You dont have javascript enabled! Please enable it! ১৯৩৭ সালের আজাদ পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

১৯৩৭ সাল

রাজনৈতিক 

কংগ্রেসের আধুনিক রাজনীতি
সহযােগী “কেশরী” লিখিয়াছেন, অল্প কয়েকদিন পূর্বেও কংগ্রেসের সহিত যাহারা প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত নহে, তাহাদিগকে একযােগে কাজ করিবার জন্য পণ্ডিত জহরলাল হইতে ছােটবড় নেতৃবৃন্দ ‘ইউনাইটেড ফ্রন্ট’ এর বাণী শুনাইতেন। সিভিল লিবার্টি ইউনিয়নও সেই আদর্শেই গঠিত। কিন্তু আজ প্রাদেশিক পরিষদগুলিতে সংখ্যাধিক্যে মত্ত হইয়াই কি তাঁহারা স্বাতন্ত্র্য দাবী করিতেছেন? ওয়ার্খা হইতে ফতােয়া দেওয়া হইয়াছে পরিষদে কংগ্রেস দল যেন ওয়ার্কিং কমিটির অনুমতি ব্যতীত কাহারাে সঙ্গে একযােগে কাজের কথা আলােচনা না করেন। বিহার হইতে বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ বলিয়াছেন, কংগ্রেস মন্ত্রিত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত করিলেই তাহারা কোন ক্রমেই অন্য দলের সহিত সহযােগিতায় মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করিতে পারেন না। কাদায় পড়িলে ‘দাদা নহিলে গাধা এ নীতি সাধারণ লােকের শােভা পায়, কংগ্রেসের নহে। যাহারা স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখিয়া কংগ্রেসের আদর্শ ও লক্ষ্যের পরিপুরকরূপে কাজ করিতে চাহে, তাহাদের সহযােগিতা প্রত্যাখ্যান করার দুর্বুদ্ধি ওয়ার্কিং কমিটীকে কে দিল?”

আমরা সহযােগীর সহিত একমত। কংগ্রেসের আধুনিক রাজনীতির ইহাই ধারা। সহযােগীর সন্দেহ ভণ্ডুল করিয়া আমরা তাহাকে আরও বলিয়া দিতে চাই যে, ওয়ার্কিং কমিটীর দুর্বুদ্ধি তাহার নেতাদের অদূরদর্শিতা ও দুশ্চিন্তা-প্রসূত। ওয়ার্কিং কমিটীর উপরােক্ত সিদ্ধান্ত প্রকৃতপক্ষে লীগ সমিতি মিঃ জিন্নার বিবৃতির উত্তর। বিভিন্ন প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন শেষ হওয়ার পর মিঃ জিন্না এক বিবৃতি প্রকাশ করিয়া বলিয়াছেন যে, লীগ অন্যান্য প্রগতিশীল দলের সহিত একযােগে কাজ করিবেন। তাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটী এইভাবে অসহযােগ নীতি ঘােষণা করিয়াছেন। কংগ্রেসের এই নীতির পরিণাম কি হইতে পারে, তাহাই আলােচনা করা যাক।

গত নির্বাচনের পর কংগ্রেসের জয় ও সাফল্য ঘােষণা করিয়া ভারতের আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করিয়া তােলা হইয়াছে। কিন্তু একটু সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়া ইহার বিশ্লেষণ করা হইলে দেখা যাইবে যে, ইহা অনেক অংশে অসার ও ফাঁকা আওয়াজ। প্রথমতঃ বিভিন্ন প্রদেশের ফলাফল বিচার করিয়া দেখা যাক। ভারতবর্ষের তিনটি বড় প্রদেশকে প্রেসিডেন্সী বলা হয়। যথা-বাংলা, বােম্বাই ও মাদ্রাজ। বাংলার প্রাদেশিক পরিষদে কংগ্রেস দলের শক্তি কি তাহা পাঠকগণ উত্তমরূপে অবগত আছেন। বােম্বাই এবং মাদ্রাজেও কংগ্রেস দল অন্য নিরপেক্ষ সংখ্যাগুরু (Absolute majority) নয়। অন্যান্য গবর্ণর শাসিত প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাব, ইউ,পি এবং সি, সি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। শেষােক্ত দুই প্রদেশে কংগ্রেস অন্যনিরপেক্ষভাবে সংখ্যাগুরু হইলেও পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদে কংগ্রেসের কোন স্থান নাই। অন্যান্য ক্ষুদ্র প্রদেশের মধ্যে বিহার ও উড়িষ্যা ব্যতীত কংগ্রেস-দল সম্পূর্ণ অন্য নিরপেক্ষভাব সংখ্যাগুরু, তাহাও জোর করিয়া বলা যায় না।

শ্রেণী ও সম্প্রদায়ের দিক হইতে বিচার করিয়া দেখিলে প্রতিপন্ন হইবে যে, গত নির্বাচনে কংগ্রেসের সাফল্য মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ও উচ্চবর্ণের হিন্দুদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কৃষক ও শ্রমিকদিগের সহিত ইহার বিশেষ কোন সম্বন্ধ নাই। এ সম্পর্কে অন্য কোন যুক্তি-প্রমাণ উপস্থিত না করিয়া কংগ্রেসের গঠিত জন সংশ্রব (Mass Contact) কমিটীর উল্লেখ করিলেই যথেষ্ট হইবে। কংগ্রেস প্রকৃত গণপ্রতিষ্ঠান হইলে এই কমিটীর প্রয়ােজন কি? এক ক্ষুদ্র সীমান্ত প্রদেশকে বাদ দিলে দেখা যাইবে, কোন প্রাদেশিক পরিষদে কংগ্রেস টীকিটে একজন মুছলমানও নির্বাচিত হন নাই। বােম্বাই এবং যুক্ত প্রদেশে যে সকল মুছলমান কংগ্রেসের নামে নির্বাচন প্রার্থী হইয়াছিলেন তাঁহারা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হইয়াছেন। অন্যান্য প্রদেশের কথা জানা না থাকিলেও বাংলার পরিষদে ৩০ জন অবনত শ্রেণীর সদস্যের মধ্যে ৪ জনও কংগ্রেসের টকিটে নির্বাচিত হন নাই। ইহাই গত নির্বাচনে কংগ্রেস সাফল্যের স্বরূপ। এমত অবস্থায় কংগ্রেসের পক্ষে অপর দলের সহযােগীতা বর্জন করার অর্থ এবং অবশ্যম্ভাবী পরিণাম কি, তাহা আজ ভাবিবার বিষয়।

৫ মার্চ ১৯৩৭, ২১ ফাৱন ১৩৪৩, সম্পাদকীয়-২য়, পৃষ্ঠা-৪

মােছলেম লীগ

আগামী ১৭ই ১৮ই ও ১৯শে এপ্রিল তারিখে লক্ষ্ণৌ শহরে নিখিল ভারত মােছলেম লীগের বার্ষিক অধিবেশন হইবে। মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্না সভাপতি নির্বাচিত হইয়াছেন বলিয়া প্রকাশ। ভারতের মােছলেম-রাজনীতি এবার সবিশেষ গুরুত্বসম্পন্ন। কাজেই মােছলেম-ভারতের অবিসম্বাদী নেতা মিঃ জিন্না এবারকার মােছলেম লীগের সভাপতিপদে বরিত হওয়ায় সকলেই খুশী হইবেন বলিয়া আমাদের বিশ্বাস।

মােছলেম-লীগ মােছলেম-ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। তবু ইহার কার্যকারীতা বর্তমানে মােছলেম-ভারতের উপর যেমন ব্যাপকতা লাভ করিয়াছে, এমনটি আর কখনাে হয় নাই। আগেকার মােছলেম-লীগের কার্যকারীতা সাধারণতঃ ভারতের মােছলেম-রাজনীতির প্রকৃতি ও গতি সম্বন্ধে পরামর্শেই সীমাবদ্ধ ছিলকাৰ্য্যকরী, কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রােগ্রাম অবলম্বন করিয়া বাস্তব কাৰ্যক্ষেত্রে সুসম্বন্ধ দল হিসাবে মােছলেম-লীগ ইতিহাসে ভাল করিয়া অবতরণ করে নাই। অর্থাৎ বাস্তব কর্মক্ষেত্রে অবতরণের চাইতে চিন্তার্জাই ছিল তার কর্মাদর্শের বড় কথা। তাই আইনসভার বাহিরে বা ভিতরে বাস্তব কর্মক্ষেত্রে দল হিসাবে মােছলেম-লীগকে দেখা যায় নাই।

শুধু মােছলেম-রাজনীতির গুরুতর পরিস্থিতির সময় এক বৈঠকে সমবেত হইয়া মােছলেম-লীগের সদস্যগণ পরামর্শ ও চিন্তাৰ্চা করিতেন এবং ভারতের মুছলমানদের কর্তব্য নির্দেশ করিতেন। তাই দেখিতে পাই, আইন-সভায় মােছলেম লীগের কোনাে দল নাই- মােছলেম-লীগের সভাপতি মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্না সেখানে ইন্ডিপেন্ডেন্ট দলের নেতা। এইসব কারণে ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ মােছলেম-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হইয়াও মােছলেম-লীগ ভারতের মােছলেম জনসাধারণের মধ্যে প্রতিষ্ঠা অর্জন করিতে পারে নাই; তার প্রতিষ্ঠা ভারতের মােছলেম intelligential-এর উপরই সীমাবদ্ধ ছিল। জনসাধারণের উপর যার প্রতিষ্ঠা নাই, তার জীবনধারা কখনাে উজ্জ্বল, সতেজ, প্রাণবন্ত হইতে পারে না। মােছলেম-লীগের অস্তিত্ব তাই কতটা জীবন্ত অবস্থায়ই ছিল। প্রদেশে প্রদেশে প্রাদেশিক মােছলেম-লীগও স্থাপিত আছে বটে, কিন্তু জন্মপ্রেরণা অভাবে সেগুলির অবস্থা জীবন্ত বলিলেও বাড়াইয়া বলা হয় না।

