমানের প্রতিনিধি মােছলেম-লীগের অসম্মতিতেও তাহা যে সম্ভব নহে একথা বুঝিতে না পারা তাদের তীক্ষ্ণ বাস্তব-বুদ্ধির পরিচায়ক নহে।

বর্তমান ভারতীয় রাজনৈতিক হাওয়া কোন দিকে বহিতেছে, আমাদের উপরােক্ত আলােচনায়ই পাঠকগণ তাহা বুঝিতে পারিবেন। ভারতীয় মুছলমানদের যে আর বসিয়া কালহরণের সময় নাই, অবিলম্বে মােছলেম লীগের অধিনায়কতায় তাহাদিগকে যে কর্মক্ষেত্রে ঝাঁপাইয়া পড়িতে হইবে, তার আর ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইবার দরকার করে না।
ভারতময় মুছলমানদের মধ্যে ইতিমধ্যে বিরাট চাঞ্চল্য পড়িয়া গিয়াছে। ৩রা ফেব্রুয়ারী লীগ ওয়ার্কিং কমিটীর ও মার্চ মাসে লাহাের লীগ-অধিবেশনের গুরুত্ব ইতিমধ্যেই মােছলেম ভারতে সম্যক অনুভূত হইয়াছে। মােছলেম-ভারতকে কোন কর্মপন্থা গ্রহণে অতঃপর অগ্রসর হইতে হইবে, তার কতকটা আভাস ওয়ার্কিং কমিটীর নির্দেশের ভিতর দিয়াই হয়ত পাওয়া যাইবে। লাহাের লীগ-অধিবেশনে সে পন্থা। সুস্পষ্টভাবেই নির্দেশিত হইবে, আশা করা যায়। কাজেই ভারতের মুছলমানদিগকে এখন হইতেই সে-নির্দেশ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত হইতে হইবে। বাঙ্গলার মুছলমান লীগমনা হইলেও এখনাে সম্যকরূপে সম্মবদ্ধ নয়। অতঃপর তাহাদিগকে সত্যবদ্ধ হইতে তৎপর হইতে হইবে। বাঙ্গলা যে ভারতের কোনাে প্রদেশ হইতে পেছনে নয়, অন্ততঃ এই আত্মসম্মান ও জীবন-মরণের ব্যাপারে পিছনে থাকিবে না, তাহা তাহাকে সবদ্ধতা ও কর্মতৎপরতার দ্বারা প্রমাণ করিতে হইবে। কাজেই লীগ-পতাকাতলে দলেদলে সবদ্ধ হইয়া অবিলম্বে দাঁড়াইতে আমরা বাঙ্গলার মুছলমান আকুল আবেদন জানাই।

৩১ জানুয়ারি ১৯৪০, ১৭ মাঘ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১, পৃষ্ঠা-৪

কায়েমী স্বার্থের আর্তনাদ

বাংলা সরকারের বিরুদ্ধে হিন্দু-মহাসভা ও হিন্দু সংবাদপত্রগুলির পক্ষ হইতে যে সমস্ত অভিযােগ ও প্রচারকার্য চলিতেছে, তাহার প্রতিবাদ করিয়া বাংলা সরকার একটি বিবৃতি প্রচার করিয়াছেন। বিবৃতিটির প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হইয়াছে। এই খণ্ডে গবর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে আনীত ১৭টি সুনির্দিষ্ট অভিযােগের মধ্যে ১৪টি অভিযােগের বিস্তৃত ও দফাওয়ারী আলােচনা করা হইয়াছে।

অনেক প্রাদেশিক গবর্ণমেন্ট পক্ষ হইতে তাহাদের বিরুদ্ধে আরােপিত অভিযােগের প্রতিবাদ হইতে দেখা যায় । কিন্তু বাংলা গবর্ণমেন্ট কর্তৃক প্রচারিত আলােচ্য বিবৃতির সাথে সেগুলির কোন দিক হইতেই তুলনা চলে না। এ ধরনের অভিযােগের প্রত্যুত্তরে আর কোন প্রাদেশিক গবর্ণমেন্ট এরূপ বিস্তারিত ও তথ্যসমন্বিত বিচ্যুতি পূর্বে কখনও প্রচার করেন নাই। কংগ্রেসী গবর্ণমেন্টগুলির তরফ হইতে তাহাদের বিরুদ্ধে আরােপিত অভিযােগের উত্তরেও কয়েকটি ভাসা ভাসা বিবৃতি প্রচারিত হইয়াছিল। কিন্তু বাংলা সরকার যেমন আন্তরিকতার সহিত অকাট্য যুক্তি, প্রমাণ ও উপযুক্ত তথ্য সম্পদের দ্বারা প্রতি পক্ষের অভিযােগ ছিন্ন ভিন্ন করিয়াছেন, কংগ্রেসী সরকারের বিবৃতিগুলিতে তেমন কোন প্রচেষ্টা দেখা যায় নাই। বাংলা সরকার প্রত্যেকটি অভিযোেগ গুরুত্ব সহকারে আলােচনা করিয়াছেন। বিবৃতিটির উল্লেখযােগ্য কতিপয় বিষয়ের পরিচয় দেওয়া হইল।

কলিকাতা মিউনিসিপ্যাল সংশােধন আইন “হিন্দু ও জাতীয়তাবাদ বিরােধী” বলিয়া যে অভিযােগ করা হইয়াছে, তদুত্তরে আলােচ্য বিবৃতিতে বলা হইয়াছে যে, কর্পোরেশনে হিন্দু প্রতিনিধির সংখ্যা শতকরা ৫৮.৪ হইতে ৫৫.৪ করা হইয়াছে। মুছলমান প্রতিনিধির সংখ্যা শতকরা ২৪.৬ হইতে ২৫.৮ বৃদ্ধি করা হইয়াছে মাত্র। সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, ইহাতে হিন্দু প্রতিনিধিত্বের সংখ্যালঘুত্ব ঘটিবার কোন কারণ উপস্থিত হয় নাই। তদুপরি নূতন আইনে নির্বাচিত প্রতিনিধির সংখ্যা যেমন একদিক হইতে বৃদ্ধি করা হইয়াছে, তেমনি অন্যদিকে মনােনীত সদস্য সংখ্যা হ্রাস করা হইয়াছে। | সরকারী চাকুরীতে মুছলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করা হইয়াছে বলিয়া যে অভিযােগ করা হইয়াছে, তাহার উত্তরে বলা হইয়াছে যে, বাংলা গবর্ণমেন্ট সাম্প্রদায়িক চাকুরীর সংখ্যানুপাত সংরক্ষণের ব্যাপারে আইন-সভার গৃহীত প্রস্তাব অনুসারেই কাৰ্য্য করিয়া আসিতেছেন। উত্তরে আরও বলা হইয়াছে যে, বাংলার গবর্ণরের নিকট প্রেরিত হিন্দু-প্রতিনিধির দলও উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমসংখ্যক চাকুরীর দাবী উত্থাপন করিয়াছিলেন। বিবৃতির অপর একটি তালিকা হইতে জানা যায় যে, বাংলার ২৭টি জেলার মধ্যে ২৪টিতে হিন্দু কর্মচারীদের সংখ্যা অধিক।

১৯০৯ সনের ৩১শে মার্চ পৰ্য্যন্ত যে দুই বৎসর শেষ হইয়াছে, এই সময়ের মধ্যে ৫০ জন হিন্দু ও ২১ জন মুছলমানের পদোন্নতি হইয়াছে।…
এতদ্ব্যতীত টেকনিক্যাল ও শিল্প বিদ্যালয়ে সরকারী সাহায্য- আবগারী লাইসেন্স প্রদান প্রভৃতি ক্ষেত্রেও হিন্দুরা যে অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় অধিক অর্থ সুবিধা পাইয়া আসিতেছে, তাহাও এ বিবৃতিতে দেখানাে হইয়াছে। | সে সম্পর্কে বলা হইয়াছে যে, বাংলা দেশে হিন্দু-কৃষ্টির প্রতি অবিচার করা দূরে থাকুক, পক্ষান্তরে এরূপ অভিযােগ শােনা যাইতেছে যে, বাংলার মােছলেম কৃষ্টি আজ হিন্দু সংস্কৃতির চাপে বিনষ্ট হইতে চলিয়াছে, যাহা হােক গবর্ণমেন্ট এ সম্বন্ধে কোন সুনির্দিষ্ট অভিযোেগ পান নাই। সুতরাং এ সম্বন্ধে তাহাদের কোনরূপ স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভবপর নয়।

হিন্দু মহাসভা কর্তৃক আনীত “হিন্দুমন্দির অপবিত্রকরণ”, “হিন্দু সংবাদপত্র ও সভা সমিতিতে বাধাদান” ও “হিন্দুনারী নির্যাতন” এই তিনটি অভিযােগ সম্বন্ধে সাংবাদাদি এখনও সংগৃহীত হয় নাই বলিয়া এই বিবৃতিতে সেগুলি সম্পর্কে কোন কিছু বলা সম্ভব হয় নাই। এ-সম্পর্কে গৱৰ্ণমেন্ট পরে তাঁহাদের বক্তব্য প্রকাশ করিবেন বলিয়া জানা গিয়াছে।

বাংলা সরকারের এই বিবৃতির ফলে হিন্দু মহাসভাপন্থীদের মধ্যে কিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে, তাহা আমাদের পক্ষে বলা কঠিন। হয়ত তাহারা গ্রাম্য স্কুল মাস্টারটির মত (যদিও পরাজিত তবুও তর্ক ছাড়িব না নীতির অনুসরণ করিবেন, হয়ত তাহারা এসব কথা প্রতিক্রিয়াশীল হক মন্ত্রীমণ্ডলের ছাফাই বলিয়া এক তুড়িতে উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিবেন। কিন্তু আমরা দৃঢ়তার সাথে এখানে একথা বলিতে পারি যে, দেশের প্রত্যেক হিতকামী নিরপেক্ষ হিন্দু বাংলা গবর্ণমেন্টের এই বিবৃতি পাঠ করিয়া হিন্দু মহাসভার অভিযােগের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করিতে পারিবেন। এই বিবৃতিতে তথাকথিত প্রত্যেকটি অভিযোেগ দৃঢ়তার সাথে আলােচিত হইয়াছে। প্রত্যেকটি বিষয় নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া বিচার করা হইয়াছে।

বাংলা সরকারের এই বিবৃতি পাঠ করিতে একটী কথা স্বতঃই সুস্পষ্ট হইয়া উঠে যে, বাংলা সরকারের বিরুদ্ধে যদি কোন সম্প্রদায় বিশেষের অভিযােগ থাকে, তবে সে অভিযােগ বাংলা হিন্দু বা ইউরােপীয় সম্প্রদায়ের নয়, সে অভিযােগ বাংলার মুছলমানই আনয়ন করিতে পারে। কারণ, এই বিবৃতিতে দেখা যায় যে, চাকুরী-বাকুরীতে শিক্ষা ও সাহায্যের ব্যয় বরাদ্দের খাতে যাহারা এখনও সিংহের ভাগ পাইয়া আসিতেছে, তাহারা বাংলার বর্ণ হিন্দু। বাঙ্গালী মুছলমানের এখনও বহু দাবী-দাওয়া পূরণ করা হয় নাই। এখনও বাঙ্গালী মুছলমানের অভাব-অভিযােগের অন্ত নাই। এখানে তাই স্বাভাবিকভাবে একটা প্রশ্ন আসে, তবে হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু সংবাদপত্রগুলির হিন্দুর স্বার্থ, অধিকার ও কৃষ্টি বিপন্ন বলিয়া এরূপ চীৎকার করিবার কারণ কি? একটু ধীরভাবে চিন্তা করিলেই এ চীৎকারের আসল অর্থ বুঝিয়া উঠিতে কষ্ট হয় না। বাংলার প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবর্তনের পর হইতে বাংলার জনসাধারণ বিশেষ করিয়া বাংলার মুছলমান ও তপসিলী হিন্দুদের হস্তে কিছুটা রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আসিয়া পড়িয়াছে। তাহারা তাহাদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়া পাওয়ার জন্য আজ আন্দোলন আরম্ভ করিয়াছে। জনমতের চাপে বাধ্য হইয়া বাংলা গবর্ণমেন্ট তাহাদের অভাব অভিযােগ পূরণের দিকে বর্তমানে মনােনিবেশ করিতে আংশিকভাবে বাধ্য হইতেছেন। তাই বহু দিনের কায়েমী স্বার্থে আজ আঘাত পড়িয়াছে। হিন্দু মহাসভা ও হিন্দু সংবাদপত্রগুলির চীকারে আতঙ্কগ্রস্ত কায়েমী স্বার্থের আর্তনাদই প্রতিধ্বনিত হইয়া উঠিতেছে। বাঙ্গালী হিন্দুর ধর্ম ও কৃষ্টিনাশের মিথ্যা অজুহাত তুলিয়া বাংলার কায়েমী স্বার্থ তাহাদের ধৃত-ক্ষমতার হস্তমুষ্টি আরও সৃদৃঢ় করিবার চেষ্টা করিতেছেন মাত্র। এ ব্যাপারে আরও একটি কথা ভাবিয়া দেখার প্রয়ােজন রহিয়াছে। বাংলা গবর্ণমেন্টের সুদীর্ঘ আড়াই বৎসরাধিক শাসনকালের মধ্যে এরূপ অভিযােগ পূর্বে কখনও ক্ষত হয় নাই। হঠাৎ গত ডিসেম্বর মাসের হিন্দু মহাসম্মেলনের সময় হইতে বাংলা গবর্নমেন্টের বিরুদ্ধে হঠাৎ এতসব অভিযােগ পুঞ্জীভূত হইয়া উঠিবারই বা কারণ কি? কংগ্রেসী শাসনের বিরুদ্ধে মুছলমান সংখ্যালঘু প্রদেশগুলির অনেকদিন ধরিয়া নানাপ্রকার অভাব-অভিযোেগ শােনা যাইতেছিল। পীরপর রিপাের্ট, শরীফ রিপাের্ট প্রভৃতি তাহার প্রমাণ। হিন্দু মহাসভার এসব অভিযােগের ফিরিস্তি তাহারই পাল্টা জওয়াব মনে করিবারও যথেষ্ট কারণ রহিয়াছে। এ সমস্ত অভিযােগ উত্থাপনের ব্যাপারে “পরবর্তীচিন্তার (after thought) প্রেরণাও যে অনেকখানি সক্রিয় হইয়াছে তাহা বুঝিতে কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তির মােটেই বেগ পাইতে হয় না। বারান্তরে এ সম্বন্ধে আমরা আরও আলােচনা করিব।

১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, ৩ ফান ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

ঐক্য-বৈঠক

হিন্দু মুছলমান সমস্যা সমাধানের জন্য যে বঙ্গীয় হিন্দু-মােছলেম নেতৃবৃন্দের গােলটেবিল আলােচনা শুরু হইয়াছে, ইতিমধ্যে তার দুইটী বৈঠক হইয়া গিয়াছে। তিনজন হিন্দু নেতা স্যার মন্মথনাথ মুখার্জী, মিঃ এন, কে, বসু ও মিঃ হেমেন্দ্রপ্রসাদ বােস- সম্প্রতি তিনটী বিবৃতি করিয়া বৈঠকের কাৰ্য্যধারার প্রতিবাদ করিয়াছেন। উপরােক্ত তিনজন দ্রলােকও বৈঠকে আহূত হিন্দু প্রতিনিধি। তাদের বিবৃতির মুল সুর একই- অর্থাৎ এই গােলটেবিল বৈঠক দ্বারা সমস্যার সমাধান হইতে পারে না। কাজেই আলােচনার পণ্ডশ্রম এইখানেই শেষ হােক।

তাদের বিবৃতি হইতে জানা যায়, গত বৈঠকে আলােচনা চালাইবার জন্য একটী ছােট কমিটী গঠিত হইয়াছে। এই ছােট কমিটীর সদস্যপদ এই তিনজনের একজনও পান নাই বলিয়াই মনে হইতেছে- অন্ততঃ স্যার মন্মথ মুখার্জীকে যে ছােট কমিটীতে লওয়া হয় নাই, তাহা তাঁর বিবৃতিতেই প্রকাশ। এজন্য দ্রলােক যে একটুখানি ক্ষুব্ধ হইয়াছেন, তারও আভাস তার বিবৃতি হইতে না পাওয়া যায় এমন নয়। কিন্তু তাঁর ক্ষোভ প্রধানতঃ এজন্য নয়। এঁদের তিনজনেরই মতে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদকে বৈঠকের প্রধান আলােচ্য বিষয় না করিলে মৈত্রী-প্রচেষ্টার কোনাে অর্থ হয় না। মুছলমান সদস্যরা নাকি বলিয়াছেন যে, সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ হইতেছে নিখিল-ভারতীয় সমস্যা এবং কোনাে নিখিল-ভারতীয় সমস্যাকে প্রাদেশিকভাবে সমাধান-চেষ্টায় বিরত থাকিতে মােছলেম লীগ নির্দেশ দিয়াছেন; কাজেই এমত অবস্থায় তারা সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ রদ-বদলের কথা বিবেচনা করিতেও বর্তমান অবস্থায় অপারগ। ইহাতেই উক্ত হিন্দু নেতৃবৃন্দের দৃঢ়প্রতীতি জন্মিয়াছে যে, এ অবস্থায় মৈত্রীর আলােচনা চালানাে অর্থহীন।

আমাদের মতে, হিন্দু নেতৃত্রয়ের এই মনােভাব ঐক্য-বৈঠক ভাঙ্গিয়া দেওয়ার একটা চাল মাত্র। তারা আসলে আন্তরিকভাবে হিন্দু-মুছলমান ঐক্য কামনা করেন না। তাদের এই কামনা যে মােটেই আন্তরিক নহে, তাহা আমরা ইতিপূর্বে এক সুদীর্ঘ প্রবন্ধে বিস্তৃতভাবে আলােচনা করিয়াও দেখাইয়াছি। ঐক্য বৈঠক যখন চলিতেছে, সেই সময়ে “বিপন্ন হিন্দুদের রক্ষার জন্য পাঁচ লক্ষ হিন্দু যুবকের এক রক্ষীদল, গঠনের আয়ােজনে যারা মাতিয়া উঠিতে পারেন, তাদের আন্তরিকতা সম্বন্ধে সন্দেহ না হইয়াই পারে না। বস্তুতঃ যারা আন্তরিকভাবে মৈত্রী প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হইবেন, তাহাদিগকে শুধু নিজেদের কোলে ঝােল টানার মনােভাব ত্যাগ করিতে হইবে, ন্যায়বিচার সম্বন্ধে অবহিত হইতে হইবে- তাছাড়া, অতীতের প্রভুর-মােহ ত্যাগ করিয়া বাস্তব অবস্থা কি, তাহা সম্যক উপলব্ধি করিতে হইবে।

বাঙ্গলার বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দ অতীতের প্রভুত্ব-মােহে এমনি মশগুল আছেন যে, বাস্তবে অবস্থা কী দাঁড়াইয়াছে এবং দাঁড়াইতে বাধ্য, সে-সম্বন্ধে সম্যক ভাবনা-চিন্তা করিতেও নারাজ। সংখ্যাগুরু মুছলমানের অজ্ঞতা, দারিদ্র্য, Inferioritycomplex-এর সুযােগ গ্রহণ করিয়া, তাঁরা সংখ্যালঘু হইয়া এতদিন মুছলমানদের উপর প্রভূত্ব করিয়া আসিয়াছেন। তাঁরা চান, তাঁদের এই প্রভুত্ব চিরন্তন হােক। কিন্তু পরিবর্তনশীল জগতে এরূপ আশা বাস্তব-বিরােধী। মুছলমান চিরদিন তাদের সুবিধা সৃষ্টির জন্য অজ্ঞ হইয়া থাকিতে পারে না, তাদের দারিদ্র্য চিরন্তন হইয়া থাকিবে, এরূপও আশা করা যাইতে পারে না। তাছাড়া, মুছলমান চিরদিন নিজেকে হীন মনে করিয়া বৰ্ণহিন্দুদিগকে সেলাম ঠুকিতে থাকিবে, এই গণজাগরণের যুগে এরূপ ধারণা আঁকড়াইয়া পাকান্ধ বুদ্ধিমানের কাজ নহে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বাঙ্গলার বর্ণহিন্দু নেতৃবৃন্দের অধিকাংশই এই ধারণাই পালন করিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছেন।

সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ ধারণায় রূঢ় আঘাত লাগিয়াছে বটে। কিন্তু তারা সত্যিকার অর্থে ন্যায় এর অনিবাৰ্য্যতা উপলব্ধি করিয়া উঠিতে পারিতেছেন না- পারিলেও সৎসাহসের সাথে তাহা স্বীকার করিয়া লইতে অন্তরের অন্তস্থলে ব্যথাবােধ করিতেছেন।

সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদকেই তারা বিরােধের মূল কারণ বলিয়া ঘােষণা করিয়াছেন। কিন্তু এই রােয়েদাদের সাথে সংশ্রব শুধু আইন-সভায় নির্বাচিত আসন সংখ্যার। রােয়েদাদই যদি মূল কারণ হয়, তবে রােয়েদাদ রচনার পূর্বে এদেশে হিন্দুমুছলমান বিসম্বাদ হইত কেন? রােয়েদাদের আমলে বরং বাঙ্গলায় কোনরূপ দাঙ্গাহাঙ্গামা হইতে পারে নাই। কিন্তু এর পূৰ্ব্বে কলিকাতা, ঢাকা, বেলডাঙ্গা, পাবনা, দুর্গকাটি প্রভৃতি অগণ্য স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা, গুলীবর্ষণ ইত্যাদি হইয়াছিল কেন? কাজেই বলিতে হয়, মূল কারণ সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ নিশ্চয়ই নহে- অন্য কোনাে কারণ। তবে রােয়েদাদের মূলে একশ্রেণীর অতীত-মুগ্ধ বর্ণহিন্দু নেতার যে অন্তর্দাহ তীব্রতম হইয়া উঠিয়াছে, তাহা অস্বীকার করার উপায় নাই। এই অন্তর্দাহ দূর করার উপায় কিযদি না তারা বাস্তব অবস্থা সম্বন্ধে সচেতন হইয়া অনিবাৰ্য্যকে সৎ সাহসের সঙ্গে মানিয়া লয়েন।

সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদকে ক্ৰটীহীন বলিয়া আমরাও মনে করি না। কিন্তু এর ক্রটি সংশােধনের উপায় কি? ইহাকে যেকোন উপায়ে বাতিল করিয়া দিতে হইবে এই বলিয়া চীষ্কার করিলেই ইহা বাতিল হইয়া যাইবে না। হিন্দু-মুছলমান-খৃষ্টান-ইউরােপীয় প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সম্মতি ব্যতিরেকে ইহার রদবদল হওয়া সম্ভব নহে। আলােচ্য গােলটেবিল বৈঠকে ইউরােপীয়ানদিগকে ডাকা হয় নাই। এমত অবস্থায় তাহাদিগকে বাদ দিয়া রােয়েদাদ বাতিলের কথা আলােচনা করা নিরর্থক নয় কি?

কিন্তু হিন্দু নেতৃবর্গের রােয়েদাদ রদবদলের এই আগ্রহাতিশয্যের আসল কারণ কি? ইহাতে যদি হিন্দুদের প্রতি অবিচার করা হইয়া থাকে, তবে মুছলমানদের প্রতি কম অবিচার করা হইয়াছে, ইহা কেহই বলিতে পারিবেন না। মুছলমান শতকরা ৫৬ হইয়াও মাত্র শতকরা ৪৭টি আসন পাইয়াছে, ইহাকে কোনাে বিচার বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তি অবিচার না বলিয়া পারিবেন কি? শতকরা ৪৩ জন হিন্দুকে ৩৭টি আসন দেওয়া হইয়াছে, ইহা যে অবিচার একথা আমরা কখনাে অস্বীকার করি নাই। কিন্তু কথা হইতেছে, যাহা উভয় সম্প্রদায়ের পক্ষেই অবিচারমূলক, তাকে তারা সাম্প্রদায়িক বিসম্বাদের মূল কারণ বলিতেছেন কেন? মুছলমানদের ইহাতে অপরাধ কোথায়? যদি অপরাধ কাহারাে থাকে, তবে তাহা ম্যাক ডােনাল্ড সাহেবের। তার অপরাধের জন্য মুছলমানরা দোষের ভাগী হইবে কেন? মুছলমানরা বরং তাদের সহানুভূতি পাওয়ারই তাে যােগ্য।
কিন্তু সহানুভূতি তাে নয়, বরং এ সম্বন্ধে যত অপরাধের ভাগী করা হইতেছে মুছলমানদিগকে। মুছলমানরা বর্ণহিন্দুদের ভাগ কাড়িয়া লইয়াছে, ইহাই তাদের মনােভাব। শুধু মনােভাবই বা বলি কেন, বহুবার তাদের মুখ হইতে মুছলমানদের বিরুদ্ধে এই অভিযোেগও শােনা গিয়াছে। একথাও তারা বলিতে কুণ্ঠাবােধ করেন নাই যে, হিন্দুদিগকে বঞ্চিত করিয়া মুছলমানদিগকে তাঁদের প্রাপ্যাতিরিক্ত আসন দেওয়া হইয়াছে। ইহা তাদের বিদ্বিষ্টমনের অসত্য ভাষণ ছাড়া আর যে কিছুই নয়, সত্যসন্ধ ব্যক্তিমাত্রই তাহা স্বীকার না করিয়া পারেন না। এই মনােভাব লইয়াই তারা আজ দাবী করিতেছেন যে, বৈঠকের আলােচনায় রােয়েদাদ রদ-বদলের প্রশ্নই সবচাইতে বড় কথা- কারণ ইহাই হইতেছে সাম্প্রদায়িক বিসম্বাদের মূল কারণ। অর্থাৎ সংখ্যালঘু হিন্দুদিগকে বেশী আসন দিয়া সংখ্যাগুরু মুছলমান কম আসন গ্রহণে স্বীকৃত না হইলে ঐক্য-প্রচেষ্টার কোনাে দরকার নাই।

যারা এমন হুমকী দিতে পারেন, তাঁরা নিঃসন্দেহে ঐক্য-প্রতিষ্ঠার শত্রু- তাদের সাথে আলােচনা চালাইবার সত্যই কোনাে সার্থকতা নাই। কারণ, রােয়েদাদ রদবদলের শর্ত হিন্দু প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠারই শর্ত। যারা এই শর্ত দেন, তাঁদের মুখে ঐক্যের কথা শুধু অশােভন নহে, হাস্যকরও। কোনাে মুছলমান নিজের আত্মসমর্পণের শর্ত মানিয়া লইতে পারে না। যদি কেহ এমন শর্তও মানিয়া লইতে অগ্রসর হন, তবে তিনি বাঙ্গলার মুছলমানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতাই করিবেন।

১২ মার্চ ১৯৪০, ২৮ ফান ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-২

ক্যাক্সটন হলের হত্যাকাণ্ড

গত ১৩ই মার্চ রাত্রিকালে লন্ডন, ক্যাক্সটন হলে যে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হইয়া। গিয়াছে, আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, সমগ্র ভারত তাহাতে লজ্জায় ম্রিয়মান হইয়া পড়িবে। রয়টারের সংবাদে প্রকাশ, ঐ দিন ইন্ডিয়ান এসােসিয়েশনের এক সভায় সুপ্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক স্যার পার্সি সাইকুস আফগানিস্তানের ইতিহাস সম্পর্কে এক গবেষণামূলক বক্তৃতা প্রদান করেন। সভার শেষে যখন সমবেত দর্শকবৃন্দ বিদায় লইবার উপক্রম করিতেছিলেন, এমন সময় জনৈক ভারতীয় যুবক রিভলভার বাহির করিয়া সভায় উপস্থিত স্যার মাইক্যাল ও’ডায়ার, লর্ড জেটল্যান্ড, লর্ড লেডিংটন ও স্যার লুইডেনের প্রতি পর পর ছয়বার গুলীবর্ষণ করে। ফলে স্যার মাইক্যাল তৎক্ষণাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন, অপর তিনজন সৌভাগ্যক্রমে আহত অবস্থায় মৃত্যুর কবল হইতে রক্ষা পান।

আততায়ীকে ঘটনাস্থলেই গ্রেফতার করা হয়। নাম জিজ্ঞাসিত হইলে সে জানায় যে, তাহার নাম হইতেছে, ‘মমাহাম্মদ সিং আজাদ’। এরূপ অদ্ভুত নাম আমরা ইতিপূর্বে কখনও শুনি নাই। সুতরাং কথিত আততায়ী কোন সমাজভুক্ত, তাহা এখনও সঠিকভাবে বুঝা যাইতেছে না। আমাদের বিশ্বাস, আততায়ী যে নামে আত্মপরিচয় দিয়াছে, তাহা একটি ছদ্মনাম। সে যাহাই হােক, সে যে সমাজভুক্তই হােক না কেন, এরূপ জঘন্য কাৰ্যে যে লিপ্ত হইতে পারে, সে শুধু তাহার নিজ সমাজের নয়, সমগ্র ভারতের কলঙ্কস্বরূপ। তাহার এই কাপুরুষােচিত কার্য্যের নিন্দা করার মত উপযুক্ত ভাষাও আমরা খুঁজিয়া পাইতেছি না।