কিন্তু এবার অবস্থার পরিবর্তন হইয়াছে। নূতন আইন-সভাসমূহের নির্বাচনদ্বন্দ্বে এবার মােছলেম-লীগ নিজস্ব দল হিসাবে প্রার্থী দাঁড় করাইতে মনস্থ করেন এবং সে উদ্দেশ্যে নিখিল-ভারত মােছলেম-লীগ পার্লামেন্টারী-বাের্ড স্থাপিত হয়; প্রদেশে প্রদেশে তার শাখা-বাের্ডও প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই নিৰ্বাচনব্যাপদেশে মােছলেম-লীগের প্রচার এবার দূর পল্লীপ্রান্তের জনসাধারণের মধ্যেও ব্যাপ্ত হইয়াছে। নির্বাচনের ফল মােছলেম-লীগের পক্ষে খুবই আশাজনক হইয়াছে। প্রায় সব প্রদেশের মােছলেম-লীগ সাফল্যমণ্ডিত হইয়াছে। নির্বাচিত মােছলেম-দলগুলির মধ্যে প্রায় সর্বত্রই মােছলেমলীগের সদস্যসংখ্যা শীর্ষস্থান অধিকার করিয়াছে। কংগ্রেস যেরূপ ভারতের সর্বত্র হিন্দু দলগুলির মধ্যে অধিক সংখ্যার সদস্য পাঠাইতে সমর্থ হইয়াছে, মােছলেমদলগুলির মধ্যে মােছলেম লীগও তেমনি। ইহা হইতেই সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে, মােছলেম-জনসাধারণের মধ্যে মােছলেম-লীগ ও তার আদর্শের প্রভাব অপরিসীম।

তাই বলিতেছিলাম, নিখিল-ভারত মােছলেম-লীগের এবারকার বার্ষিক অধিবেশন অত্যন্ত গুরুত্বসম্পন্ন। আইন-সভার নির্বাচন-সাফল্যে মােছলেম-লীগের কর্তব্য নিঃশেষে উদযাপিত হইয়াছে, ইহা ভাবিয়া বসিয়া থাকিলে চলিবে না। মােছলেম জনসাধারণের উপর এই যে তার অসাধারণ প্রতিষ্ঠার পরিচয়, ইহাকে অব্যাহত রাখিতে হইলে মােছলেম-লীগের নিয়ম-কানুনের আমুল সংস্কার প্রয়ােজন। মােছলেম-লীগের বর্তমান নিয়মানুসারে ইহাতে জনসাধারণের প্রবেশলাভ সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। ইহাতে জনসাধারণের প্রবেশপথ সহজ করিয়া তুলিতে হইবে। অবিলম্বে তাহা না করিলে মােছলেম-লীগ কখনাে জনসাধারণের প্রতিষ্ঠান হইতে পারিবে না- তাহা চিরদিন মােছলেম intelligential-এর বাহন হইয়াই থাকিবে। ইহার ফলে চিরদিন জীবন্ত অবস্থা হইবে তার ভাগ্যলিপি। ভারতীয় মুছলমানদের যে রাজনৈতিক সংকট বর্তমানে উপস্থিত হইয়াছে, তাহাতে মােছলেম-লীগের ঐরূপ জীবন্ত অবস্থা কোনাে মােছলেমহিতৈষীর কাম্য হইতে পারে না।

তাই জনসাধারণের প্রতিষ্ঠান করিতে হইলে মােছলেম-লীগকে ঢালিয়া সাজিতে হইবে। জনসাধারণকে আকর্ষণ করিতে পারে, এমন আদর্শের কর্মতালিকা ইহাতে গ্রহণ করিতে হইবে। ইহার প্রাদেশিক শাখাগুলিকে পুনর্গঠিত করিয়া জীবন্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিতে হইবে। ইহার প্রাদেশিক শাখাগুলি বর্তমানে কিরূপ হাস্যকররূপে অথৰ্ব্ব, তার একটী দৃষ্টান্ত আমাদের এই সমস্যা দেশের মােছলেম লীগ প্রতিষ্ঠানের দিকে লক্ষ্য করিলেই বুঝিতে পারা যাইবে । দুই তিন বৎসর পর পর দুই একটা বৈঠক আহ্বানেই ইহার কার্যকারীতার পরিসমাপ্তি- তাও আবার কোরাম’ অভাবে অধিকাংশ সময়ে সে সব বৈঠকের অধিবেশনই হইতে পারে না। তাছাড়া এ-সম্বন্ধে সব চাইতে হাস্যকর ব্যাপার হইতেছে এই যে, প্রাদেশিক সমিতির সহিত বাংলার পার্লামেন্টারী বাের্ডের অহি-নকুল সম্বন্ধ। এ আইন-সভার নির্বাচন প্রার্থী মােছলেম-লীগ পার্লামেন্টারী বাের্ডের মনােনীত ব্যক্তিগণ এবার প্রাদেশিক মােছলেম-লীগের অধিকাংশ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির বিরুদ্ধতাই লাভ করিয়াছেন। ইহাদের টান মােছলেম-লীগের প্রার্থীর চাইতেও প্রজা-পার্টির প্রার্থীদের প্রতিই দেখা গিয়াছে বেশী! কাজেই প্রাদেশিক লীগের পুনর্গঠন যে অত্যাবশ্যক হইয়া দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
তাই নিখিল ভারত মােছলেম-লীগের এবারকার বার্ষিক অধিবেশনের উপর গুরু কৰ্ত্তব্যভার অর্পিত রহিয়াছে। আমাদের আশা আছে, ভারতের কুশাগ্রবুদ্ধি, রাজনৈতিক নেতা মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে সে-কৰ্তব্য সুচারুরুপেই উদযাপিত হইতে পারিবে।

লীগ-কংগ্রেসের আপােষ-চেষ্টা

ভারতবর্ষে দুইটী প্রধান সম্প্রদায়ের বাস হিন্দু ও মুছলমান। এই দুইটীর কেহ কাহাকেও উপেক্ষা করিয়া চলিতে পারে না। অন্ততঃ চলা বুদ্ধিসম্মত নয়। দেশকে যারা সত্যিকারভাবে ভালােবাসেন, ভারতবর্ষের মুক্তি যাদের আন্তরিকভাবে কাম্য, তারা হিন্দু মুছলমান সমস্যার প্রতি কখনাে উপেক্ষাশীল হইতে পারেন না হইলে তাঁদের সব রকম চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইতে বাধ্য।
কংগ্রেস সমগ্র ভারতবাসীর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হইলেও, প্রধানতঃ ইহাকে হিন্দু প্রতিষ্ঠান বলিয়া অভিহিত করা চলে এই জন্য যে, ইহার পরিচালকমণ্ডলীতে দু’একজন ব্যতীত সকলেই হিন্দু, আর ইহার কৰ্মধারা বিশেষ করিয়া হিন্দু-স্বার্থের অনুকুল। এই সব কারণে জাতীয় প্রতিষ্ঠান বলিয়া অভিহিত হইলেও মুছলমানরা সমবেতভাবে ইহাতে যােগদানের বিশেষ প্রসা পায় না। পক্ষান্তরে মােছলেম লীগ ভারতীয় মুছলমানদের একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ভারতীয় মুছলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা ইহার মধ্যস্থতায় আত্মপ্রকাশ করে। যাঁহারা সত্যিকারভাবে ভারতের মুক্তিকামী, যাহারা বিশ্বাস করেন যে, হিন্দু-মুছলমান মিলন-সঞ্জাত ইউনাইটেড ফ্রন্টের উপরই ভারতের এই মুক্তি নির্ভরশীল, তাঁহারা কংগ্রেস ও মােছলেম লীগের মধ্যবর্তিতায় ভারতে হিন্দু মুছলমানের মধ্যে স্থায়ী সন্ধির জন্য আগ্রহশীল না হইয়া পারেন না।

ভারতের দূরদর্শী হিন্দু-মুছলমান নেতৃবৃন্দ যে এ সত্য না বুঝিয়াছিলেন তা নয়। তারা এই একান্ত কাম্য সন্ধির জন্য বার বার চেষ্টা করিতেও বিরত হন নাই। অবশেষে ১৯১৬ সালে মন্টফোর্ড সংস্কার প্রবর্তনের প্রাক্কালে লক্ষ্ণৌ নগরীতে এক সাময়িক সন্ধি স্থাপিত হয়- ইহাই লক্ষৌ প্যাক্ট নামে অভিহিত। সাময়িক গরজের জন্য এই সন্ধি হইয়াছিল বলিয়া ইহা বেশীদিন স্থায়িত্বলাভ করিতে পারে নাই। পরে গান্ধীজী প্রমুখ কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ কয়েক বার এই সন্ধি স্থাপনের চেষ্টা করেন। কিন্তু তাদের চেষ্টার মধ্যে বাস্তববাদীর বুদ্ধি যতখানি ছিল, তার চাইতে অনেক বেশী ছিল আদর্শবাদীর স্বাপ্নিকতা। তাই সেগুলি সুফলপ্রসূ ও স্থায়ী হইতে পারে নাই। তবে এই সম্পর্কে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বেঙ্গল-প্যাক্টের উল্লেখ না করিলে অন্যায় হইবে। দেশবন্ধু সত্যিকার বাস্তববাদীর দৃষ্টি দিয়া এই প্যাক্ট রচনা করিয়াছিলেন এবং তাহা তখন বাঙ্গলার হিন্দু-মুছলমান কর্তৃক গৃহীত হইয়াছিল। দেশবন্ধু জীবিত থাকিলে হয়ত এই প্যাক্টের মধ্যবর্তিতায় বাঙ্গলার হিন্দু-মুছলমান-সমস্যা এতদিনে মিটিয়া যাইত। কিন্তু এ দেশের দুর্ভাগ্য, তিনি প্যাক্ট রচনার অল্পদিন পরেই পরলােকগত হইলেন এবং সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর বঙ্গীয় শিষ্য ও অনুচরগণ এই প্যাক্ট বাতিল করিয়া দেন।