কি উদ্দেশ্যে উক্ত উন্মাদ যুবক এইরূপ পৈশাচিক কার্যে লিপ্ত হইয়াছিল, তাহা এখনও সুনির্দিষ্টরূপে বুঝা যাইতেছে না। তবে যে সকল খ্যাতনামা রাজনীতিকের জীবননাশের চেষ্টা সে করিয়াছিল এবং আংশিক সফলও হইয়াছে, তাহাতে এই ধারণাই মনে আসে যে, এই হত্যাকাণ্ডের সহিত ব্যক্তিগত আক্রোশের কোন সংশ্রব নাই। পরন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই আততায়ী এইরূপ ভয়ঙ্কর কাৰ্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে। পাঠকগণের জানা থাকিতে পারে, ক্যাক্সটন হলে গুলীবর্ষণের ফলে যাহারা আহত বা নিহত হইয়াছেন, তাহাদের প্রত্যেকেই কোন না কোন সময় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গবর্ণরূপে কাজ করিয়া গিয়াছেন। লর্ড লেডিংটন ও স্যার লুইডেন যথাক্রমে বােম্বাই ও পাঞ্জাবের গবর্ণর ছিলেন। লর্ড জেটল্যান্ড, যিনি বর্তমানে ভারত-সচিব, তিনি বাংলার গবর্ণর ছিলেন। এবং নিহত স্যার মাইক্যাল ও ডায়ার ইতিহাস-প্রসিদ্ধ জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের সময় লেফট্যান্যান্ট গবর্ণরূপে পাঞ্জাব প্রদেশ শাসন করিতেছিলেন। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ফলে সমগ্র ভারতের জনমত কিরূপ বিক্ষুব্ধ হইয়া উঠিয়াছিল, তাহা হয়তাে পাঠকগণের অনেকেরই স্মরণ আছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাস ভারতের জাতীয় জীবনে এক মর্মদ রেখাপাত করিয়া গেলেও এইরূপ জঘন্য উপায়ে কেহ স্যার মাইকেলকে হত্যা করিতে যাইবে, ভারতবাসী তাহা কল্পনাতেও আনিতে পারে নাই।

ভারতীয় সন্ত্রাসবাদীদের কাৰ্যকলাপের শােচনীয় ব্যর্থতা বার বার প্রমাণিত হইবার পরেও যদি কেহ বিশ্বাস করে যে, এই শ্রেণীর কাপুরুষােচিত কাৰ্য্য দ্বারা দেশের কল্যাণ হইবে, তবে তাহাকে উন্মাদ ছাড়া আর কি বলা যাইতে পারে? সন্ত্রাসবাদীদের বহুনিন্দিত কাৰ্য্যকলাপে ভারতের বিশেষ করিয়া বাংলার রাজনৈতিক জীবনের যে অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হইয়াছে- বাংলা সমগ্র পৃথিবীর সম্মুখে যে ভাবে ঘৃণ্য প্রতিপন্ন হইয়াছে, আমাদের আশঙ্কা হয়, ক্যাক্সটন হল গুলীবর্ষণের ফলেও নাকি তেমনিভাবে ভারতের সুনামে কলঙ্কপাত হয়। তবে এ-বিশ্বাস আমাদের আছে, যাহারা ভারতবর্ষকে জানেন, তাহারা এক উন্মাদ যুবকের কার্যের দায়িত্ব কখনই সম্র ভারতের উপর আরােপ করিবেন না।

১৫ মার্চ ১৯৪০, ২ চৈত্র ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-১

মােছলেম লীগের সাফল্য

বঙ্গীয় উচ্চ পরিষদের ডাইরেক্ট ইলেকশনের ফলাফল ঘােষিত হইয়াছে। চট্টগ্রাম জেলা, প্রেসিডেন্সী বিভাগ, (উত্তর) পাবনা, বগুড়া এবং ফরিদপুর জেলা মােছলেম নির্বাচন কেন্দ্র হইতে যথাক্রমে নূর আহমদ, আবদুল আজিজ, ডাঃ কছিরুদ্দীন তালুকদার এবং চৌধুরী মােয়াজ্জেম আলী নিৰ্বাচিত হইয়াছেন। এই চারজন নব-নির্বাচিত সদস্যের মধ্যে প্রথমােক্ত তিনজন মােছলেম লীগের মনােনীত প্রার্থী। তাহারা একমাত্র লীগের টিকিটেই নির্বাচন-প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হইয়াছিলেন- কেবল চৌধুরী, মােয়াজ্জেম আলী লীগ-টিকিটে নির্বাচন প্রার্থী হন নাই। কিন্তু তাহার নির্বাচন-সাফল্যও কতক মােছলেম লীগের অনুকুল প্রভাবের ফল।

নিৰ্বাচিত ব্যক্তিদের মধ্যে চট্টগ্রামের মওলবী নূর আহমদ একজন সুপরিচিত সমাজসেবক ও কর্মী। তাহার সাফল্যে মােছলেম লীগের মনােনয়ন অনেকখানি সাহায্য করিয়াছে সন্দেহ নাই, কিন্তু এই নির্বাচনে বিস্ময়ের তেমন কিছুই নাই। ডাঃ কছিরুদ্দীন তালুকদার এবং খান ছাহেব আবদুল আজিজের সাফল্যের মূলে লীগের প্রতিপত্তিই যে প্রধান সম্বল ছিল, তাহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। ডাঃ কছিরুদ্দীন সুযােগ্য ব্যক্তি কিন্তু তিনি বাংলার জনসাধারণের নিকট অপেক্ষাকৃত অপরিচিত; তদুপরি তাঁহাকে একজন সিটিং মেম্বরের সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া জয়ী হইতে হইয়াছে। খান ছাহেব আবদুল আজিজের অবস্থাও প্রায় অনুরূপ। তাঁহাকে বিপুল বিত্তশালী এবং বিপরীত পাঞ্জাবী ব্যবসায়ী খান বাহাদুর ফজলে এলাহীর সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিতে হয়। এই শেষােক্ত দুইজনের নির্বাচন-সাফল্যে মােছলেম লীগের কৃতিত্বই যে সর্বাপেক্ষা অধিক, তাহা অনায়াসেই বুঝা যায়। ফরিদপুরের চৌধুরী মােয়াজ্জেম আলী লীগ-টিকিটে নির্বাচন প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হন নাই সত্য, কিন্তু তার সাফল্যের পথ মােছলেম লীগই প্রশস্ত করিয়া দিয়াছিল। চৌধুরী মােয়াজ্জেম আলী। অদূর ভবিষ্যতে মােছলেম লীগে যােগদান করার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বঙ্গীয় প্রাদেশিক লীগ ফরিদপুরে কোন লীগ প্রার্থীকে দাঁড় করান নাই। এজন্য তাহার নির্বাচনী প্রচারকার্যে কোন কোন লীগ নেতার পক্ষ হইতেও আবেদন প্রচারিত হইয়াছিল। সুতরাং ফরিদপুরের এই নির্বাচন-সাফল্যেও মােছলেম লীগের কৃতিত্ব অনেকখানি।

উচ্চ পরিষদের এই নির্বাচনে লীগ মনােনীত প্রার্থীদের এই সাফল্যে এক হিসাবে নূতন কিছুই সূচিত হয় নাই; কারণ ১৯৩৭ সনে লাখনৌর স্মরণীয় অধিবেশনের পর হইতে ভারতের সর্বত্র মােছলেম লীগের যে দুর্বার বিজয়াভিযান আমরা লক্ষ্য করিয়াছি, ইহা তাহারই একটি খণ্ডিত প্রকাশ মাত্র। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বাংলার বুকে মােছলেম লীগের এই সাফল্যে অনেক কিছু তলাইয়া দেখিবার আছে। ভারতের সর্বত্র সকল নির্বাচন-উপনির্বাচনে লীগের সাফল্য একটা আশ্চৰ্য্য অস্বাভাবিক কিছু না-ও হইতে পারে। কারণ, অন্যত্র শুধু লীগের জনপ্রিয়তা নয়, লীগ সে সব স্থানে সংগঠনের দিক দিয়াও যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় করিয়াছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ কর্ণধারদের উদাসীনতার জন্য বাংলায় মােছলেম লীগ এখনও তেমন সুগঠিত হইয়া উঠিতে পারে নাই। কিন্তু বহু নির্বাচনের মত এবারকার উচ্চ পরিষদের নির্বাচন-সাফল্য প্রমাণ করিয়া দিয়াছে, বাংলায় মুছলমান আজ কতখানি লীগমনা; মােছলেম লীগের নামের যাদু বাংলার কতখানি প্রভাব বিস্তার করিতে পারে।

এই নির্বাচনের ফলাফল হইতে লীগের সমালােচকদেরও অনেক কিছু শিখিবার আছে। এখনও যাহারা মােছলেম লীগের শক্তি ও সাফল্যের প্রতি অবিশ্বাসী, তাহাদের মত পরিবর্তনের আজ সময় আসিয়াছে। মুছলমানদের মধ্যে কংগ্রেস বা বর্ণচোরা কংগ্রেসের মায়াজাল বিস্তারের সুখস্বপ্নে আজও যাহারা বিভাের, তাহাদের আজ সাবধান হওয়া উচিত। তাহাদের আজ জানা উচিত, বাংলার মুছলমান মােছলেম লীগকেই তাহার জাতীয় জীবনের আশা-আকাক্ষার একমাত্র প্রতীক মনে করে। মােছলেম লীগের জয়-পরাজয়ের সাথে সে তার জাতীয় জীবনের আশা-নিরাশার স্বপ্ন দেখে।

বঙ্গীয় উচ্চ পরিষদের নব-নির্বাচিত লীগ-সদস্যদিগকে আমরা আমাদের সানন্দ অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি। আজ যাহাদের যত্ন ও চেষ্টায় লীগের নির্দেশ জয়যুক্ত হইল; বিশেষ করিয়া যে সমস্ত নেতার সাহায্যে লীগের নির্বাচনের এই জয়মাল্য বহিয়া আনিলেন বাংলা ও আসামের তিন কোটি মুছলমানের পক্ষ হইতে আমরা তাহাদিগকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি।

২২ মার্চ ১৯৪০, ৯ চৈত্র ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-৩য়, পৃষ্ঠা-২

মােছলেম জাহানের স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য

মােছলেম লীগের সভাপতি কায়েদে আজম মােহাম্মদ আলী জিন্না আগামী ১লা নভেম্বর মােছলেম ভারতে প্রার্থনা-দিবস পালনের নির্দেশ জারী করিয়াছেন। বর্তমান ইউরােপীয় যুদ্ধ-সঙ্কটের দরুণ মােছলেম জাহানে যে বিপদের কালাে মেঘ সঞ্চারিত হইয়াছে, তাহা যাতে দূরীভূত হইয়া যাইতে পারে, সে উদ্দেশ্যে খােদার দরবারে প্রার্থনা জানাইবার জন্যই এই দিবস পালনের আহ্বান। পাঠকগণ জানেন, বিগত ২৯শে সেপ্টেম্বর লীগকাউন্সিলের এক প্রস্তাবে মিঃ জিন্নাকে এই সম্পর্কে ব্যবস্থা অবলম্বনের জন্য পূর্ণ ক্ষমতা প্রদত্ত হইয়াছিল। সেই ক্ষমতাবলে মিঃ জিন্না সমস্ত প্রাদেশিক লীগের নিকট এক সার্কুলার জারী করিয়া এই নির্দেশ জানাইয়াছেন।

আমরা আশা করি, মােছলেম ভারতে কায়েদে আজমের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালিত হইবে। কায়েদে আজমের নির্দেশপ্রাপ্ত প্রাদেশিক লীগ কমিটীগুলির চেষ্টায় জেলায় জেলায়, মহকুমায় মহকুমায় এমনকি, ইউনিয়নে ইউনিয়নে এই নির্দেশ ভারতের অগণ্য মুছলমানদের প্রাণে সাড়া জাগাইবে, মুছলমানের প্রাণের আকুল প্রার্থনা সে-নির্দিষ্ট দিনে খােদার দরবারে নিবেদিত হইবে, ইহাতে আমাদের সন্দেহ মাত্র নেই। আকুল এবং আন্তরিক প্রার্থনা কখনাে ব্যর্থ হয় না, কাজেই মােছলেম জাহানের আসন্ন বিপদ কাটিয়া যাওয়া মােটেই বিচিত্র কথা নহে। তাছাড়া সারা ভারতব্যাপী সমস্ত মুছলমানের সমবেত প্রার্থনার অন্য একটা মূল্যও আছে। লীগমন্ত্রে মােছলেম ভারতের ঐক্যবন্ধন ইহাতে দৃঢ় হইবে। ইহা শুধু লীগের নয়, ভারতের মুছলমানদের জীবনেও এক নবশক্তির সঞ্চার করিবে। সত্যিকার ঐক্যবােধে উদ্দীপ্ত নয় কোটী মুছলমানের শক্তি দুর্বার, তাহাতে সন্দেহ থাকিতে পারে না।

বিশ্বের মুছলমান পরস্পরের ভাই, এছলামের এ-শিক্ষা একদিন মুছলমানের জীবনে সত্য হইয়াছিল। আজ নানা বিভেদ-বিসম্বাদে ও শয়তানের ওয়াজওয়াছার জন্য মুছলমান এ-সত্য কতকটা ভূলিয়া গেলেও, ইহা এখনাে তাদের জীবনে একেবারে মিথ্যা হইয়া যায় নাই- এখনাে এছলামের এ মহাসত্য দুনিয়ার মুছলমানের মনে ভস্মাচ্ছাদিত অগ্নির ন্যায় বিরাজ করিতেছে। ভস্মের আচ্ছাদনটুকু যদি কোনাে সত্যিকার মুছলমান আয়ােজিত করিয়া দিতে পারেন, তবে বিশ্বব্যাপিয়া আবার দাবানল সৃষ্টি হইয়া যাওয়াও বিচিত্র কিছু হইবে না। উপরােক্ত সত্য মুছলমানের জীবনে এখনাে একেবারে যে মিথ্যা হইয়া যায় নাই, তার প্রমাণ এখনাে দুনিয়ার এক প্রান্তের মুছলমানের বিপদের বার্তা শুনিলে অপর প্রান্তের মুছলমান সমবেদনা অনুভব না করিয়া পারে না। বস্তুতঃ এ সমবেদনা এখনাে মুছলমানের অন্তরে একটা চিরন্তন সত্যঅনুভূতি হইয়াই আছে- শুধু তাহা সক্রিয় হইয়া উঠার পথ খুঁজিয়া পায় না।

আজ মােছলেম জাহানে কী গুরুতর বিপদ আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে, সংবাদপত্র পাঠকগণের তাহা অবিদিত নহে। আল-বানিয়া আজ ইটালীর পবলে পর্যুদস্ত ত্রিপলী লিবিয়া বহুদিন হইতে অত্যাচারীর রথচক্ৰতলে পিষ্ট হইয়া ধুকিতেছে। মরােক্কো, আলজিরিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা, লিবিয়া, ফেলিস্তিন সাম্রাজ্যবাদীর শােষণে নিঃশেষিতপ্রায়। যারা এতদিন নিজেদের স্বাধীনতাটুকু বজায় রাখিয়া আসিতে পারিয়াছে, সেই তুরস্ক, মিছর, আরব, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তানের উপরও কালশকুনীর শ্যেন দৃষ্টি পড়িয়াছে। এদের স্বাধীনতার উপরও হামলা না হইতে পারে, এমন নয়। ইটালী, মিছর দখল করার জন্য চেষ্টা করিতেছে। —-

কিন্তু মধ্য এশিয়ার ভিতর দিয়া তার যে ইরান ও আফগানিস্তান আক্রমণের মতলব একেবারে নাই, ইহাই বা নিশ্চিতভাবে কি করিয়া বলা চলে?

বস্তুত ইউরাপীর মুদ্ধ পরিস্থিতি বর্তমান সময়ে যেরূপ, তাহাতে কিছুই আর অসম্ভব নহে। আফ্রিকা ও নিকট-প্রাচ্যের মােছলেম রাজ্যগুলির উপর আক্রমণ চালাইবার হুমকী ইতিমধ্যেই শ্রুত হইতেছে। ইটালী তাে মিছরে একরূপ অভিযান শুরুই করিয়াছে। কাজেই মােছলেম জাহানের উপর এক গুরুতর দুর্দিন যে আসন্ন হইয়া উঠিয়াছে, তাহাতে সন্দেহ করা চলে না। এমত অবস্থায় কায়েদে আজমের প্রার্থনা-দিবস পালনের নির্দেশ খুবই সমালােচিত হইয়াছে।

১৩ অক্টোবর ১৯৪০, ২৭ আর্কিন ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

অর্থনেতিক ==

পাটচাষ নিয়ন্ত্রণ

গত বৃহস্পতিবার রাত্রিতে পাটচাষ নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বাংলার সরকার যে গুরুত্বপূর্ণ এশতেহার প্রকাশ করিয়াছেন, বাংলার হিতকামী ব্যক্তিমাত্রেই তাহাতে সবিশেষ আনন্দিত হইবেন। যথেচ্ছ পাট-চাষের ফলে কলওয়ালীদের হাতে প্রচুর পরিমাণ পাট জমিয়া যাওয়ায় সে শােচনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছিল, তাহা কাহারও অজানা নাই। কয়েক বৎসর পূর্বে ফিনলাে কমিটী’ যখন তাহাদের তদন্ত-রিপাের্ট দাখিল করেন, তখনই এদিকে দেশবাসীর এবং গবর্ণমেন্টের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয় এবং তখন হইতেই বাংলা গবর্ণমেন্ট পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করিতে থাকেন। ইতিপূর্বে স্বেচ্ছামূলকভাবে পাটচাষ নিয়ন্ত্রণের জন্য গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে কয়েক বৎসর জোর প্রচারকাৰ্য্যও চলিতে থাকে। কিন্তু সকলেই জানেন, তাহাতে বিশেষ কোন ফল হয় নাই। চাষীরা মজুত পাট ও চাহিদার দিকে বিন্দুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া নিজেদের সুযােগ ও সুবিধামত পাট চাষ করিয়াছে এবং তাহারই ফলে গত কয়েক বৎসর পাটের দাম অনেক সময় উৎপন্ন ব্যয়েরও নীচে চলিয়া গিয়াছে। এই শােচনীয় দুর্দশা হইতে বাংলার চাষীকুলকে রক্ষা করিবার জন্য হক-মন্ত্ৰীমণ্ডলী বাধ্যতামূলকভাবে পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত করেন এবং সেই উদ্দেশ্যে আইনসভায় গবর্ণমেন্টের পক্ষ হইতে একটী বিলও উপস্থিত করা হয়, পাঠকগণ তাহা বিশেষরূপেই অবগত আছেন। “আজাদের সম্পাদকীয় স্তম্ভে সে সম্বন্ধে আমরা বিস্তৃত আলােচনাও করিয়াছি।

যুদ্ধের ফলে পাটের চাহিদা আকস্মিকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৪০ সনেই পাটচাষের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত করা আবশ্যক কিনা, সে সম্বন্ধে গবর্ণমেন্ট বিশেষভাবে চিন্তা করিতেছেন, এই মর্মে আইন সভার গত অধিবেশনে মাননীয় মন্ত্রী মিঃ তমিজউদ্দীন খান এক বিবৃতি প্রদান করিলে কলিকাতার সাংবাদিক মহলে এক অনাবশ্যক বিতর্কের সৃষ্টি হয়। তথাকথিত জাতীয়তাবাদী কোন কোন সংবাদপত্র রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি সাধনের উদ্দেশ্যে প্রচার করিতে থাকেন যে, বাংলা গবর্ণমেন্ট পার্ট-কলওয়ালীদের চাপে পড়িয়া পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা পরিত্যাগ করিয়াছেন। পাটচাষ নিয়ন্ত্রণের বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার মজুদ পাটের পরিমাণ, ভবিষ্যৎ চাহিদা, ইউরােপীয় যুদ্ধের গতি এবং পরিণতি ইত্যাদি বহুবিধ বিষয় লক্ষ্য করিবার আছে বলিয়া বাংলা গৱৰ্ণমেন্ট পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণ বিল উপস্থিত করার সঙ্গে সঙ্গেই ১৯৪০ সনের ফসল সম্বন্ধে তাহাদের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিতে পারেন নাই। সমস্যার গুরুত্বের দিক দিয়া বিচার করিলে ইহাতে যাহাদের কোন ক্ৰটী তাে হয়ই নাই, বরঞ্চ বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে স্থিরভাবে দেশের এবং বিদেশের যাবতীয় অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করিবার পর যে সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাহাতে বিজ্ঞতারই পরিচয় দেওয়া হইয়াছে। ফলে আর্থিক জগতে কোন অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনা ঘটিয়া না গেলে ১৯৪০ সনে পাটের দাম আশানুরূপ হইবারই কথা।

যুদ্ধের ফলে এবার পাটের দাম অনেক খানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কেহ কেহ এই যুক্তি দর্শাইয়াছিলেন যে, যুদ্ধ চলিতে থাকা অবস্থায় পাট চাষ নিয়ন্ত্রণ করিবার কোন আবশ্যকতা নাই। কেননা চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপন্ন পাটের পরিমাণ কিঞ্চিৎ বাড়িলেও দাম বিশেষ হ্রাস পাইবে না। আর যদিই বা পাটের মণপ্রতি দাম হ্রাস পায়, তথাপি অধিক পরিমাণ পাট বিক্রয় হইবে বলিয়া পরিণামে চাষীদের মােটলাভের পরিমাণ বৃদ্ধিই পাইবে। কথাগুলি নিতান্তই অযৌক্তিক, একথা বলা যায় না। পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণ সমস্যার এই দিকটার কথা ভাবিয়াই মন্ত্রীসভা কর্তব্য নির্ধারণে ইতস্ততঃ করিতেছিলেন। যাই হােক শেষ পর্যন্ত তাহারা যে সকল তথ্য সগ্রহ করিয়াছেন এবং বিশেষজ্ঞগণের সাহায্যে ভবিষ্যৎ চাহিদা সম্বন্ধে যতদূর ওয়াকেফহাল হইতে পারিয়াছেন, তাহাতে তাঁহাদের স্থিরবিশ্বাস জন্মিয়াছে যে, যদি ১৯৪০ সনেই পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণ করা না হয়, তবে চাষীরা এত অধিক পাট উৎপন্ন করিয়া বসিবে যে, পরে শত চেষ্টায়ও আর সুফল লাভ করা যাইবে না। কাজেই ১৯৪০ সনেই বাধ্যতামূলক পাটচাষ নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য বিবেচিত হইয়াছে।

গৰৰ্ণমেন্ট এ সম্বন্ধে যে সকল তথ্য সগ্রহ করিয়াছেন তাহা নির্ভরযােগ্য হইলে, একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় যে, এই ব্যবস্থায় চাষীগণের সমূহ কল্যাণসাধিত হইবে। অবশ্য বাধ্যতামূলকভাবে পাট-চাষ নিয়ন্ত্রণের সিদ্ধান্ত করায় চাষীগণের ব্যক্তিস্বাধীনতার স্বাভাবিক অধিকারে কঞ্চিৎ হস্তক্ষেপ করা হইল। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, বাধ্যতামূলক আইন প্রবর্তনের পূর্বে গবর্ণমেন্ট যত প্রকার চেষ্টা করিয়াছেন, সব কিছুই ব্যর্থ হইয়া গিয়াছে। বাংলার আর্থিক জীবনে পাট যেরুপ গুরূত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করিয়া আছে তাহাতে ব্যক্তি-স্বাধীনতা বিপন্ন হইবে, এই অজুহাতে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় বসিয়া থাকা কোন পপুলার গবর্ণমেন্টের পক্ষে সম্ভব নয়। বাংলা গবর্ণমেন্ট চাষীদের দুঃখ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছেন। তাই তাহাদের এই আয়ােজন।

পাটচাষ নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে বিহার ও আসামের সাহায্য ও প্রয়ােজন হইবে দেখিয়া সুখী হইলাম, এ বিষয়ে প্রয়ােজনীয় সাহায্য দানের জন্য বাংলা গবর্ণমেন্ট বিহার ও আসাম সরকারকে যথাসময় অনুরােধ জানাইবেন। শেষােভ দুই গবর্ণমেন্ট এ বিষয়ে বাংলা সরকারকে যথােচিত সাহায্য দান করিবেন, এ রসা আমরা নিশ্চয়ই করি। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে এই পরিকল্পনার সাফল্য বহুলাংশে নির্ভর করিবে বাংলার চাষীদের উপর। তাহারা যদি সমবেতভাবে পাটচাষ নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনাকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে উদ্যোগী হয়, তবে নিঃসন্দেহে বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতেই বাংলার অদৃষ্ট ফিরিয়া যাইবে। বাংলার অগণিত কৃষক তাহাদেরই প্রিয় মন্ত্রীমণ্ডলীর সাধু উদ্যমে সর্বান্তঃকরণে সহায় হউক, ইহাই আমাদের আন্তরিক প্রার্থনা।

৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, ২০ মাঘ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

কর্পোরেশন-বাজেট

গত শুক্রবার কলিকাতা কর্পোরেশনের এক সভায় আগামী বৎসরের বাজেট উপস্থাপিত হইয়াছে। বাজেট উপস্থাপনকালে চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার কলিকাতা কর্পোরেশনের আর্থিক দুরবস্থার যে ভয়াবহ চিত্র আঁকিয়াছেন এবং তাহার কারণ উল্লেখ করিতে গিয়া যে সকল তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করিয়াছেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাহাতে করদাতাগণ কোনক্রমেই কর্পোরেশন কর্তৃপক্ষকে ক্ষমা করিতে পরিবেন না। সকলেই জানেন, গত কয়েক বৎসর হইতেই কর্পোরেশনের অবস্থা ক্রমে খারাপ হইয়া আসিতেছিল। বহু পূর্বেই চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার এ সম্বন্ধে পুনঃ পুনঃ সাবধান বাণী উচ্চারণ করিয়াছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কর্পোরেশনের পরিচালকগণ এদিকে দৃষ্টি দিবার অবকাশ পান নাই। ফলে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নগরীর স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশন আজ দেউলিয়া হইতে চলিয়াছে।

পাঠকগণ হয়তাে জানেন, প্রতি বৎসরই কর্পোরেশনের তহবিলে কত টাকা উদ্ধৃত্ত থাকা প্রয়ােজন। কারণ, সমস্ত বত্সর খরচ প্রায় সমানভাবে চলিলেও বৎসরের প্রথম দিকে আয় তেমন হয় না। এ-অবস্থায় পূর্ব বৎসরের আয় হইতে যদি কিছু অর্থ পরবর্তী বৎসরের জন্য রাখিয়া না দেওয়া হয়, তবে কর্পোরেশনের যে সকল বাধা খরচ আছে, তাহা চালানই দায় হইয়া পড়িবে। প্রধানতঃ এই কারণে প্রত্যেক বৎসরই কিছু কিছু অর্থ পরবর্তী বৎসরের জন্য উদ্বৃত্ত রাখিয়া দিতে হয়। কিছুকাল পূর্বে কর্পোরেশন সভা এই সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, যে কোন মতেই হােক প্রতি বৎসর অন্ত তঃ চল্লিশ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত রাখিতেই হইবে। কিন্তু চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের বিবৃতিতে দেখা যায়, নিতান্ত অসঙ্গতভাবে এর সঙ্কোচ করিয়াও আগামী বৎসর সাড়ে চব্বিশ লক্ষ টাকার বেশী উদ্ধৃত্ত থাকিবে না। অবশ্য ভাগ্যক্রমে পাের্ট কমিশনারস হইতে এককালীন বহু লক্ষ টাকা পাওয়ায় আগামী বৎসর শেষে কোন মতে সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষ টাকা উদ্ধৃত্ত রাখার ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত করা গিয়াছে। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে, এককালীন অর্থ প্রাপ্তি প্রতি বৎসর ঘটিবে না। যদি কর্পোরেশনের আয়বৃদ্ধি না পায়, তবে বৎসর শেষে কোনক্রমেই সচরাচর পঁচিশ লক্ষ টাকার বেশী উদ্বৃত্ত থাকিবে না।