তারপরে হিন্দু-মুছলমান সমস্যা-সমাধানের এক বিরাট চেষ্টা হয়, বিগত গােলটেবিল বৈঠকে। কিন্তু তখনাে গান্ধীজীর দুর্বলতার জন্য এবং পণ্ডিত মদনমােহন মালব্য ও কতিপয় বঙ্গীয় হিন্দু প্রতিনিধির বিরুদ্ধতার ফলে সে-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। তখন বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী মিঃ রামজে ম্যাকডােনাল্ড পণ্ডিত মদনমােহন মালব্য প্রভৃতি হিন্দু প্রতিনিধিদের অনুরােধে এবং নূতন শাসন সংস্কার কার্যকরী করার গরজে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ দিতে বাধ্য হন। মালব্যজী প্রমুখ হিন্দু নেতৃবৃন্দ ভাবিয়াছিলেন যে, প্রধান মন্ত্রী তাদের হাতের মানুষ, কাজেই রােয়েদাদ হিন্দু-ভারতের অনুকূলই হইবে, এবং এইজন্যই তারা গান্ধীজীর সালিশী অপেক্ষা প্রধান মন্ত্রীর রােয়েদাদকেই ভাল ভাবিয়া মিঃ ম্যাকডােনাল্ডের শরণাপন্ন হইয়াছিলেন। কিন্তু রােয়েদাদের শর্তাবলী ঘােষিত হইলে দেখা গেল, ভারতীয় ও ইউরােপীয় স্বার্থ সম্পূর্ণরূপে বজায় রাখিয়া প্রধান মন্ত্রী হিন্দু মুছলমান সম্পর্কে চুলচেরা বিচার করিয়া তার রােয়েদাদ দিয়াছেন। ভারতীয় হিন্দুরাবিশেষ করিয়া বাঙ্গলার ও পাঞ্জাবের হিন্দুরা এরূপ আশা করেন নাই। তাঁরা ভাবিয়াছিলেন, এই দুই প্রদেশে সংখ্যাল্প হইয়াও তারা এ যাবৎ যেরূপ অন্যায়ভাবে প্রভুত্ব করিয়া আসিয়াছেন, প্রধানমন্ত্রী তার রােয়েদাদে তাহা বজায় রাখিবেন। সে আশা পূর্ণ না হওয়ায় তারা রােয়েদাদ-বিরােধী হইয়া উঠিলেন। পক্ষান্তরে রােয়েদাদে তাদের সমস্ত দাবী স্বীকৃত না হইলেও মুছলমানগণ মন্দের ভালাে বলিয়া ইহাকে গ্রহণ করার মনােভাব প্রকাশ করিলেন। কারণ ইতিপূৰ্ব্বে হিন্দু-নেতৃবৃন্দের সহিত নানা আলােচনায়ও তাদের যেসব দাবী উহাদের স্বীকৃতি লাভ করিতে পারে নাই সে-সব দাবীর কতকগুলি প্রধান মন্ত্রীর রােয়েদাদে কথঞ্চিত সুবিচার লাভ করিতে পারিয়াছে। তাই মন্দের ভালাে বলিয়া মুছলমানগণ এই রােয়দাদকে গ্রহণ না করিয়া পারিলেন না। কিন্তু ইহার বিরুদ্ধে হিন্দুদের প্রতিবাদ উগ্র হইতে উগ্রতর হইয়া উঠিল।

তবে প্রধানমন্ত্রীর নােয়দাদে এরূপ একটা শর্ত ছিল যে, ভারতের সকল সম্প্রদায় যদি আপােষে একটা সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌছাইতে পারেন, তবে তার রােয়েদাদ সেই মীমাংসা অনুসারে পরিবর্তিত হইতে পারিবে। হিন্দু-ভারত যখন রােয়েদাদের বিরুদ্ধ প্রতিবাদের পর প্রতিবাদ জানাইয়া এই সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী, ভারত সচিব, এমনকি বিশ্বরাষ্ট্রসঙ্ঘের দ্বারস্থ হইয়াও ব্যর্থমনােরথ হইল, উপরন্তু settled factকে unsettled করার হুমকীতেও যখন কোনাে ফল ফলিল না, তখন অগত্যা রােয়েদাদের উপরােক্ত শর্তের দিকে তাদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হইল । ফলে আপােষ চেষ্টা চলিতে লাগিল। পণ্ডিত মালব্য সর্বপ্রথম অগ্রসর হইলেন। এলাহাবাদে তার চেষ্টা ব্যর্থ হইল। এরপর আপােষের জন্য তদানীন্তন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মােছলেম লীগের সভাপতি মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্নার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা চলে। এই সম্পর্কে মিঃ জিন্না যে সব আপােষ শর্ত দিয়াছিলেন, নিম্নে তাহা দেওয়া হইল।

(১) প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচনে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের নির্বাচক সংখ্যা যাহাতে জনসংখ্যার অনুপাত অনুযায়ী হইতে পারে, তজ্জন্য প্রয়ােজন অনুসারে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্নরূপ ভােটাধিকার সাব্যস্ত করিতে হইবে ।

এক এলাকায় একাধিক নিৰ্বাচকমণ্ডলী থাকিতে পারিবে না। (৩) সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদে শিখদিগকে যতগুলি সদস্যপদ দেওয়া হইয়াছে, পাঞ্জাবে শিখ-সম্প্রদায় তাদের ততটি সদস্য পদের জন্য নির্বাচন কেন্দ্র বাছিয়া লইবেন তৎপর হিন্দুরা তাদের নির্বাচন কেন্দ্র ঠিক করিয়া লইবে এবং অবশিষ্ট নির্বাচন কেন্দ্রগুলি মুছলমান সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত হইবে। এংলাে-ইন্ডিয়ান ও দেশীয় খৃষ্টানদের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক সদস্য-পদ এবং বিশেষ নির্বাচন-কেন্দ্রের জন্য রক্ষিত সদস্যপদ বাদ দিয়া উক্ত ব্যবস্থা করিতে হইবে। বাঙ্গলা সম্পর্কে এই ব্যবস্থা হইয়াছে যে, যদি ইউরােপীয় সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত সদস্যপদ হ্রাস করা সম্ভব হয়, তবে তাদের নিকট হইতে যতটা আসন পাওয়া যাইবে, তাহা হিন্দু ও মুছলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টন করা হইবে। সাম্প্রদায়িক রােয়দাদে ইউরােপীয়দের জন্য যতটী সদস্যপদ সংরক্ষিত হইয়াছে, ইউরােপীয় সম্প্রদায় যাহাতে তাহা অপেক্ষা যতদূর সম্ভব কম সদস্যপদ গ্রহণে সম্মত হয়, হিন্দু ও মুছলমান একযােগে তার জন্য চেষ্টা করিবে। তাছাড়া সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদে মুছলমানদের জন্য যতগুলি সদস্যপদ সংরক্ষিত আছে, তাহা (ইউরােপীয়, এংলাে-ইন্ডিয়ান, দেশীয় খৃষ্টান ও বিশেষ নির্বাচন কেন্দ্রের আসন সংখ্যা ব্যতীত) মুছলমান সম্প্রদায়ের নিমিত্তই সংরক্ষিত থাকিবে। অন্যান্য প্রদেশ সম্পর্কে এই ব্যবস্থা হইয়াছে যে, ঐ সকল প্রদেশে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদে মুছলমানদের জন্য যে আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট হইয়াছে, তাহা বিশেষ নির্বাচন কেন্দ্র, ইউরােপীয়ান, এংলাে-ইন্ডিয়ান, দেশীয় খৃষ্টান সম্প্রদায়ের আসন সংখ্যা ব্যতীত মুছলমান সম্প্রদায়ের জন্যই সংরক্ষিত থাকিবে। (৬) এইরূপে সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদে কেন্দ্রীয় পরিষদে মুছলমান সম্প্রদায়কে | যতগুলি আসন প্রদত্ত হইয়াছে, তাহাও তাদের জন্য সংরক্ষিত থাকিবে।

উপরােক্ত শর্তের উপর ভিত্তি করিয়া সমস্ত প্রদেশে এবং কেন্দ্রীয় নির্বাচনে যৌথ নিৰ্বাচন-প্রথা সাব্যস্ত হইল।
এই আপােষ-চেষ্টা পরে ভাঙ্গিয়া যায়। সেই সময়ে এই সম্পর্কে জিন্না-রাজেন্দ্র প্রসাদের এক মিলিত বিবৃতি প্রকাশিত হয়। নিম্নে সেই বিবৃতির সারমর্ম দেওয়া গেল ।