যে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় হইতেছে মাসে কুড়ি লক্ষ টাকারও বেশী, তাহার পক্ষে মাত্র পঁচিশ লক্ষ টাকা উদ্বৃত্ত লইয়া এই মহানগরীর বিরাট দায়িত্বভার বহন করিতে যাওয়া যে কতখানি বিপজ্জনক তাহা সহজেই অনুমেয়।

চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার যেভাবে বাজেট প্রস্তুত করিয়াছেন, তাহা ন্যায়সঙ্গত হইয়াছে, এই কথা বলিয়া লইয়াই দেখা যায়, আগামী বৎসর সাড়ে চৌত্রিশ লক্ষ টাকার বেশী উদ্ধৃত্ত থাকিবে না। কিন্তু এই আলােচ্য বাজেটে যেভাবে ব্যয় সঙ্কোচন করা হইয়াছে, কোন নিরপেক্ষ ব্যক্তি সকল সমর্থন করিতে পারিবেন বলিয়া আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা যতদূর বুঝি, প্রাথমিক শিক্ষা, হাসপাতাল আতুর আশ্রম ইত্যাদিতে সাধ্যমত ব্যয় করা প্রত্যেক কর্পোরেশনেরই উচিত।

আয়ের পরিমাণ বেশী না দেখাইতে পারিলে তবে আগামী বৎসর আমরা ধার করিয়া কোন কাজ চালাইতে পারিব কিনা, তাহাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ভাল কথা। কিন্তু ব্যয় অপেক্ষা আয় যে বেশী হইবার নহে, তাহা তাে আলােচ্য বাজেটেই পরিষ্কাররূপে ধরা পড়িয়া গিয়াছে। আলােচ্য বাজেটে যে স্থলে আয়ের পরিমাণ দেখা যাইতেছে ২,৫০,৩৪,০০০ সেস্থলে ব্যয় দেখান হইয়াছে ২,৬৩,৩৫,০০০ টাকা। এইভাবে চলিলে আগামী কয়েক বৎসর মধ্যেই কলিকাতা কর্পোরেশনকে যে দেউলিয়া খাতায় নাম লেখাইতে হইবে, তাহা বলাই বাহুল্য।

কলিকাতা কর্পোরেশনের এই শােচনীয় অবস্থার প্রতিকারকল্পে চীফ এক্সিকিউটিভ অফিসার যে কতকগুলি উপায় নির্দেশ করিয়াছেন, তাহার মধ্যে প্রাইমারী শিক্ষার ব্যয়সঙ্কোচ, প্রাইমারী শিক্ষা বাবদ নূতন করধাৰ্য্যকরণ, মটরযানের উপর ধার্য করে কর্পোরেশনের অংশ বৃদ্ধি প্রমােদকরের উপর কর্পোরেশনের অধিকার স্থাপন ইত্যাদিই প্রধান। এই সকল প্রস্তাব কর্পোরেশন সভা গ্রহণ করিবেন কি না, তাহা আমাদের জানা নাই। সুতরাং এগুলি সম্বন্ধে বর্তমানে বিস্তৃত আলােচনা করিতে চাই না। কিন্তু এস্থলে লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, যদি কর্পোরেশনের বর্তমান কালচার চলিতে থাকে, তবে উপরােক্ত উপায় অবলম্বন ব্যতীত এই বিরাট প্রতিষ্ঠানটিকে রক্ষা করিবার আর কোন উপায় নাই অন্ততঃ চীফ একজিকিউটিভ অফিসারের ইহাই বদ্ধমূল ধারণা। | কলিকাতা কর্পোরেশনের আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে আমরা যে সংক্ষিপ্ত পরিচয় প্রদান করিলাম, তাহা অত্যন্ত শােচনীয় সন্দেহ নাই। কিন্তু জিজ্ঞাস্য, এ অবস্থার জন্য দায়ী কে? কাহার অযােগ্যতায় আজ কলিকাতাবাসীর উপর নূতন কর ধৰ্য্যের প্রয়ােজন হইতেছে? কাহার অক্ষমতায় প্রাথমিক শিক্ষা, হাসপাতাল ইত্যাদি জনহিতকর ব্যাপারে ব্যয়সঙ্কোচের প্রয়ােজন অনুভূত হইতেছে? এখানে তাে গত কুড়ি বৎসরের মধ্যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী”র আজ “অযােগ্য” মুছলমানেরাও তাে কর্পোরেশনের ত্রিসীমানার মধ্যে তাহাদের কর্তৃত্ব ফলাইতে আসে নাই। আজ যাঁহারা নিজদের সততা ও নিজেদের যােগ্যতার ঢাক পিটাইয়া বাংলার আকাশ-বাতাস কাঁপাইয়া তুলিতেছেন, সেই কংগ্রেসী ধুরন্ধরেরাই তাে প্রায় কুড়ি বৎসর ধরিয়া কলিকাতা কর্পোরেশনের উপর একনায়কত্ব করিয়া আসিয়াছেন।

১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, ২৮ মাঘ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

পাট-নিয়ন্ত্রণ-বিল

গত সােমবার অপরাহ্নে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদে পাটচাষ-নিয়ন্ত্রণ-বিলের উপর যে বিতর্কের অনুষ্ঠান হয়, তাহাতে পরিষদের প্রায় সকল দলের সদস্যই যােগদান করিয়াছিলেন। কংগ্রেসী তরফ হইতে ডাঃ নলিনাক্ষ্য সান্ন্যাল, শ্রমিক দলের পক্ষ হইতে মিঃ শিবনাথ ব্যানাজ্জি, ইউরােপীয় দলের প্রতিনিধি মিঃ কেনেডি ও মন্ত্রীসভার পক্ষ হইতে কৃষিমন্ত্রী মাননীয় মিঃ তমিজুদ্দিন খান নিজ নিজ বক্তব্য যথাযােগ্যভাবেই বিশ্লেষণ করিয়াছেন।

ইউরােপীয় দলের বক্তব্য এই যে, ১৯৪০ সনের পাটচাষ-নিয়ন্ত্রণ-প্রচেষ্টা মােটেই যুক্তিসঙ্গত হয় নাই। কি কারণে ইহা অযৌক্তিক হইল, মিঃ কেনেডির প্রকাশিত বক্তৃতায় তাহার উল্লেখ না থাকিলেও তাহা বুঝিয়া লইতে কষ্ট হয় না। কয়েকদিন আগে ইউরােপীয় দলের অন্যতম সদস্য মিঃ ওয়াকার স্পষ্টই বলিয়া ফেলিয়াছিলেন যে, এই পরিকল্পনা সাফল্যমণ্ডিত হইলে পাটের দর অপ্রত্যাশিতরূপে বাড়িয়া যাইবে এবং তাহার ফলে পাটজাত দ্রব্য উৎপন্নের বিঘ্ন ঘটিবে। মিঃ কেনেডির যুক্তিও বােধহয় তাহাই। ইউরােপীয় দলের মনােভাব বিস্তৃত আলােচনা করিয়া লাভ নাই, তবে এ প্রসঙ্গে আমাদের একমাত্র বক্তব্য যে, যে স্থলে মুষ্টিমেয় কোটীপতি কলওয়ালা ও কোটী কোটী নিরন্ন কৃষক প্রজার স্বার্থের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ, সেস্থলে যে-কোন জনপ্রিয় গবর্ণমেন্টকে বাধ্য হইয়াই কৃষক-কুলের স্বার্থের প্রতি দৃষ্টি দিতে হইবে। কাজেই ইউরােপীয় দলের স্বার্থে কিঞ্চিৎ আঘাত পড়িলেও অবিলম্বে পাট-চাষ-নিয়ন্ত্রণ-পরিকল্পনায় হাত না দিয়া গবর্ণমেন্টের গত্যন্তর ছিল না।

কংগ্রেসীদলের বক্তব্যটা সত্যই দুর্বোধ্য। বিশেষতঃ নাছােড় বান্দা ডাক্তার মহাশয়ের পাল্লায় পড়িয়া ব্যাপারটা এমনই অদ্ভুত হইয়া পড়িয়াছে যে, কাহার সাধ্য আগাগােড়া সঙ্গতি রাখিয়া কংগ্রেসী দলের মনােভাব বুঝিতে পারে? যাহা হােক, এইটুকু বুঝা গেল যে, ডাঃ সান্ন্যাল বর্তমান বিলের বিরােধী, কেননা তাহার দৃঢ়বিশ্বাস, এই বিলের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হইতে বাধ্য। কেন ব্যর্থ হইবে, তাহার কারণও অর্থনীতিক ডাক্তার মহাশয় দিয়াছেন।

যথা-(১) বর্তমান বিলে পাটের মূল্য-নিয়ন্ত্রণের কোন অবস্থা নাই। (২) এই বিলে চাষীদিগকে প্রয়ােজনমত ঋণদানের বা যাহারা পাট ধরিয়া রাখিতে পারে না, তাহাদের নিকট হইতে উপযুক্ত মূল্যে পাট কিনিয়া সরকারী গোলাঘরে মওজুদ রাখিবার কোন কথা বলা হয় নাই।

পাঠকগণ জানেন, বাস্তবের সহিত সংশ্রব রাখা অপেক্ষা যাহারা কল্পনা-রাজ্যে বিচরণ করিয়াই সুখ পান কংগ্রেসী সদস্য ডাঃ নলিনাক্ষ্য সান্যাল তাহাদের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। বর্তমান বিলের সমালােচনায় তাহার সকল তত্ত্বকথা শুনাইয়াছেন, তাহাতেও তাঁহার স্বপ্নবিলাসের পরিচয়ই পাওয়া গিয়াছে। আমাদের পাঠকগণ নিশ্চয়ই জানেন যে, বাংলা সরকারের নিযুক্ত পাট-তদন্ত-কমিটী তাহাদের রিপাের্টে (যাহা আমরা ইতিপূর্বে ধারাবাহিকভাবে আলােচনা করিয়াছি। ডাঃ সান্যালের উত্থাপিত যুক্তিগুলির বিস্তৃত আলােচনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, এই প্রদেশের বর্তমান আর্থিক অবস্থায় স্থানে স্থানে কেবল পরীক্ষামূলকভাবে গােলাঘর স্থাপন ব্যতীত অন্য বিশেষ কিছু করিবার সম্ভাবনা নাই। ব্যক্তিগতভাবে যদিও আমাদের বিশ্বাস, গ্রামে গ্রামে গােলাঘর স্থাপন ব্যতীত দরিদ্র-চাষীগণের পূর্ণকল্যাণের সম্ভাবনা অল্প, তথাপি গবর্ণমেন্টের এই অসামর্থ্যের জন্য, কোন যুক্তিতে কংগ্রেসী দল যে বর্তমান বিলের বিরােধিতা করিতে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া গেলেন, তাহা কিছুই বুঝা গেল না। ডাঃ সান্ন্যালের কথাতেই দেখা যায় যে, পাটের আমদানী ও চাহিদার উপরই মূলতঃ পাটের দর নির্ভর করে। যদি তাই হয়, তবে চাহিদার সহিত সামঞ্জস্য রাখিয়া পাট উৎপন্নের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত করাই তাে বিধেয়। তাহা না করিলে পাটের বাজার কিভাবে নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব হইতে পারে বলিয়া কংগ্রেসী অর্থশাস্ত্রী মহাশয় মনে করেন, তাহা আমরা বুঝিয়া উঠিতে পারিলাম না।

অবশ্য স্বীকার করি, গতবার পাটকলওয়ালারা যে ষড়যন্ত্র করিয়াছিলেন ভবিষ্যতেও তাঁহারা তাহাই করিতে পারেন। যদি করেন, তবে বাংলা সরকারও তখন তাহার উপযুক্ত প্রতিকার ব্যবস্থা নিশ্চয়ই করিতে পারিবেন। এ অবস্থায় ভবিষ্যতের এক অনিশ্চিত আশঙ্কায় বর্তমানে গবর্ণমেন্টের প্রাথমিক অবশ্য কর্তব্যে বাধা দেওয়ার কি সঙ্গত কারণ থাকিতে পারে? ডাঃ সান্ন্যাল হয়তাে বলিবেন, তিনি বিলের মূল নীতির বিরুদ্ধাচারণ করেন নাই। প্রত্যক্ষভাবে এই বিলের মূলনীতির বিরুদ্ধাচারণ করিলে বাংলার জনসাধারণের নিকট মুখরক্ষা হয় না। তাই ডাক্তার মহাশয় সে কাজটা করেন নাই। কিন্তু বর্তমান বিলের আলােচনা স্থগিত রাখিয়া আরও কিছুকাল অপেক্ষা করিয়া ডাঃ সান্ন্যাল প্রমুখ নেতৃবৃন্দের সহযােগিতায় একটী কনফারেন্স ডাকিবার যে সাধু প্রস্তাব বজা মহাশয় করিয়াছেন, তাহাতেই প্রমাণিত হয়, পাট-নিয়ন্ত্রণ-পরিকল্পনা কার্যক্ষেত্রে প্রয়ােগ করিবার বাসনা ইহাদের কতখানি প্রবল মাননীয় কৃষিমন্ত্রী দেখাইয়াছেন যে, আগামী ২৭শে মার্চেই পাট-অর্ডিন্যান্সের মেয়াদ ফুরাইবে। এই সময় মধ্যে যদি বর্তমান বিল আইনে পরিণত না হয়, তবে গবর্ণমেন্টের সমস্ত প্রচেষ্টাই পণ্ড হইয়া যাইবে। এ অবস্থায় বিরােধী দলের অযৌক্তিক পরামর্শে কর্ণপাত না করিয়া বাংলা সরকার অবশ্যই বিজ্ঞােচিত কাৰ্য্য করিয়াছেন।

কিন্তু এই প্রসঙ্গে বাংলা সরকারকে আমরা কয়েকটী অত্যাবশ্যকীয় কথা জানাইয়া দেওয়া কর্তব্যবােধ করিতেছি। বিগত ১৩ই ফেব্রুয়ারীর ‘আজাদে’ আমরা মন্তব্য করিয়াছিলাম যে, এবার রেকর্ড প্রস্তুত কাৰ্য যেভাবে সম্পন্ন হইয়াছে, তাহা মােটেই সন্তোষজনক হয় নাই। এই মন্তব্য প্রকাশিত হইবার পর বাংলার বিভিন্ন স্থান হইতে এ সম্বন্ধে আমরা শতাধিক চিঠি পাইয়াছি। স্থানাভাবে সেগুলি প্রকাশ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হইল না। ঐ সমস্ত চিঠিপত্রে লেখকগণ প্রত্যেকেই অভিযােগ করিয়াছেন যে, তাঁহাদের অঞ্চলে রেকর্ড প্রস্তুত-কাৰ্য্যে নানারূপ ক্রুটী-বিচ্যুতি ঘটিয়াছে। অধিকাংশ সরকারী কর্মচারীর অযোেগ্যতা ও শৈথিল্যই যে এই অবস্থার জন্য দায়ী, তাহাও পত্ৰলেখকগণ বিশেষভাবে জানাইয়াছেন। মােটামুটিভাবে সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে নিম্নলিখিত অভিযােগগুলি উপস্থিত হইয়াছে ?