“সমস্ত দলের মনঃপূত হইতে পারে সাম্প্রদায়িক সমস্যার এইরূপ একটী মীমাংসার জন্য আমরা আন্তরিক চেষ্টা করিতেছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, যথাসাধ্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও আমরা সফলকাম হইতে পারিলাম না।” তখন প্রকাশ পাইয়াছিল যে, শ্ৰীযুত রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ বাঙ্গলার হিন্দু নেতাদের বিরুদ্ধতার ফলেই এই আপােষ চেষ্টা থামিয়া যায়।

উপরােক্ত আপােষ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরে হঠাৎ পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সিদ্ধান্ত করিয়া বসে যে, এদেশের রাজনৈতিক প্রগতির পথে হিন্দু মুছলমান সমস্যা মােটেই গুরুত্বপূর্ণ নহে। কাজেই উহা লইয়া মাথা ঘামাইবার প্রয়ােজন নাই। মুছলমানদিগকে বিনা শর্তে আসিয়া কংগ্রেসে যােগদান করিতে হইবে এবং পরিণামে তারা তাই করিবে। মিঃ জিন্না ও তার মােছলেম লীগের প্রভাব মােছলেম সাধারণের উপর বিশেষ কিছুই নাই ইত্যাদি।

মােছলেম ভারত স্তম্ভিত হইল। এমন অবমাননার প্রস্তাব কংগ্রেস সভাপতির মুখ হইতে বাহির হওয়ার ফলে কংগ্রেসে তখনাে যেসব মুছলমান ছিলেন, তাঁহারাও বাহির হইয়া আসিলেন। এর পরে নির্বাচন সংগ্রাম চলিল। তাহাতে দেখা গেল সারা ভারতে কংগ্রেস মনােনীত মুছলমানদের মধ্যে যারা নির্বাচিত হইলেন তাদের সংখ্যা দশজন পূর্ণ হইল না। ইহা হইতেই সকলের বুঝা উচিত ছিল যে, মুছলমানদের উপর কংগ্রেসের প্রভাব কতটুকু আছে। কিন্ত পণ্ডিত জওয়াহেরলাল তবু প্রচার করিতে লাগিলেন যে, মােছলেম লীগের চাইতেও মুছলমানদের উপর কংগ্রেসের প্রভাব বেশী। অবশেষে ঝান্সি-নামিরপুর উপনির্বাচনকে টেষ্ট-কেস বলিয়া ধরা হইল, স্বয়ং পণ্ডিত জওয়াহের লাল, ডাঃ মাহমুদ, মওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং অন্যান্য খ্যাতনামা কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ উক্ত নির্বাচন কেন্দ্রে উপস্থিত হইলেন ও জোর প্রচারকাৰ্য্য চালাইলেন। কিন্তু নির্বাচন শেষে দেখা গেল, কংগ্রেসী প্রার্থী মিঃ শেরওয়ানী প্রায় হাজার ভােটের পার্থক্যে লীগ প্রার্থী মিঃ রফিউদ্দীনের নিকট পরাজিত হইয়াছেন। এবার আর অস্বীকার করার উপায় নাই। মােছলেম জনসাধারণের উপর লীগের প্রভাব এবার স্বীকার করিতেই হইল। জিন্না-জওয়াহেরলাল বিতর্কে জিন্নার জয় সম্বন্ধে আর সন্দেহ করার উপায় রহিল না।।

ইতিমধ্যে কংগ্রেস-সেক্রেটারী মিঃ কৃপালনী আর এক বিতর্কের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। জিন্না-রাজেন্দ্র প্রসাদ আপােষ চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার জন্য চাপাইয়াছিলেন এই বলিয়া যে, কংগ্রেস জিন্নার সব শর্তই মানিয়া লইয়াছিল; তথাপি সে চেষ্টা ব্যর্থ হয় মিঃ জিন্নার জিদের ফলে। তিনি নাকি জিদ করেন যে, পণ্ডিত মদন মােহন মালব্য প্রভৃতি হিন্দুসভার নেতৃবৃন্দ ঐ সব শর্তে রাজী না হইলে আপােষ চেষ্টা ব্যর্থ হইবে। মিঃ কৃপালনীর এই বিবৃতির প্রতিবাদ করেন বাঙ্গলার কয়েকজন কংগ্রেসকর্মী। তারা বলেন যে, শুধু হিন্দু সভা নয়, বাঙ্গলার কংগ্রেসকর্মীরাও তার বিরােধী ছিলেন।

যাহা হউক, অবশেষে বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ ও পণ্ডিত জওয়াহেরলাল উভয়েই বলেন যে, পণ্ডিত মালব্যের হিন্দু সভাই হউক বা বাঙ্গলার কংগ্রেসই হউক, এদের সকলের বিরুদ্ধতা সত্ত্বেও কংগ্রেস সেই আপােষ-চেষ্টা গ্রহণ করিতে পারিত এবং এখনাে তা পারে- সে-ক্ষমতা রাজেন্দ্র বাবু, পণ্ডিতজী এবং নিখিল-ভারত কংগ্রেসের আছে।

পণ্ডিত জওয়াহেরলাল ও বাবু রাজেন্দ্র-প্রসাদের উপরােক্ত বিবৃতির পর বর্তমানে নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে। যুক্ত-প্রদেশের সাতজন লীগ নেতা মিঃ জিন্নার কাছে আবেদন করিয়াছেন, যেন তিনি আবার আপােষ চেষ্টায় অগ্রসর হয়েন।

বাস্তবিক এই নূতন পরিস্থিতি হিন্দু-মুছলমান-সমস্যা সমাধানের দিক দিয়া এক মঙ্গল মুহূর্ত বলিয়া বিবেচিত হইতে পারে। জিন্না-রাজেন্দ্রপ্রসাদ আপােষ-চেষ্টার সময় দেশের অবস্থা এমন ছিল যে, পণ্ডিত মালব্য ও বাঙ্গলার কংগ্রেসকে উপেক্ষা করার উপায় ছিল না; কারণ পণ্ডিত মালব্যের ন্যাশনালিষ্ট দল তখন দেশে বেশ প্রবল, আর বাংলার কংগ্রেস নিখিল ভারত কংগ্রেসের নির্দেশ উপেক্ষা করিয়া তাদের প্রতিনিধি তখন আইন সভায় পাঠাইতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কাজেই সে সময়ে মিঃ জিন্নার উপরােক্ত মনােভাব ঠিকই হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে আর সে অবস্থা নাই; পণ্ডিত মালব্যের ন্যাশনালিষ্ট দল এখন কংগ্রেসের সহিত যােগদান করিয়াছে এবং বাঙ্গলার কংগ্রেসও বর্তমান নিখিল ভারতের আজ্ঞাবাহী হইয়াছে। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের আপোেষ চেষ্টায় ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নাই। তাছাড়া যে পণ্ডিত জওয়াহেরলাল এতদিন হিন্দু-মুছলমান সমস্যার গুরুত্বকেই অস্বীকার করিতেছিলেন, তিনিই এখন আপােষের জন্য আহ্বান করিয়াছেন, ইহা হইতেই বুঝিতে পারা যায় কংগ্রেস এই সমস্যা সমাধানের আবশ্যক তীব্রভাবে বুঝিয়াছে। কাজেই এই সময়কে আপােষ চেষ্টার মঙ্গল মুহূর্ত বলিলে ভুল করা হয় না।

আমরা আশা করি, মিঃ জিন্না তার উপরােক্ত শর্তাবলী লইয়া আপােষ চেষ্টায় অগ্রসর হইবেন। কংগ্রেস যে সে সব মানিয়া লইবেন, তাহা বাবু রাজেন্দ্র প্রসাদ এবং পণ্ডিত জওয়াহেরলালের বিবৃতিতে সুপ্রকাশ। আমরা জানি সে-সব শর্তের বিরােধী লােক বাংলার কংগ্রেসী মহলে যেমন আছেন তেমনি বাংলার লীগ মহলেও থাকিতে পারেন। তবু আমরা বলিতে পারি, সাধারণভাবে বাঙ্গালী মুছলমান উহা স্বীকার করিয়া লইতে দ্বিধা করিবে না ।

২৩ জুলাই ১৯৩৭, ৭শ্রাবণ ১৩৪৪, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত

জাতি-শব্দ বাংলা ভাষায় বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকে। যেমনঃ জাতি ব্রাহ্মণ, জাতি নমশূদ্র, জাতি মুছলমান, গাে-জাতি, মনুষ্য জাতি, হিন্দু জাতি, নারী জাতি, জাতে তােলা, জাত মারা ইত্যাদি।

মােটের উপর, জাতি শব্দের মূল ব্যুৎপত্তি অনুসারে একটা জন্মগত সমস্যার দিক দিয়াই সর্বত্র ইহার ব্যবহার হইয়া আসিয়াছে।
পাশ্চাত্য রাজনীতির সহিত হিন্দু-ভারতের পরিচয় ঘনিষ্ঠ হওয়ার পর হইতে, ইংরাজী নেশন (Nation) শব্দের প্রতিশব্দ হিসাবেও আমাদের রাজনৈতিক পরিভাষায় জাতি শব্দের ব্যবহার বহুল ভাবে আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। যেমন- National Congress, National Mohamadan Association, National dress, National flag, National anthem ona ota 1647 National flag 3 National anthem বা জাতীয় পতাকা ও জাতীয় শুত্র লইয়া একটা নূতন আন্দোলন দুইটী কারণে আমাদের দেশের অবস্থা খুবই প্রচণ্ডতার সহিত প্রকট হইয়া উঠিয়াছে।

কংগ্রেসের চেষ্টা এবং পুরুষদিগের কৃপায়, ভারতের ছয়টি প্রদেশে হিন্দু-রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, ইহা সকলেই অবগত আছেন। এই হিন্দু-রাজের মহিমাকে সম্পূর্ণভাবে জয়যুক্ত করার জন্য সেখানকার কংগ্রেসী মন্ত্রিমণ্ডল নূতন ব্যবস্থা পরিষদগুলির উদ্বোধন করিয়াছেন, বঙ্কিম চন্দ্রের বিখ্যাত বন্দেমাতরম সঙ্গীতের দ্বারা। তাহাদের পরিভাষায় এটা হইতেছে National anthem বা জাতীয় সঙ্গীত। কংগ্রেস নিজের জন্য যে পতাকাটা নির্বাচন করিয়া লইয়াছেন, তাহাকে তাঁহারা নাম দিয়াছেন National flag বা জাতীয় পতাকা। সম্প্রতি কলিকাতার পুলিশ কর্তৃক এই জাতীয় পতাকা লাঞ্ছিত হইয়াছে বলিয়া কংগ্রেস পক্ষ হইতে অভিযােগ উপস্থিত করা হইয়াছে। এই দুই কারণে “জাতীয় পতাকা” ও “জাতীয় সঙ্গীত” লইয়া হিন্দু ও মুছলমান উভয় সমাজের মধ্যে একটা দারুণ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হইয়াছে।

কংগ্রেসের নির্দেশ শিরােধার্য্য করিয়া তাহার প্রবর্তিত পতাকা ও সঙ্গীতকে, ভারতের মুছলমান, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া বরণ করিয়া নিতে পারে নাই। কেন পারে নাই, ন্যায়দর্শী হিন্দু ভ্রাতাদিগের সুবিচার পাওয়ার আশায় তাহার একটা কারণ নিমে অতি সংক্ষেপে নিবেদন করিব। জাতীয় বা National বিশেষণ সম্বন্ধে বিচার করার পূৰ্ব্বে জাতি বা নেশন শব্দের তাৎপৰ্য সম্বন্ধে একটা মােটামুটি ধারণা আমাদিগকে করিয়া লইতে হইবে। পূৰ্বেই বলিয়াছি, আমাদের এই জাতি শব্দটীর ভাব ও তাৎপর্য সম্পূর্ণ বিজাতীয়, ইহা ইংরাজী Nation-এর রাজনৈতিক প্রতিশব্দ মাত্র। কিন্তু পাশ্চাত্য পরিভাষায় নেশন বলিতে যাহা বুঝায়, ভারতের বংশগত, বর্ণগত ভাষাগত এবং ধর্ম ও আচারগত শতবৈষম্যের মধ্যে তাহার পরিকল্পনা যে একেবারে অসাধ্য, প্রত্যেক অভিজ্ঞ ব্যক্তিকেই তাহা স্বীকার করিতে হইবে। সকলেই জানেন, এক রাষ্ট্রের অধিবাসীরা সকলেই যে একই নেশনের অন্তর্ভুক্ত হইবে, তাহার কোন মানে নাই। পাশ্চাত্য পণ্ডিতগণের মতে নেশন বলিতে বুঝাইবে —–the union of a society of inhabitants of the same Country, speaking the same language, governed by the same laws, connected by identity of origin, physical characteristics, and moral dispositions, by community of intrests and sentiments and by a fusion of existences acquired by the laps of centuries.
তাঁহারা বলিতেছেন
“Affinity of race, community of language, of habits, of customs and religion, are the elements which constitute the nation.”

এই উদ্ধৃতাংশ দুইটীর সারমর্ম এই যে, একটা নেশন বা “জাতি” গঠনের জন্য তাহার অবদানগুলির একই দেশের অধিবাসী, একই ভাষাভাষী, একই আইনের দ্বারা শাসিত হওয়া আবশ্যক। তাহাদের মূল উৎপত্তিগত সমতা, দৈহিক ও নৈতিক বৈশিষ্ট্যের সমতা, তাহাদের স্বার্থের সমতা এবং ভাব ও ধর্মের সমতা থাকা চাই।” (১) ন্যায়দর্শী হিন্দু ও মুছলমান মাত্রই স্বীকার করিবেন যে, হিন্দু সমাজের ও মুছলমান। সমাজের মধ্যে এই সব বিষয়ে কোন প্রকার সাম্য বিদ্যমান নাই বরং সত্য কথা এই যে, ইহার প্রায় প্রত্যেকটী বিষয়েই আমাদের দুই সমাজের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য বর্তমান আছে। মুছলমানের ধর্ম হিন্দু ধর্ম হইতে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, মুছলমানের “ব্যক্তিগত আইন হিন্দুর আইন হইতে পৃথক, মুছলমানের সভ্যতা ও ইতিহাস হিন্দু সভ্যতা ও আৰ্য ইতিহাস হইতে একেবারে বিভিন্ন। মুছলমানের পুণ্যানুষ্ঠান হিন্দুর চক্ষে মহাপাতক, হিন্দুর প্রধান ধৰ্মকৰ্ম্ম মুছলমানের দৃষ্টিতে জঘন্যতর ধর্মদ্রোহ। মুছলমান হিন্দুর নিকটে অস্পৃশ্য, তাহার সংস্পর্শ-কলুষিত বাতাসের দু সংস্পর্শেও অন্যের হুকার জল পৰ্য্যন্ত অপবিত্র হইয়া যায়, যান-শৃষ্ট অন্নজল দ্রলােকদের পক্ষে বিষবৎ পরিহার্য।

এ অবস্থায় আমাদের দেশে বিলাতী নেশন-এর কল্পনা করিতে যাওয়াও যে কত বড় ধৃষ্টতার কথা, সত্যাশ্রয়ী হিন্দু মুছলমান মাত্রই তাহা সহজে বুঝতে পারেন। হিন্দু ও মুছলমান হিসাবে আমাদের এই বৈষম্যগুলির কথা ভুলিয়া গেলেও স্বয়ং হিন্দু সমাজের মধ্যে বংশগত, ভাষাগত এবং শাস্ত্রীয় ব্যবস্থাগত বৈষম্য ও ব্যবধান বিদ্যমান আছে, তাহা সত্ত্বেও তাঁহাদের মধ্যে এক নেশনত্বের কল্পনা করা বাস্তব সত্যের দিক দিয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার বলিয়াই মনে হইবে। মােটের উপর কথা এই যে আমাদের পাশ্চাত্য গুরুদিগের ব্যবস্থা অনুসারে নেশন বা জাতির অস্তিত্ব ভারতবর্ষে বিদ্যমান নাই সুতরাং National flag বা National anthem লইয়া নিজেদের মধ্যে কলহের সৃষ্টি করা একটা ব্যর্থ বিড়ম্বনা ব্যতীত আর কিছুই নহে।

২০ আগস্ট ১৯৩৭, ৪ ভাদ্র ১৩৪৪, সম্পাদকীয় ১ম, পৃষ্ঠা-৬

প্রচও চপেটাঘাত।

কংগ্রেস-সভাপতি পণ্ডিত জওয়াহেরলাল প্রকাশ্য সংবাদপত্রে মিঃ জিন্নাকে চ্যালেঞ্জ দিয়া ঝান্সীর উপনির্বাচনে মােছলেম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতা করিয়াছিলেন। সে সময় পণ্ডিতজী স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন যে, এই নির্বাচনে লীগের ও কংগ্রেসের শক্তি পরীক্ষা হইবে। মােছলেম লীগকে উপেক্ষা করিয়াও কংগ্রেস মুছলমান জনসাধারণের সহানুভূতি ও সমর্থন লাভে সমর্থ হইয়াছে, ঝালীর নির্বাচনে তাহারই প্রমাণ নিঃসন্দেহভাবে প্রতিষ্ঠিত হইয়া যাইবে, ইহাই ছিল পণ্ডিতজীর প্রগলভ ঘােষণার সারমর্ম। এই প্রগলভতাকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য কংগ্রেস ঝালী-কেন্দ্রে নিজের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য কেন্দ্রীভূত করিয়াছিলেন, যুক্ত প্রদেশের কংগ্রেসী গভর্ণমেন্টও এই ব্যাপারে চেষ্টার ত্রুটী করেন নাই। কিন্তু তাহা সত্ত্বেও কংগ্রেসকে তাহার নিজের ঘােষিত এই প্রথম সগ্রামে লীগ প্রার্থীর নিকট শােচনীয়ভাবে পরাজিত হইতে হয়।