অধিকাংশ স্থলেই নাকি রেকর্ড প্রস্তুতকারীগণ সরেজমিনে যান নাই। পরন্তু কোন বাজারে বা কোন এক দ্রলােকের বাড়ীতে বসিয়া চৌকিদার প্রভৃতির নিকট হইতে খবর লইয়াই রেকর্ড প্রস্তুত করিয়া ফেলিয়াছেন। ফলে (১) একের জমিতে অন্যের নাম উঠিয়াছে, (২) অনেক চাষীর জমির রেকর্ডই হয় নাই, (৩) অনেকের জমির পরিমাণ রেকর্ডে মারাত্মকরূপে ভুল উঠিয়াছে, (৪) কোন কোন স্থলে ধানের জমিতে পাট লেখা হইয়াছে, আর পাটের জমি একেবারেই বাদ গিয়াছে ইত্যাদি।

এইরূপ ভুল-ত্রুটীপূর্ণ রেকর্ডের উপর নির্ভর করিয়া যে অর্ডিন্যান্স জারী হইয়াছে, তাহাতে যে বহু চাষীর উপর দারুণ অবিচার সংঘটিত হইবে, তাহা সহজেই অনুমেয়। তাহাছাড়া যে সকল চাষী কোন কারণবশতঃ পাটের চাষ করিতে পারে নাই, তাহাদেরও সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা রহিয়াছে। ১৯৩৯ সনের পাট-আবাদী আইন করিয়া অর্ডিন্যান্স প্রচারিত হইয়াছে। এ অবস্থায় এই সকল চাষী যাহাতে সুবিচার পায়, তাহারও একটা ব্যবস্থা করা গবর্ণমেন্টের অবশ্য কর্তব্য হইয়া দাঁড়াইয়াছে। কতঃ কোন এক বৎসরের জমির রেকর্ডের উপর নির্ভর করিলে পাট আবাদ নিয়ন্ত্রণ-পরিকল্পনার নীতিই কতকটা অযৌক্তিক বলিয়া মনে হয়। কোন এক বৎসরের উপর নির্ভর না করিয়া কোন কোন জমিতে পাট সচরাচর আবাদ হইয়া থাকে, তাহার রেকর্ড প্রস্তুত করাই বােধহয় অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।

গত সােমবারের অধিবেশনে মাননীয় মিঃ তমিজ উদ্দীন খান আশ্বাস দিয়াছেন যে, যাহাতে শুদ্ধরূপে রেকর্ড প্রস্তুত হইতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে গবর্ণমেন্ট পুনরায় রেকর্ড প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত করিয়াছেন। ইহা সুখের কথা, সন্দেহ নাই। আশা করি আগামী বার রেকর্ড প্রত্ৰত করিবার সময় আমাদের উল্লেখিত বিষয়গুলির প্রতি গবর্ণমেন্ট যথাসম্ভব সতর্ক দৃষ্টি রাখিবেন।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪০, ১৫ ফান ১৩৪৬, সম্পাদৰম-২য়, পৃষ্ঠা-৪

আবার ট্যাক্স

গত বাজেট অধিবেশনেই বাংলা গবর্ণমেন্টের অর্থসচিব, মিঃ ছােহরাওয়ার্দী বলিয়া রাখিয়াছিলেন যে, সরকারী তহবিলের অবস্থা অত্যন্ত মােচনীয় হইয়া পড়িয়াছে; সুতরাং অদূর ভবিষ্যতেই গবর্ণমেন্ট নূতন কর স্থাপনের ব্যবস্থা করিবেন। বলাবাহুল্য দেশের এই অর্থনৈতিক দুর্দিনে নূতন কর স্থাপনের প্রস্তাব সম্পূর্ণ অযৌক্তিক, ইহা উপলব্ধি করিয়া আমরা তখনই ইহার বিরেধিতা করিয়াছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমাদের এই প্রতিবাদের কোন ফল হয় নাই। গত ৭ই নবেম্বরের কলিকাতা গেজেট খুলিয়াই দেখা গেল যে, মাননীয় অর্থ সচিবের উপরােক্ত কথামত নূতন কর স্থাপনের প্রস্তাব করিয়া বাংলা গবর্ণমেন্ট আইনসভার আগামী অধিবেশনে দুইটী নূতন বিল আনিবার আয়ােজন করিয়াছেন।

প্রথম বিলের প্রস্তাবমত যেসব ব্যবসায়ীর বিক্রীত মালের মূল্য বাৎসরিক কুড়ি হাজার টাকা বা তাহার উপর, সেই সকল ব্যবসায়ীকে বিক্রয়লব্ধ টাকার উপর শতকরা দুই টাকা হারে ট্যাক্স দিতে হইবে। অবশ্য খাদ্যদ্রব্য, বিদ্যুৎ সরবরাহ ইত্যাদি কয়েক শ্ৰেণীর জিনিষ এই প্রস্তাবিত আইনের গণ্ডীর বাহিরে রাখিয়া দেওয়া হইয়াছে।

দ্বিতীয় বিলের প্রস্তাবানুযায়ী খুচরা বিক্রীত পেট্রোলের উপর গ্যালন প্রতি ছয় পয়সা ও পেট্রোল ব্যতীত অন্য প্রকার মােটর স্পিরিটের উপর প্রতি গ্যালনে ২ পয়সা হারে ট্যাক্স দিতে হইবে। এইসব বিধান অমান্য করিয়া কোন ব্যবসায়ী ব্যবসা চালাইলে তাহা আইনতঃ দণ্ডনীয় হইবে।

উপরােক্ত বিল দুইটীর উদ্দেশ্য বর্ণনা করিতে গিয়া মাননীয় অর্থসচিব বলিয়াছেন যে, বর্তমানে গবর্ণমেন্টের আর্থিক অবস্থা এমনই শােচনীয় যে, নূতন কর ধার্য্য না করিলে এই প্রদেশের গঠনমূলক কাৰ্য ব্যাহত হইবে। দৃষ্টান্ত দিয়া তিনি ইহাও দেখাইয়াছেন যে, ১৯৩১-৩২ সন হইতে ১৯৩৭-৩৮ সন পর্যন্ত বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় বাের্ড ফান্ড হইতে বৎসরে যে টাকা পাইয়াছিল উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাবে তাহার বাজেট হয় নাই। কাজেই বাংলাদেশের খাদ্যে এ বাবদ যথেষ্ট টাকা জমিয়া গিয়াছিল কিন্তু ১৯৩৮-৩৯ সন হইতে বাংলা গবর্ণমেন্ট রাস্তাঘাট নির্মাণের দিকে এরূপ নজর দিয়াছেন যে, আগামী ১৯৪২ সন মধ্যেই বাংলার পাওনা টাকা সব নিঃশেষিত হইয়া যাইবে। কাজেই যদি বৎসরে অন্ততঃ পক্ষে ১২ লক্ষ টাকা এ প্রদেশের রাজস্ব হইতে না পাওয়া যায়, তবে গবর্ণমেন্টকে বাধ্য হইয়াই নূতন পরিকল্পনার অনেক কিছু পরিত্যাগ করিতে হইবে। মাননীয় অর্থ সচিবের এই সকল মন্তব্য হইতে স্পষ্টই দেখা যায় যে, এই প্রদেশের সাধারণ শাসন সম্পর্কিত ব্যয় নির্বাহের জন্য এই নূতন ট্যাক্স ধার্য করণের আয়ােজন হইতেছে না। পক্ষান্তরে প্রস্তাবিত আইন দুইটী কাৰ্য্যকরী হইলে গবর্ণমেন্টের তহবিলে সে বাবদ যে টাকা আসিবে, তাহা জাতি গঠনমূলক কাৰ্য্যেই ব্যয়িত হইবে। কাজেই ট্যাক্স স্থাপনের মূলগত উদ্দেশ্য যে মহৎ, সে বিষয়ে কাহারও কোন সন্দেহ থাকিবার কথা নয়।

কিন্তু উদ্দেশ্য সাধু হইলেও বর্তমানে কোনক্রমেই এই নূতন কর স্থাপনের প্রস্তাব সমর্থন করা যায় না। প্রথমতঃ, যুদ্ধের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে অতিরিক্ত খরচ করিতে হইতেছে এবং তাহার জন্য ভারত গবর্ণমেন্ট চিনির উপর অতিরিক্ত ট্যাক্স বসাইয়াছেন। রেল গাড়ীর ভাড়া বৃদ্ধি করিয়াছেন, চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম, টেলিফোন ইত্যাদির চা বাড়াইয়াছেন, আয়করের উপরও একহাত লইয়াছেন। এইভাবে যখন ট্যাক্স বৃদ্ধি পাইতেছে, ঠিক তখনই আবার নিত্যব্যবহার্য জিনিষপত্রও উত্তরােত্তর দুমূল্য হইতেছে। সর্বোপরি, পাটের দাম নামিয়া একেবারে নিম্নতম পৰ্য্যায়ে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। আমাদের সমালােচনার উত্তরে কয়েকদিন পূর্বে বাংলা গবর্ণমেন্টের তরফ হইতে পাটের বাজারের অবস্থা বর্ণনা করিয়া যে আশ্বাসপূর্ণ বাণী প্রচারিত হইয়াছিল, বাংলার চাষীরা তাহাদের বাস্তব জীবনে তাহা হইতে কোন সান্ত্বনা পাইয়াছে কি না, তাহা আমরা জানি না। তবে বিভিন্ন সূত্রে আমরা এ পর্যন্ত যে সকল সংবাদ পাইতেছি, তাহাতে পরিষদ বুঝা যাইতেছে যে, বাংলার পল্লীতে অচিরেই এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির উদ্ভব হইবে অধিকাংশ স্থলেই পাটের বিকিকিনি একদম বন্ধ। আর যেখানে কিছু কিছু কেনাবেচা আছে, সেখানেও চাষীরা দুই তিন টাকার বেশী দাম পাইতেছে না। ফড়িয়াদের নিকট হইতে কলওয়ালাদের এজেন্টগণ বটম, মিডল প্রভৃতি শ্ৰেণী ভাগ করিয়া যে দামে কোন কোন কেন্দ্রে পাট কিনিতেছে, সেই দামের ফিরিস্তি দেখাইয়া দেশবাসীকে সান্ত্বনা দিলে কোন লাভ নাই। কেননা, দেশের লােক জানে, চাষীদের পাট বেচিতে হইতেছে এর চাইতে অনেক কম দামে। যাই হােক, এস্থলে এ-সম্বন্ধে আর বেশী কিছু বলিতে চাই না। বাঙ্গলা গবর্ণমেন্টকে শুধু এই পর্যন্তই বলিয়া রাখিতেছি যে, তাঁহারা বাঙ্গলার এক ভয়ঙ্কর দুঃসময়ে এই নূতন ট্যাক্স বসাইবার পরিকল্পনায় হাত দিয়াছেন।

তাহা ছাড়া বিলগুলির বিরুদ্ধেও অনেক কিছু বলিবার আছে। একটু লক্ষ্য করিলেই পাঠকগণ দেখিতে পাইবেন যে, সাধারণতঃ ব্যবসায়-বাণিজ্যের উপর যে নীতিতে কর ধার্য হইয়া থাকে, প্রস্তাবিত বিলে ঠিক তেমনভাবে হইবে না। বিলাতের যুদ্ধের জন্য অতিরিক্ত কর স্থাপনের ব্যবস্থা হইয়াছে। আমরা যতদূর জানি, যুদ্ধের জন্য যাহারা অতিরিক্ত লাভ করিবে, গবর্ণমেন্ট রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য সবই কাড়িয়া লইবেন। স্থিরভাবে চিন্তা করিলে এর মধ্যে মুক্তি পাওয়া যাইবে। কিন্তু বাংলা গৱৰ্ণমেন্টের প্রস্তাবে লাভ লােকসানের সহিত ট্যাক্সের কোন সম্বন্ধ নাই। ব্যবসায়ীর লাভ হােক বা সে জাহান্নামেই যাউক, বাংলা গবর্ণমেন্ট তাহা দেখিবেন না। তাহারা একটি মাত্র বিষয়ই দেখিবেন; সেটী হইতেছে বৎসরে ট্যাক্সদাতা কুড়ি হাজার টাকার মাল বিক্রয় করে কিনা- শুধু এই পর্যন্তই। সারা বৎসরে কুড়ি হাজার টাকার কারবার যে ব্যবসায়ী করে, সে যে বড় ব্যবসায়ী নয়, তাহা বলাই বাহুল্য। এরূপ ব্যবসায়ীকে যদি প্রস্তাবিত আইনে বসরে চারিশত টাকা করিয়া নূতন ট্যাক্স দিতে হয়, তবে কয়টী ব্যবসায়ী এই দুর্দিনে আত্মরক্ষা করিতে পারিবে, সে কথা বাংলা গবর্ণমেন্ট একবার ভাবিয়া দেখিয়াছেন?