ইহার পর বিজনৌর কেন্দ্রে কংগ্রেসী মন্ত্রী হাফেজ মােহাম্মদ এবরাহিম সাহেবের অভিনব নির্বাচন। হাফেজ ছাহেব এক মাস মন্ত্রী থাকিয়া নিজের তােড়জোড় সব ঠিক করিয়া লইয়া নূতন নির্বাচনের জন্য সদস্যপদে এস্তেফা দেন, মন্ত্রীর পদে বহাল থাকিয়া অথচ মুছলমান সমাজ তাহার কাৰ্য্যের নিন্দা করিয়াছিল মন্ত্রী হিসাবে, মেম্বর হিসাবে নহে। এই নির্বাচন ব্যাপারে গভর্ণমেন্টের গােচরে হউক আর অগােচরে হউক, স্থানীয় পুলিস ও আমলাতন্ত্র লীগ প্রার্থীর ও তাহার কর্মীবৃন্দের উপর যেসব অবিচার অনাচার অবিরামভাবে অনুষ্ঠিত করিয়া চলিয়াছিলেন, আজাদের পাঠকগণ তাহা যথাসময়ে অবগত হইয়াছেন। এই সব সরকারী অবিচার-অনাচারের ফলে কংগ্রেসী মন্ত্রী হাফেজ এবরাহিম লীগ প্রার্থীকে পরাজিত করিতে সমর্থ হন। হাফেজ ছাহেবের এই বিজয়কে যে কোন মতেই কংগ্রেসের বিজয় বলিয়া উল্লেখ করা যাইতে পারে না, বহু নিরপেক্ষ হিন্দু সংবাদপত্র পর্যন্তও তাহা স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা হইলেও কংগ্রেস মহলে এই তথাকথিত বিজয় লাভের ফলে যে অসংযত ও অসঙ্গত আন্দোলনের অভিনয় আরম্ভ হইয়া গিয়াছিল, তাহা দেখিয়া ভদ্রলােক মাত্ৰকেই লজ্জিত হইতে হইয়াছিল। কংগ্রেসী নৈয়ায়িক ও দার্শনিকবর্গ এবং তাহাদের সাংবাদিক মল্পিনাথের দল তখন দেশবাসীকে বুঝাইতে চাহিয়াছিলেন মুছলমান সমাজ মােছলেম লীগকে জানে না, মিঃ জিন্নাকে মানে না। কংগ্রেসের হুজুরে তাহারা সকলে বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করিয়াছে। এমনকি, যুক্ত প্রদেশের মন্ত্রীর এই বিজয়কে বিভিন্ন কংগ্রেসী সংবাদপত্র বড় বড় অক্ষরে মিঃ জিন্নার গণ্ডে প্রচণ্ড চপেটাঘাত” বলিয়া উল্লেখ করিতেও এক বিন্দু লজ্জা অনুভব করেন নাই। সে যাহা হউক, এই “বিজয় লাভের পর কংগ্রেস কর্তৃক সদম্ভে ঘােষণা করেন, যুক্ত প্রদেশের মােছলেম কেন্দ্রের বাকী তিনটা উপনির্বাচনেও তাহারা লীগ প্রার্থীর প্রতিযােগিতা করিয়া নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তির প্রমাণ প্রদান করিবেন। লীগের বিরুদ্ধে এই সগ্রাম ঘােষণার পর যুক্ত প্রদেশের কংগ্রেসী সরকার, স্থানীয় ও ভারতীয় কংগ্রেস তাহাদের বিপুল ধনভাণ্ডার ও বিরাট শক্তি সামর্থ্য লইয়া কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হন।

এই সময় যুক্তপ্রদেশের নির্বাচন-কেন্দ্রগুলি কংগ্রেস-সৈনিকদিগের সদর্প কুচকাওয়াজে প্রকম্পিত হইয়া উঠিতে লাগিল। বিন্নি প্রদেশ হইতে আসিয়া জুটিলেন কংগ্রেসী মওলানার দল, ধর্মের নামে মুছলমান ভােটারদিগকে সম্মােহিত করার উদ্দেশ্যে সীমান্ত প্রদেশ হইতে আমদানী করা হইয়া থান আবদুল গফুর খার লালকোর্তার দলকে। অবিরত রণ-দামামা বাজাইয়া নির্বাচন-কেন্দ্রগুলিকে তাহারা ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত করিয়া তুলিলেন। সংবাদপত্রে প্রচারণা প্রতারণারও কোন অভাব ছিল না। এদিকে, লীগ-প্রার্থীদের না ছিল লােক বল, না ছিল অর্থ বল। একমাত্র আল্লার উপর ভরসা ও মুছলমানের ঈমানের উপর আস্থা করিয়া তাহারা কংগ্রেসের এই বিরাট শক্তিসমারােহের মােকাবেলায় প্রবৃত্ত হইলেন, কাৰ্যতঃ ব্যক্তিগতভাবে।

আল্লার হাজার হাজার শােকর, তাঁহার দেওয়া শক্তি বলে মুছলমানের ঈমান আজ কংগ্রেসের বিপুল ধনভাণ্ডার ও বিরাট উদ্যোগ আয়ােজনকে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করিয়া সগৌরবে জয়যুক্ত হইয়াছে, প্রত্যেক প্রতিযােগিতায়ই কংগ্রেসকে লীগ প্রার্থীর নিকট শােচনীয়ভাবে পরাজিত হইতে হইয়াছে। এমনকি, একটী কেন্দ্রে কংগ্রেসপ্রার্থীর জামিনের টাকা পর্যাপ্ত বাজেয়াফত হইয়া গিয়াছে বলিয়াও সংবাদ আসিয়াছে। এই আনন্দের দিনে আমরা যুক্তপ্রদেশের মুছলমান ভ্রাতাদিগকে বাংলা ও আসামের মুসলমান সমাজের পক্ষ হইতে আন্তরিক অভিনন্দন ও মােবারকবাদ জ্ঞাপন করিতেছি। কংগ্রেসের সমর-আহ্বানকে মােছলেম-উচিত সৎসাহসের সহিত গ্রহণ করিয়া, এই ঈমানের পরীক্ষায় জাতীয় ইতিহাসের গৌরবকে অক্ষুন্ন রাখিয়া এবং মুছলমানের ঈমানকে এছলাম-বৈরদিগের সমস্ত শক্তি সামর্থ্য ও দুই প্রতিভার উপর চরম সাফল্যের সহিত জয়যুক্ত করিয়া আজ তাঁহারা নিঃসন্দেহরূপে সপ্রমাণ করিয়া দিয়াছেন যে, ব্যক্তি হিসাবে মুছলমান আজ যতই দুর্দশাগ্রস্ত হউক না কেন, জাতির হিসাবে আজও সে অপরাজেয়, অন্যের নির্দেষে আত্মসমর্পণ করিতে অনিচ্ছুক। মােছলেম লীগের মধ্যবর্তিতায় মিঃ মােহাম্মদ আলী জিন্না জাতির স্তরে স্তরে যে নব চেতনা ও নবশক্তির সঞ্চার করার চেষ্টা পাইতেছেন, আজও তাহা প্রাথমিক অবস্থা অতিক্রম করিতে পারে নাই। সমগ্র জাতির সমবেত সাধনায় ও সহযােগে এই প্রচেষ্টা তখন আশানুরূপ সাফল্য লাভ করিতে সমর্থ হইবে এবং সে শুভদিনও সমাগতপ্রায় তখন মােছলেম ভারতের পরিপন্থী রাজনীতিকরাই সন্ধির প্রস্তাব লইয়া অগ্রসর হইবেন, ভারতের সমস্ত রাজনৈতিক সমস্যা চরম সমাধান সম্ভবপর হইবে একমাত্র তখনই। আর শিবা-রাজ্য প্রতিষ্ঠার সাম্প্রদায়িক স্বপ্নবিলাসীর দল তখনই বুঝিতে পারিবেন যে, নয় কোটী মুছলমান ভারতের উড়তী বালাই নহে। তাহারা ভারতবর্ষকে স্বদেশ বলিয়া-মাতৃভূমি বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে মাতৃভূমির মঙ্গল ও মুক্তির জন্য তাহারা নিজেদের যথাসর্বস্বকে দান করিতেও প্রস্তুত আছে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাহারা চায়, স্বতন্ত্র শিক্ষা, ভাব, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের বাহকরূপে একটা স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে নিজেদের সমস্ত সঙ্গত স্বত্ত্বাধিকারকে এই মাতৃভূমির বুকে সবলে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিতে। এজন্য মােছলেম জাতি সমগ্রভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। ডাক্তার মুঞ্জে যদি শিবাজী-রাজ্য প্রতিষ্ঠায় অগ্রসর হন এবং তাহাই যদি হিন্দু ভারতের আদর্শরূপে গৃহীত হয়, তাহা হইলে এই অপকর্মের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া তাহাদের পক্ষেও বিশেষ প্রীতিকর বলিয়া প্রতিপন্ন হইবে না।

| আশ্চর্যের বিষয়, আজ আমরা সেই সব কংগ্রেসী দার্শনিকের কোনই সংবাদ পাইতেছি না, বিজন্যেরের তথাকথিত বিজয় গর্বে আত্মহারা হইয়া শত কণ্ঠের কল কল নিনাদ করালে’ যাহারা ঘােষণা করিয়াছিলেন, কংগ্রেসের দরগাহে মােছলেম ভারতের আত্মসমর্পণের ছলনা বাণী? কোথায় আজ আমাদের সেই সাংবাদিক বন্ধুর দল, বিজনৌর-বিজয়ের আত্মপ্রবঞ্চনায় সম্মােহিত হইয়া যাহারা প্রচার করিয়াছিলেনমিঃ জিন্নার গণ্ডে প্রচণ্ড চপেটাঘাতের অদ্র বাণী? পর পর এই চারিটী পরাজয়ের দার্শনিকতত্ব সম্বন্ধে তাঁহাদের চিরচঞ্চল লৌহচঞ্চু লেখনী আজ এমন শােচনীয়ভাবে নিস্পন্দ হইয়া পড়িল কেন? মােছলেম আপ্যায়নে চিরমুখর ও সদাপ্রখর সবল কণ্ঠগুলি মুকতার দৈন্যে হঠাৎ এমন করুণভাবে আড়ষ্ট হইয়া পড়িল কি কারণে? কোথায় সেই পণ্ডিত নেহরু, নির্বাচন প্রতিযােগিতার অব্যবহিত পূর্বে, মিঃ জিন্নার আপােষ-নিম্পত্তির প্রস্তাবের উত্তরে, যিনি নিজের স্বাভাবিক দদুষ্ট ভাষায় ঘােষণা করিয়াছিলেন“মুছলমান বলিয়া কোন স্বতন্ত্র দলের অস্তিত্বকে সুতরাং মােছলেম লীগকে আমরা স্বীকার করি না, বৃটীশ ও কংগ্রেস ব্যতীত ভারতে অন্য কোন দলের অস্তিত্ব নাই। আগামী নির্বাচন প্রতিযােগিতায় দুনয়া এই সত্যের বাস্তব প্রমাণ দেখিতে সমর্থ হইবে।” তিনি কি আজও স্বীকার করিতে কুণ্ঠিত হইবেন যে, ভারতে নিশ্চয় আর একটি দলের অস্তিত্ব আছে এবং তাহা হইতেছে মােছলেম জাতি, কংগ্রেস-বিজয়ী মােছলেম লীগ যাহার প্রতিনিধিত্ব দাবী করিয়া থাকে? কংগ্রেসের রাজয়-সংবাদগুলি সংবাদপত্রে স্থান না দিয়াই দুনয়ার চক্ষে ধুলি নিক্ষেপ সম্ভব হইবে আজও কি তাহারা এই আশায় বুক বাঁধিয়া আছেন?