বর্তমান যুদ্ধের সময় একশ্রেণীর ব্যবসায়ী হয়তাে লাভবান হইতেছে। কিন্তু অধিকাংশ ব্যবসায়ের অবস্থায়ই যে অতীব শশাচনীয়, একথা কি গবর্ণমেন্টের জানা নাই? বাংলার ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে আমরা যতদূর অবগত আছি, তাহাতে একথা আমরা দ্বিধাহীনচিত্তেই বলিতে পারি যে, প্রস্তাবিত ‘সেল ট্যাক্স’ বিল আইনে পরিণত হইলে বহু ব্যবসায়ীর উপর গুরুতর অবিচার করা হইবে। এই অবিচারের ফল কেবল যে ব্যবসায়ীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকিবে, তাহা নয়। কারণ কিভাবে নূতন করের চাপ জনসাধারণের ঘাড়ে ঠেলিয়া দিতে হয় ব্যবসায়ীরা সে কৌশলটা ভালমতাে জানে। নূতন ট্যাক্স বসাইবার সঙ্গে সঙ্গেই তাহারা পণ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করিয়া দিবে; ফলে প্রস্তাবিত আইনের গতিকে ব্যবসায়ীদের সহিত জনসাধারণও যে ক্ষত্রিস্ত হইবেন, তাহা বলাই বাহুল্য।

মােটর পেট্রোল ও স্পিরিট যদিও বেশীর ভাগ বড় লােকেরাই ব্যবহার করিয়া থাকেন, তবুও একথা সকলেই জানেন, বাংলা দেশে এমন বহু লােক আছে, যাহারা ট্যাক্সী বা বাসের ব্যবসা করিয়া উদরান্নের সংস্থান করে। যুদ্ধের ফলে ইতিপূর্বেই পেট্রোল ও স্পিরিটের দাম অনেক বৃদ্ধি পাইয়াছে, তাহার উপর এখন যদি বাংলা গবর্ণমেন্ট এই দুইটি দ্রব্যের উপর নূতন করিয়া ট্যাক্স বসান, তবে দরিদ্র ট্যাক্সী ও বাসওয়ালাদের ব্যবসা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ফলে ব্যবসায়ীগণ যাত্রীদের ঘাড়েই নিজেদের কতকটা বােঝা চাপাইবার চেষ্টা করিবে। এইভাবে তলাইয়া দেখিতে গেলে দেখা যাইবে যে, উপরােক্ত বিল দুইটী কাৰ্য্যক্ষেত্রে প্রযুক্ত হইলে শুধু বাংলার ব্যবসায় বাণিজ্য নয়, দরিদ্র জনসাধারণও বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবেন।

অবশ্য গবর্ণমেন্টের যদি চরম দুর্দশা উপস্থিত হইত, তবে জনসাধারণের অসুবিধা সত্ত্বেও হইত, তবে জনসাধারণের অসুবিধা সত্ত্বেও না হয় আমরা কোনমতে নূতন কর ধার্যের প্রস্তাব সমর্থন করিতাম। কিন্তু রাস্তাঘাট বানাইবার পরিকল্পনা দুই এক বৎসর আংশিক স্থগিত রাখিলেও চলিতে পারে। এ অবস্থায় ১৯৩১-৩২ সন হইতে ১৯৩৭-৩৮ সন পৰ্য্যন্ত চুপ করিয়া বসিয়া থাকিয়া এখন রাস্তাঘাট বানাইবার জন্য একেবারে দিশাহারা হইয়া যাইবার কোন প্রয়ােজন আমরা দেখি না। সরকারী কর্মচারীদের বাৎসরিক শেলবিহার, অতিমাত্রায় ট্রাভেলিং এলাউয়েন্স গ্রহণ, অত্যধিক বেতনপ্রাপ্তি ইত্যাদির উপর যদি গবর্ণমেন্ট হস্তক্ষেপ করেন, তবে তাে অনায়াসেই বহু টাকা বাচিতে পারে। সেসব দিকে দৃষ্টি না দিয়া এই দারুণ দুর্দিনে নূতন ট্যাক্স বসাইতে গেলে জনসাধারণ যে ঘাের আপত্তি করিবে, তাহা আর আশ্চর্য কি?

১২ নভেম্বর ১৯৪০, ২৬ কার্তিক ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-১, পৃষ্ঠা

সামাজিক ===

সরকারী চাকুরী ও মুছলমান

সরকারী চাকুরীতে মুছলমানেরা যে যথােচিত সুবিচার পায় না, একথা প্রায় সৰ্বজনবিদিত বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। এই অনাচারের অভিযােগ আজ নূতন কিছুই নয়, বহু বৎসর ধরিয়া এই অভিযােগ উত্থাপিত হইয়াছে। ইহার প্রতিকারের জন্য যে সমস্ত বাদ-প্রতিবাদ, আলােচনা ও আন্দোলন হইয়া গিয়াছে, তাহা আমাদের শাসনতান্ত্রিক ইতিহাসের একটি বিপুল ও বিচিত্র অধ্যায়। এ সব প্রচেষ্টার ফলেই চাকুরীতে শতকরা তেত্রিশ, পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ প্রভৃতি বাটোয়ারার জন্ম সম্ভবপর হইয়াছে।

কিন্তু এই সব করার ফলেও যে আসল অবস্থার তেমন কিছু সুস্পষ্ট উন্নতি সাধিত হয় নাই, তাহাও সকলেই অবগত আছেন। বর্তমান বাংলা গৱৰ্ণমেন্ট এ জন্য অনেক কিছু করিয়াছেন, সরকারী চাকুরীতে পঞ্চাশের সংখ্যানুপাত বাধিয়া দেওয়া হইয়াছে, মুছলমান পদপ্রার্থীদের প্রবেশ পথ সুপ্রশস্ত করার উদ্দেশ্যে অপরাপর কিছুটা ব্যবস্থাও সত্যতা প্রায় প্রত্যহই সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইতেছে। বিভিন্ন সরকারী বিভাগে মুছলমান নিয়ােগের ব্যাপারে যে সব অবিচার হইতেছে, আজাদের পাঠকবর্গও তাহা অবগত আছেন। আমরা সম্পাদকীয় মন্তব্যেও এসব অভিযাগের সমালােচনা করিয়াছি। আমাদের আলােচনার প্রতিক্রিয়া যে কর্তৃপক্ষের তৎপরতার বহুক্ষেত্রে প্রতিফলিত হইতে দেখা গিয়াছে, তাহাও সকলে জানেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে মুছলমান পদপ্রার্থীর অসুবিধা সম্পর্কে গবর্ণমেন্ট সচেতন হইলেও অবস্থার কোন সত্যিকার ও প্রকৃত উন্নতি সাধিত হয় নাই। নিয়ােগের ব্যাপারে প্রকাশ্য আইনের নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও অনেক হলে সরকারী বা বিভাগীয় দৃষ্টির ফাটল পথে এখনও পূর্ববৎ দুর্নীতি এবং অনাচারের স্রোত প্রবাহিত হইতেছে। একটী দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক।

গত ১১ই এপ্রিল তারিখে ‘এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেলের অফিসে মুছলমান’ শীর্ষক একটি পত্র আজাদে প্রকাশিত হয়। অফিসে ইতিপূর্বে ৪টি কেরাণীর পদ খালি হইয়াছিল, উহাতে ৩ জন বর্ণহিন্দু ও ৫ জন মুছলমান সওয়া হইয়াছে। বর্তমানে ৪টি স্থায়ী পদ ও ৮টি অস্থায়ী পদ খালি আছে।

স্থায়ী পদ ৪টিতে বর্ণহিন্দু লইবার ও অস্থায়ী পদে ৪ জন মাত্র মুছলমান, ৩ জন তফসিলী ও একজন মুছলমান লওয়ার চেষ্টা চলিতেছে ইত্যাদি।

আজাদে আলােচনার ফলে এ-ব্যাপারে বাংলা সরকারের দৃষ্টি উত্তর অভিযােগের প্রতি আকৃষ্ট হয়। সরকারী প্রচার বিভাগ একটি বিবৃতি প্রচার করিয়া প্রকৃত ঘটনার উপর আলােক সম্পাত করার চেষ্টা করিয়াছেন। গত ৭ই আগষ্ট তারিখে এই বিবৃতি আমরা আজাদে প্রকাশ করিয়াছি। ইহাতে জানা যায় যে, এডমিনিস্ট্রেটর জেনারেল ও অফিসিয়াল ট্রাস্টি অফিসে ১২ জন কেরাণী গ্রহণ করা হইবে। গবর্ণমেন্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১২টি পদের মধ্যে ৫টি মুছলমান, ৩টি তফশীলভুক্ত জাতি ও ৪টি বর্ণহিন্দুদিগকে প্রদান করা হইবে। ইহাতে মুছলমানদের যে সংখ্যা-লাঘবতা ঘটিবে, তাহা পরবর্তী যে চারিটি পদ শূন্য হইবে, উহাতে তিনজন মুছলমান গ্রহণ করিয়া পূরণ করা হইবে।” ইত্যাদি।

প্রচার বিভাগের এই বিবৃতিতেই মুছলমান পদপ্রার্থীর অভিযােগের স্বীকৃতি মিলিতেছে। পূর্বে যে ৪টি পদের ৩টিতে বর্ণহিন্দু নিয়ােগের অভিযােগ ছিল, তাহার কথা আমরা না-ই তুলিলাম; কিন্তু এবারকার ১২টি পদের বেলায় মাত্র ৫ জন মুছলমান গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গবর্ণমেন্ট কোন্ যুক্তিতে করিলেন। কোন্ নীতি অনুসারে মুছলমান কর্মচারীর সংখ্যাল্পতা পূরণের দাবী এমনভাবে ভবিষ্যতের শিকার ঝুলাইয়া রাখা হইল? শতকরা পঞ্চাশের ঘােষণার মর্যাদা কি গবর্ণমেন্ট এইভাবে রক্ষা করিতে চান? ন্যায়সঙ্গতভাবেই বাংলার বঞ্চিত মুছলমান আজ গবর্ণমেন্টের নিকট ইহার সদুত্তর দাবী করিতেছে।

নীতি ও আচরণের এই শ্রেণীর অসঙ্গতির অভিযোেগ বাংলা গবর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে আমরা অসংখ্য উত্থাপন করিতে পারি। সরকারী বিবৃতিতেও কয়েকবার পরােক্ষভাবে একথা কর্তৃপক্ষ স্বীকার করিয়াছেন। কিন্তু অভিযােগ স্বীকার ও সুবিচার এক কথা নয়। বাংলার মুছলমান আজ ইহার প্রতিকার চায় ।

পুঁথিপত্রের শতকরা পঞ্চাশের দোহাই বহু ক্ষেত্রে কর্তৃত্বাধিকারী ও শক্তিসম্পন্ন কর্মচারীদের সাম্প্রদায়িক কারচুপি, স্বজনপ্রীতি ও অন্যায় দুর্নীতির চড়ায় ঠেকিয়া বানচাল হইতেছে। এরূপ অবস্থায় সরকারী নিয়মানুগত্যের শিথিলতা মােটেই শােভন ও সঙ্গত হইতে পারে না। আমরা আজ বাংলা গবর্ণমেন্টকে সকল প্রকার দুর্বলতা ঝাড়িয়া ফেলিয়া মুছলমানের প্রতি বিরােধিতা নীতির মর্যাদা সর্বত্র সকল বিভাগে অক্ষুন্ন রাখার জন্য সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাইতেছি।

১১ আগস্ট ১৯৪০, ২৬ শ্রাবণ ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

বেকার-সমস্যা

মিঃ নলিনীরঞ্জন সরকার সম্প্রতি প্রেসিডেন্সী কলেজে ‘বেকার-সমস্যা সম্বন্ধে যে বক্তৃতা দিয়াছেন, তাহার সারাংশ আমরা বিশেষ মনােযােগের সহিত পাঠ করিলাম। নলিনীবাবুর কথায় সাধারণতঃ বাস্তবতার ছাপ থাকে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাস্তব পরিকল্পনা উপস্থিত করিবারও প্রায়ই একটা সাধু প্রচেষ্টা থাকে। তাই আগ্রহ সহকারে তাহার বক্তৃতাটী পাঠ করিয়াছিলাম- ভাবিয়াছিলাম যে, এই জটিল সমস্যা সম্পর্কে নলিনীবাবু এমন কিছু বলিবেন, যাহাতে একটুখানি নূতন আলােকের সন্ধান পাওয়া যাইবে। কিন্তু দুঃখের সহিত আমাদের বলিতে হইতেছে যে, এ-ক্ষেত্রে নলিনীবাবু মাত্র কয়েকটি অতি সাধারণ কথাই একটু সাহিত্যিক রূপ দিয়া বলিবার চেষ্টা করিয়াছেন- ফলে, বাস্তবতার সহিত সংস্পর্শ ছিন্ন অধ্যাপকগণের বক্তৃতা সাধারণতঃ যে শ্ৰেণীর হইয়া থাকে, নলিনী বাবুর বক্তৃতা কোন দিক দিয়াই তাহার চাইতে উন্নত ধরণের হয় নাই।

তবে একথা আমরা বলিতে চাই না যে, নিছক রচনার দিক দিয়া নলিনী বাবুর বক্তৃতা খারাপ হইয়াছে। তিনি বেকার-সমস্যার যে সকল কারণ নির্দেশ করিয়াছেন, তাহার সব কয়টীই সত্য। দেশে উপযুক্তরূপ কলকারখানার অভাব, সামাজিক বাধাবিঘ্ন, অবাঞ্ছিত শিক্ষা-পদ্ধতি, এ সমস্তই যে দিন দিন বেকারের সংখ্যা বাড়াইয়া চলিয়াছে, তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই। নলিনীবাবু শিল্পবাণিজ্য, চাষাবাদ ইত্যাদির উন্নতিবিধানের আবশ্যকতা ও বর্তমান শিক্ষাপদ্ধতির আমূল সংস্কারের প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধে যে উক্তিগুলি করিয়াছেন, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সেগুলিও নির্বিবাদে সকলেই মানিয়া লইবেন। তাহার কারণ, বাংলাদেশে এমন লােক খুব কমই আছেন, যাহারা এই কথাগুলিই অন্ততঃ শতেকবার করিয়া এ জীবনে না শুনিয়াছেন, এবং বিনা আপত্তিতে গ্রহণ না করিয়াছেন।