২৪ ডিসেম্বর ১৯৩৭, ৯ পৌষ ১৩৪৪, সম্পাদকীয়-১ম, পৃষ্ঠা-৪

অর্থনৈতিক

আগামী বাজেট ও চতুৰ্বাষিক পরিকল্পনা প্রকাশ, আগামী ৭ই ফেব্রুয়ারী হইতে বঙ্গীয় ব্যবস্থা পরিষদের বাজেট অধিবেশন আরম্ভ হইবে এবং ১৯৩৮-৩৯ খৃষ্টাব্দের সরকারী বাজেট ১৬ই ফেব্রুয়ারী তারিখে উপস্থিত করা হইবে। গত বৎসরের বাজেটে কোনও বিশেষজ্ঞ ছিল না, প্রকৃতপক্ষে নূতন মন্ত্রীসভা, পুরাতন শাসনতন্ত্রের একজিকিউটিভ মেম্বার স্যার জন উডহেডের বাজেট উপস্থাপিত করিয়াছিলেন। বহু বত্সর ঘাটতির পর গত বারের বাজেটে ৩৪ লক্ষ টাকার মত উদবৃত্ত হইবে, আশা করা হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাইতেছে, নানা কারণে এই উদবৃত্তের পরিমাণ অনেক বেশী হইবে। ভারত সরকারের আয়কর ও রেলবিভাগের আয় বৃদ্ধির ফলে প্রদেশ হিসাবে বাংলা প্রায় ৩০ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত পাইবে। সহস্রাধিক রাজবন্দীর মুক্তির ফলে বাংলা সরকারের অনেক টাকা বাচিয়া যাইবে। ইহা ছাড়া বিভাগীয় ব্যয়ের অল্পতার জন্যও কিছু অর্থ থাকিয়া যাইবে।

পাট-শুল্ক বাবদ ভারত-সরকার আশাতিরিক্ত টাকা পাইয়াছেন। বাংলা-সরকার যে পরিমাণ টাকা পাইবেন, মনে করিয়াছিলেন, তাহা অপেক্ষা আরও প্রায় ৪০ লক্ষ টাকা এই যাবৎ বেশী পাইবেন।

সুতরাং দেখা যাইতেছে, প্রায় দেড় কোটী টাকা বাংলা সরকারের হাতে আসিবে এবং এই টাকা কিভাবে ব্যয় হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে এখনই বিশেষ আলােচনা করা কর্তব্য।

বাংলার মতন কৃষিপ্রধান দেশের সরকারী আয়-ব্যয়ের হিসাবে একটী প্রধান মূল সূত্র সর্বদাই মনে রাখিতে হইবে যে, সমগ্র হিসাবের মধ্যে যেন একটি rural bias থাকে- ব্যবস্থা পরিষদের গঠনে যেমন গ্রাম্য প্রতিনিধির আসন সংখ্যা অধিক করা হইয়াছে, খরচের বেলায়ও সেইরূপ অনুপাত রাখিতে হইবে।

বর্তমানে আয়-ব্যয়ের হিসাবে কোনও বিশিষ্ট নীতি অনুসরণ করা হয় না। শাসন বিচার প্রভৃতি বিভাগ চালাইতে যে খরচার প্রয়ােজন, তাহাতেই প্রায় সমস্ত অর্থ শেষ হইয়া যায়। অবশ্য অতিরিক্ত অর্থের সংস্থান না হইলে জাতীয় গঠন বিভাগে ব্যয় করাও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। শুধু ব্যয়-সঙ্কোচের দ্বারাও অধিক অর্থ পাওয়া যাইতে পারে না। এখন যখন দেড় কোটী টাকা হাতে আসিতেছে, বর্তমান সুধীমণ্ডলের কর্তব্য তাঁহাদের অবশিষ্ট কার্যকাল চারি বৎসরের জন্য একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা (Four years plan) গ্রহণ করা।

গ্রাম্য-উন্নতির জন্য ভারত-সরকার গত বৎসর যে ১৮ লক্ষ টাকা দিয়াছিলেন, তাহার ব্যয় যেভাবে করা হইয়াছে, সেভাবে ব্যয় করায় কোনও লাভ নাই। কোনও গ্রামের ফুটবলের মাঠের জন্য কোথাও বা লাইব্রেরীর জন্য কিছু-কিছু টাকা দিলেই জাতীয় সংগঠনের কাজ হইবে না। এমনকি, স্থানে স্থানে দু’চারিটি টিউবওয়েল বা ইদারা খনন অথবা কিছু কিছু কুইনাইন বিতরণ করিলেই প্রকৃত সমস্যার সমাধান হইবে না।

এই মশা আগেও ছিল, গর্ত ডােবার জলে পাতাও পচিত, কিন্তু দেশবাসীর স্বাস্থ্য এমন ছিল যে, তাহাতে রােগ-বালাই হইত না। পেটে ভাত থাকিলে অসুখ কম হয় এবং চিকিৎসার জন্য দৌড়াইতে হয় না। বাংলার জাতীয় সম্পদের ভাগ এখন জাতির সকলে পায় না, অর্থ আসিয়া জনকয়েকের হাতে জমে, সেখান হইতে আর যথেষ্ট পরিমাণে বাহির হয় না। শরীরের সমস্ত রক্ত ফুসফুসে জমা হইয়া আবার সমস্ত শরীরে সঞ্চালিত না হইলে যেমন মানুষ বাঁচে না তেমন জাতির অর্থ কেন্দ্রীভূত হইয়া আবার সমস্ত জাতির মধ্যে সঞ্চালিত না হইলে সে জাতি বাঁচে না। | বাংলার চাষী পাট-ধান উৎপন্ন করিয়া দাম পায় না। জমিদার-মহাজনের পাওনা দিতেই সে সর্বস্বান্ত হয়। খাজনা ও আবওয়াবে ১৮ কোটী টাকা সে দেয়-গবর্ণমেন্ট পান মাত্র পৌনে তিন কোটী। ব্যাংকিং ইন্কয়ারি কমিটির রিপাের্টে প্রকাশ, বাংলার কৃষকের স্থায়ী-অস্থায়ী ঋণ ২০০ কোটী টাকার মত। খাজনা ও সুদের জোড়া-কলসী গলায় বাঁধিয়া বাংলার চাষী ভব-সাগরে সাঁতার দিতে দিতে ডুবিয়া মরে। এইজন্য খাজনা ও ঋণ মওকুফের জন্য গ্রামে গ্রামে কমিটী করা এবং এজন্য যাহাতে কোর্টে না আসিতে হয়, তাহার বন্দোবস্ত করা গবর্ণমেন্টের কর্তব্য। ইহার জন্য আইন সংশােধন ও কমিটি গঠন ও পরিচালনার জন্য যে ব্যয় তাহা সর্বাগ্রে গবর্ণমেন্টকে করিতে হইবে। উৎপন্নের বৃদ্ধি ও চাহিদা থাকা দরকার এবং যাহাতে নিম্নতম মূল্য সাব্যস্ত থাকে, তাহারও চেষ্টা করিতে হইবে। বৈজ্ঞানিক উপায়ে কৃষিকার্যের প্রবর্তন করিতে হইলে মূলধনের প্রয়ােজন। এই মূলধন সরবরাহের বন্দোবস্ত করিতে হইবে। শুধু কোঅপারেটিভ সােসাইটি করিয়া অল্প সুদে টাকা পাইবার বন্দোবস্ত রাখিলে সে টাকা কেবল বিয়ে-সাদি এবং মামলা-মােকদ্দমাতেই নষ্ট হইবে।

জমি সংক্রান্ত আইন রদবদল না হইলেও এক বন্দে বেশী জমি না পাওয়া গেলে বৈজ্ঞানিক চাষ সম্ভব নয়। রাস্তাঘাট ভাল না থাকিলে উৎপন্ন শস্যের ন্যায্য মূল্য পাওয়া অসম্ভব। আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, রােড বাের্ড বলতে যে টাকা পাওযা যায়, তাহা নাকি খরচ করিয়া উঠিতে বর্তমান রাজকর্মচারীরা পারেন নাই।