বেকার-সমস্যার আলােচনার বড় প্রশ্নই হইল কি উপায়ে, কি পদ্ধতিতে আমরা ইহার একটা সমাধানে পৌছতে পারি। মিঃ সরকার অবশ্য বলিয়াছেন যে, প্রথমতঃ সরকারী ও বে-সরকারী প্রচেষ্টার মারফত আমাদের দেশীয় শিল্পের উন্নতি করিতে হইবে এবং সুনিয়ন্ত্রিত শিক্ষাপ্রণালীর সাহায্যে আমাদের যুবকগণকে বৈষয়িক শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া তুলিতে হইবে। আমরা স্বীকার করি যদি মিঃ সরকারের কথামত কাজ হয়, তবে বেকার-সমস্যার বর্তমান তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পাইতে পারে। কিন্তু এস্থলে প্রশ্ন উঠে বর্তমানে অবস্থার দেশীয় শিল্পের আশানুরূপ উন্নতি সম্ভব হইবে কিরূপে? যে বন্ধন বেষ্টনীর মধ্যে আমাদের সমাজ-জীবন অগ্রসর হইতেছে, তাহাতে বেকার-সমস্যার সমাধানের উপযুক্ত শিল্পোন্নতির আশা করা কি দুরাশা মাত্র নয়? মিঃ সরকার এক সময়ে বাংলার অর্থসচিবের দায়িত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। বাংলার গবর্ণমেন্টের আর্থিক সম্বল কতটুকু, একথা তাঁহার অবশ্যই জানা আছে। তিনি কি আশা করেন যে, এ প্রদেশের শিল্পোন্নতির সাহায্যে বেকার-সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় সাফল্যলাভ করিবার ক্ষমতা বাংলা গৱৰ্ণমেন্টের আছে? অবশ্য একটা কথা বলিয়া তিনি দায়মুক্ত হইতে চাহিয়াছেন যে, আস্তে আস্তে সবই হইতে পারে। আস্তে আস্তে যেমন শিল্পবাণিজ্যের উন্নতি হইবে, তেমনি আস্তে আস্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও তাে বাড়িবে। স্বদেশী যুগের পর এদেশে কি শিল্প বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার হয় নাই। কিন্তু তাই বলিয়া বেকারের সংখ্যা কি তাহার অবশ্যই জানা আছে। তিনি কি আশা করেন যে, এ প্রদেশের শিল্পোন্নতির সাহায্যে বেকার-সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টায় সাফল্যলাভ করিবার ক্ষমতা বাংলা গবর্ণমেন্টের আছে। অবশ্য একটা কথা বলিয়া তিনি দায়মুক্ত হইতে চাহিয়াছেন যে, আস্তে আস্তে সবই হইতে পারে। আস্তে আস্তে যেমন শিল্প-বাণিজ্যের উন্নতি হইবে, তেমনি আস্তে আস্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও তাে বাড়িবে। স্বদেশী যুগের পর এদেশে কি শিল্প বাণিজ্যের যথেষ্ট প্রসার হয় নাই? কিন্তু তাই বলিয়া বেকারের সংখ্যা কি করিয়াছে? কাজেই আস্তে আস্তে সবই হইয়া যাইবে, এ ভরসায় আমরা খুব আশান্বিত হইতে পারিতেছি না।

গ্রামে গ্রামে হাসপাতাল স্থাপন শিক্ষা কেন্দ্রের বিস্তার সমবায় আন্দোলনের প্রসার ইত্যাদির উপর মিঃ সরকার যতটা ভরসা করিতেছেন, আমরা কিন্তু সেখানেও ততটা ভরসা করিবার সাহস পাই নাই। কারণ এ সমস্তই বহু দূরের ব্যাপার। বুঝা যাইতেছে যে, অপরাপর দেশের উদাহরণ এদেশে একেবারেই অচল।

তারপর যদি ধরিয়াই লওয়া যায় যে, একটা কোন অভাবিতপূর্ব ম্যাজিকের সাহায্যে এই রাষ্ট্রিক অবস্থার মধ্যেই আমাদের বহুসংখ্যক কলকারখানা ইত্যাদি স্থাপন সম্ভব, তাহাতেই যে বেকার-সমস্যার আশানুরূপ সমাধান কিরূপে হইবে বলিয়া মিঃ সরকার মনে করিলেন, তাহা ঠিক বুঝা গেল না। জার্মানী ও আমেরিকার কথা মিঃ সরকার উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু তিনি এ জায়গায় ভুলিয়া গিয়াছেন যে, অন্যান্য সুবিধা ছাড়াও এই দুইটী দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চলিতেছে সমস্ত পৃথিবী জুড়িয়া তাহাতেও কুলাইতেছে না- পরম্ভ যুদ্ধ-গ্রিহের প্রয়ােজন লাগিয়াই আছে। এ অবস্থায় আমেরিকা ও জার্মানীর দৃষ্টান্ত ধুইয়া জল খাইলে যে ভারতবর্ষের কি সুবিধাটা হইবে, তাহা আমরা অনুধাবন করিয়া উঠিতে পারিলাম না। মিঃ সরকারের বক্তব্যের প্রধান কটীই হইতেছে এই যে, তিনি বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে অব্যাহত রাখিয়াই এক অসাধ্য সাধনের কল্পনা করিয়াছেন। ইংল্যান্ডে যাহা সম্ভব হয় নাই, আমেরিকায় যাহা সম্ভব হয় নাই, ভারতবর্ষেও বর্তমান সময়ে তাহা কদাচ সম্ভব হইবে না।

১২ ডিসেম্বর ১৯৪০, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৩৪৭, সম্পাদকীয়-২, পৃষ্ঠা-৪

বিবিধ প্রসঙ্গ

আগামী ৪ঠা জানুয়ারী ভারত-কেশরী মওলানা মােহাম্মদ আলীর ৯ম মৃত্যুবার্ষিকী। মৃত্যুর মতাে তার অমােঘ বাণী ঃ “স্বাধীনতার সারাংশ না লইয়া, পরাধীন ভারতে আমি আর ফিরিয়া যাইব না।” – এখনও ভারতবাসীর কর্ণপটহে ঝঙ্কৃত হইতেছে। সত্যই সে বীর পরাধীন ভারতে আর ফিরিয়া আসেন নাই, কিন্তু তার মৃত্যুঞ্জয়ী বাণী এখনাে সাগরপার হইতে ভারবাসীর দুয়ারে ভাসিয়া আসে। কিন্তু সে অগ্নিবাণী যে ভারতবাসীর হৃদয়ে দাহিকা-শক্তি সৃষ্টি করিতে পারে নাই, তার বাস্তব প্রমাণ, ভারতবর্ষ এখনাে পরাধীন হইয়া রহিয়াছে। ভেদ-বিভেদে জর্জরিত, সঙ্কীর্ণতা একদেশ-দর্শিতার হীনতায় অতুলনীয় এদেশের পক্ষে কবে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভবপর হইবে, তার কোনাে চিহ্নও আপাততঃ দেখা যাইতেছে না। আমীরে মিল্লাত মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্না এই ভেদবিভেদের মধ্যেও আমার আলাে জ্বালিতে চেষ্টা করিতেছেন বটে, কিন্তু এমন সময়ে কর্মবীর মােহাম্মদ আলীর মতাে পুরুষ-সিংহের অভাব যে কীরূপ চরমভাবে অনুভূত হইতেছে, তাহা সত্যই অবর্ণনীয়। বস্তুতঃ এখন চাই মওলানা মােহাম্মদ আলীর একনিষ্ঠ কর্মসাধনা। এই মৃত্যুবার্ষিকী বাসরে ভারতবাসী একান্তভাবে এই কর্মসাধনার দীক্ষা গ্রহণ করুক, ইহাই আমাদের পরম কামনা।

মধ্যপ্রদেশের ভূতপূৰ্ব্ব কংগ্রেসী মন্ত্রী মিঃ ডি,পি, মিশ্র সম্পর্কে মােছলেম নারীহরণের যে অভিযােগ মােছলেম লীগের তরফ হইতে করা হইয়াছে, তৎসম্পর্কে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণসহ মাননীয় মওলবী ফজলুল হক ছাহেব মধ্যপ্রদেশে যাইতেছেন। যাওয়ার আগে তিনি পণ্ডিত জওয়াহেরলালকে তার করিয়া জানাইয়াছিলেন যে, মধ্যপ্রদেশের জনবলপুরে আসিয়া পণ্ডিতজী যদি তার সাথে সাক্ষাৎ করেন তবে মিঃ মিশ্র-সম্পর্কিত অভিযােগ লইয়া তাদের পূর্ধ্ব-বিজ্ঞাপিত তদন্ত-কাৰ্য্য আরম্ভ হইতে পারে। ইতিপূর্বে মােছলেম নির্যাতনের অভিযোেগ সম্পর্কে তদন্তের জন্য পণ্ডিতজী বেজায় আগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন এবং হক ছাহেব আহ্বান করিলেই তিনি আসিয়া তাঁর সাথে তদন্তে যােগ দিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। যথাসময়ে হক ছাহেবের আহ্বান গেল- কিন্তু পণ্ডিতজী তার উপায় কী বলিলেন? না, “প্রয়ােজন বিবেচনা করিলে আপনি আসিয়া এলাহাবাদে আমার সাথে সাক্ষাৎ করিতে পারেন!” অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশী মিশ্র মহাশয়ের অভিযােগের তদন্ত হইবে এলাহাবাদে! ইহা হইতেই পণ্ডিতজী কিরুপ তদন্ত চান, তার স্বরূপ বুঝা যাইতেছে । কিন্তু ভণ্ডামীরও তাে একটা সীমা থাকা চাই। কংগ্রেসী নেতৃত্ব কতটা অন্তঃসারশূন্যতা ও ভণ্ডামীর উপর প্রতিষ্ঠিত, ইহা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

বৃটীশ পার্লামেন্টের শ্রমিক-সদস্য স্যার ষ্ট্যাফোর্ড ক্রিপস সম্প্রতি ভারত ভ্রমণ সমাপ্ত করিয়া ব্ৰহ্মদেশে গিয়াছেন। ভারতে থাকিতে তাহাকে কসী চেলা-চামুণ্ডারা এমনি ভাবেই ঘিরিয়া রাখিতেন যে, কংগ্রেসী আবহাওয়ার বাহিরে যাওয়া তার পক্ষে একরূপ অসাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। কংগ্রেসী নেতাদের দাওয়াতের উপরে দাওয়াত খাইতেই তাকে ব্যাপৃত থাকিতে হইত। এই কংগ্রেসী আওতায় থাকিয়া তার যেসব বিবৃতি প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাতে আমরা কংগ্রেসী নীতি ও কাৰ্য্য-পদ্ধতিরই জয়গান শুনিয়াছি। তখনই আমরা বুঝিয়াছিলাম, কংগ্রেসী বুদ্ধিমানরা কেবল তাঁকে নিজেদের কাহিনীর অমােঘতার কথাই বুঝাইতেছেন- বাইরের কথা সম্বন্ধে তাঁকে ভুল বুঝানাে হইতেছে। তাঁর Pro-কংগ্রেসী উক্তি লইয়া কংগ্রেসী বুদ্ধিমানদের কী লােফালুফিই না আমরা এতদিন প্রত্যক্ষ করিয়াছি! কিন্তু ব্রহ্মদেশে পদার্পণ করিয়া স্যার ষ্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এ কী বলিতেছেন? তিনি তথায় এক যুব-সম্মেলনে বলিয়াছেনঃ “ভারতবর্ষে মুছলমানেরা একটি বিরাট সম্প্রদায়, তাহাদের সংখ্যা ব্রহ্মদেশের অধিবাসী সংখ্যার প্রায় ছয় গুণ। সুতরাং দেখা যায়, হিন্দু মুছলমান উভয়ের সম্মতি না থাকিলে স্বায়ত্তশাসন কখনও কার্যকর হইবে না । আমি আশা করি, সমস্ত পক্ষই এমন যুক্তিযুক্ত মনােভাব প্রদর্শন করিবেন, যাহাতে অচিরে ভারতবর্ষে স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তিত হইতে পারে।” হায়, হায়, কংগ্রেসী ধুরন্ধরদের সব লাঞ্চ, সব ডিনার একেবারে বৃথাই গেল!

‘নাজাত-দিবসের অনুষ্ঠান নিঃসন্ধিগ্ধভাবে কংগ্রেসের সর্বভারতীয় প্রতিনিধিত্বের দাবীকে ধুলিসাৎ করিয়া দিলেও, বােম্বাইর কংগ্রেসী নেতা মিঃ আবদুল্লা ব্রেলভী নাকি ইহাতে একেবারে লজ্জায় মরমে মরিয়া গিয়াছেন এবং দস্তুর মতাে অপমানিত বােধ করিয়াছেন। অত্যন্ত স্বাভাবিক, কারণ ইনি হইতেছেন জাতীয়তাবাদী মুছলমান- অর্থাৎ মুছলমান হিসেবে যাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া গিয়াছে এবং কংগ্রেসী বর্ণহিন্দুদের প্রতিকর্মে ডিটো দিয়া যাওয়া ছাড়া যাদের গত্যন্তর নাই। Inferiority Complex মানুষকে মনের দিকে এমনি দীন করিয়া তােলে! মনের দীনতার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধির দিক দিয়াও ইহারা কিরূপ fool’s paradise (নির্বোধের স্বর্গ)-এর অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছেন, মিঃ ব্রেলভীর আরেকটী উক্তি তার প্রমাণ। তিনি বলিয়াছেন ঃ “কংগ্রেস-লীগ-চুক্তি তাঁহারা (কংগ্রেসীরা) অতি আগ্রহভরে কামনা করেন। কেননা, হিন্দু-মুছলমানে সহযােগিতা ব্যতীত যে ভারতের স্বাধীনতালাভ সম্ভবপর নহে, এ-বিষয়ে তাঁরা “নিঃসন্দেহ”। মিঃ ব্রেলভীর মতাে দ্রলােকেরা এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ” হইলেও কংগ্রেসী বর্ণহিন্দুরা মােটেই তাহা নহেন। তাহারা ইহা এড়াইয়াই চলিবার চেষ্টা করিতেছেন- গান্ধীজী হইতে জওহরলালজী পৰ্য্যন্ত সকলের আধুনিক মনােভাব দেখিয়া তাহা বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নয়। কিন্তু জাতীয়তাবাদী মুছলমানগণ এ-কথা বুঝিবেন না- বুঝিবার তাদের ক্ষমতাই নাই।।

সেদিন হিন্দু মহাসভা সম্মেলনে বক্তারা বাংলার হিন্দু মন্ত্রিদের কঠোর ভাষায় নিন্দা করিয়াছেন দেখিয়া ‘অমৃতবাজার পত্রিকা আনন্দে আটখানা হইয়া পড়িয়াছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দুঃখ ও বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন যে, ঐ বক্তারা মিঃ নলিনীরঞ্জন সরকারের প্রশংসায় একটি শব্দও উচ্চারণ করেন নাই। অপরের পক্ষে না হউক, নলিনীবাবুর পক্ষে ইহা সত্যই বেদনাদায়ক। হিন্দু মহাসভা সম্মেলনের অধিবেশন সম্মুখে রাখিয়া তিনি মন্ত্রীর পদ ত্যাগ করিলেন এবং সাহেবপাড়া ছাড়িয়া হিন্দু-পাড়ার অনুষ্ঠিত হিন্দু সম্মেলনে উপস্থিত হইলেন।

৩ জানুয়ারি ১৩৪০, ১৮ পৌষ ১৩৪৬, সম্পাদকীয়-৩, পৃষ্ঠা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!