দেশকে কলকারখানায় ভরিয়া দিলেই বেকার সমস্যার সমাধান হইবে না। বাংলাদেশের কারখানার শ্রমিক, কৃষি শ্রমিকের তুলনায় অতি অল্প এবং অধিকাংশই বাংলার বাহির হইতে আসে। জগতের মধ্যে কারখানা শিল্প যে সমস্ত জাতির অধিক, তাহারাও বেকার-সমস্যার সমাধান করিতে পারে নাই। World economic decression-এর মূল কারণ অত্যধিক উৎপাদন, ইহা মনে রাখিতে হইবে।

সহযােগিতামূলক ভিত্তির উপর যে সমস্ত ব্যবসা প্রতিষ্ঠিত হইতে পারে, আমাদের সেইদিকে মনােযােগ দিতে হইবে। এজন্য প্রত্যেক বাঙালীর আয় বাড়াইবার চেষ্টা করিতে হইবে। অ-বাঙালীর সুন্ঠন হইতে বাঙালীকে রক্ষা করিতে হইবে।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যলাভের পন্থা সুগম না হইলে, বাঙালীর জীবন-সংগ্রামে টেকা দায়। প্রাথমিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রবর্তনের জন্য যে টাকা দরকার, তাহার বন্দোবস্ত যথাসম্ভব গবর্ণমেন্টকে করিতে হইবে। এজন্য প্রজার উপর আর করভার না চাপাইলেই ভাল হয়। প্রত্যেক গ্রামে যাহাতে একটি প্রাইমারী স্কুল থাকে এবং প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা দাতব্য চিকিৎসালয় থাকে, তাহা সৰ্ব্বাগ্রে করিতে হইবে। দাতব্য-চিকিৎসালয়ে কবিরাজী, হাকিমী এবং হােমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রবর্তন করিতে বাধা যেন না থাকে। গ্রামের পুষ্করিণী এবং মরা নদ-নদীর সংস্কার কাৰ্যও একটি প্ল্যান করিয়া ক্রমে ক্রমে সাধন করিতে হইবে। মিহুরে ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলক নীলনদীর জল সেচনে ম্যালেরিয়া দূর করিয়া চাষের সুবন্দোবস্ত ও দেশবাসীর স্বাস্থ্য লাভের উপায় করিয়াছেন। বাংলায় ডাঃ বেন্টলির জলপ্লাবনের দ্বারা ম্যালেরিয়া দূর করার উপায়ও একটি গ্রহণযােগ্য বিষয়।

বাংলার মৎস্য-সম্পদ যাহাতে রক্ষিত হয় ও বৃদ্ধি পায় সেজন্য মন্ত্রী-মণ্ডলী একজন বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত নিজে করিয়াছেন। কিন্তু এ বিষয়ে আইন প্রবর্তন না করিলে কিছুই হইবে না।

১৭ ডিসেম্বর ১৯৩৭, ২পৌষ ১৩৪৪, সম্পাদকীয়-১, পৃষ্ঠা-৪

সাংস্কৃতিক

বাংলা সাহিত্যের রেনো

আধুনিক বাঙ্গলা সাহিত্যের জন্য প্রধানতঃ মাইকেল ও বঙ্কিমচন্দ্র হইতে। কারণ ইহাদের পূর্বে এবং ভারতচন্দ্রের পরে সাহিত্যিক-স্রষ্টা আর কাহাকেও বড় দেখা যায় না।

মাইকেল-বঙ্কিম হইতে রবীন্দ্রনাথ পৰ্যন্ত সাহিত্য-সৃষ্টির যে প্রবল প্রয়াস দেখা যায়, তার সাথে রুশীয় সাহিত্যের টলষ্টয়-টুর্গেনিভ-ডষ্টয়ভী হইতে শেহব পৰ্য্যন্ত সাহিত্য সৃষ্টি ধারার একটা সাদৃশ্য বেশ অনুভূত হয়। এ কথায় কেহ মন করিবেন না, আমরা সৰ্বদিক দিয়াই উভয়ের মধ্যে সাদৃশ্য কল্পনা করিতেছি। নিতান্ত পাগল ব্যতীত তেমন কথা কেহ বলিতে পারে না। আমরা শুধু একটা দিকের সাদৃশ্যের কথাই বলিতেছি। তাহা হইতেছে- সৃষ্টি-প্রয়াসের প্রবলতার দিক। টুর্গেনিভ-টলষ্টডষ্টয়ভীর আবির্ভাবের পূর্বে রুশীয় সাহিত্য নিতান্তই নগণ্য ছিল- পাশ্চাত্যের অন্য যে কোন সাহিত্য রুশ সাহিত্যের চাইতে অনেক গুণে উৎকৃষ্ট ছিল। উপরােক্ত স্রষ্টাত্রয়ী অসাধারণ সৃষ্টি প্রতিভায় এক দিনেই রুশ সাহিত্যকে অপর সকল সাহিত্যের একেবারে শীর্ষস্থানে লইয়া গেলেন। এবং এর যে ধারা আন্তন শেইভ পৰ্য্যন্ত অব্যাহতভাবে বহিয়া চলিল, সৃষ্টি চাতুর্যের দিক দিয়া তার সাথে আর কোন সাহিত্যেরই তুলনা চলে না। সৃষ্টি-প্রয়াসের এই যে প্রবলতা, এর সাথেই শুধু বাঙ্গলা সাহিত্যের মাইকেল-বঙ্কিম হইতে রবীন্দ্রনাথ পৰ্য্যন্ত সৃষ্টি ধারার তুলনার কথা আমরা বলিতেছিলাম। এছাড়া অন্য কোনাে দিক দিয়াই উভয়ের তুলনা করা চলে না। টুর্গেনিভ হইতে শেহভ পৰ্য্যন্ত যে সাহিত্য-সৃষ্টি, তাহা সত্যিকার জাতীয় জীবনী শক্তির দিক দিয়া এমনি শক্তিশালী যে, সমগ্র রাশিয়া উহার অনুপ্রেরণায় নবজীবন লাভ করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছে- শুধু তাই নয় বিশ্বে নূতন ইতিহাস সৃষ্টি করিয়াছে। পক্ষান্তরে উপরােক্ত সময়ের বাঙ্গলা সাহিত্য এদেশকে সৌন্দৰ্যবােধের দিক দিয়া কতকটা সচেতন করিয়াছে বটে, কিন্তু জাতির জীবনে সত্যিকার নবজীবন সঞ্চার করিতে পারে নাই। কারণ এ সাহিত্যে প্যাগানসুলভ সৌন্দৰ্য-পূজারী মনের প্রকাশ যতটা আছে, মুক্তবুদ্ধ বৈজ্ঞানিক মনের বাস্তব প্রকাশ তেমন নাই। শেষােক্ত মন এ-সাহিত্যে সবলতা লইয়া আত্মপ্রকাশ করে নাই বলিয়াই সব গুণ লইয়াও ইহা জাতীয় জীবনে ব্যর্থতাই বহন করিয়া আনিয়াছে মাত্র।

বাঙ্গলার সাহিত্যিক হিন্দুমন প্যাগানধৰ্মী-পূৰ্ব্বসংস্কার (instinct) ইহার স্বভাবগত। এই মনে বুদ্ধি তার বৈজ্ঞানিক বাস্তবতা লইয়া কখনাে জয়ী হইতে পারে নাই- পারিবে কিনা, সে সম্বন্ধেও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বৈজ্ঞানিক সত্যকেও ইহা আপনার সংস্কারের সঙ্গে রাঙাইয়া গ্রহণ করিতে অভ্যস্ত। এমন মনে মুক্ত বুদ্ধির জাগরণ কতটা অসম্ভাবিত ব্যাপার। অন্ততঃ সাহিত্য ক্ষেত্রে এখনাে জাগে নাই। তাই দেখি, বাঙ্গলার জাতীয় জীবনের যে কল্পনা সে করিয়াছে, মুক্ত বুদ্ধির অভাবে, তার স্বাভাবিক প্যাগান-ধৰ্মী ধারণার অনুপ্রেরণায় তাহা হইয়া পড়িয়াছে নিতান্তই একদেশদর্শী- নিজের সঙ্কীর্ণ অচলা রতনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ; শােচনীয় ব্যর্থতা বহন করা ছাড়া তার আর গত্যন্তর নাই।

মুক্তবুদ্ধ, জাতির জীবনে নবজীবন সঞ্চারকারী সাহিত্য-সৃষ্টি কি বাঙ্গলার কখনাে সব হইবে না? যে জীবন্ত সাহিত্য নিপীড়িত-রুশিয়াকে মুক্তির অরুণরাগে রঞ্জিত করিয়াছে, অভিশপ্ত রুশজাতি যে সাহিত্যের সঞ্জীবনীমন্ত্রে জগতে অঘটন ঘটাতে পারিয়াছে, তেমন সাহিত্যের জন্ম কি বাঙ্গলার একেবারেই অসম্ভব? আমাদের কি তাহা মনে হয় না। নজরুল-সাহিত্য মুক্তবুদ্ধ সাহিত্য সৃষ্টি নহে, তবু নব-জীবনের প্রেরণা ইহাতে কতকটা আমরা প্রত্যক্ষ করিয়াছি। এইজন্যই আশা হয়, হয়ত সে সাহিত্যের স্রষ্টা আসিতে বেশী দেরী নাই। তবে সংস্কারের পূজারী প্যাগান-ধৰ্ম্মী হিন্দু সাহিত্যিকদের মধ্যেই তিনি আবির্ভূত হইবেন, এ সম্বন্ধে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

১৫ সেরে ১৯৩৭, ৩০ ভাদ্র ১৩৪৪, সম্পাদকীয়-১, পৃষ্ঠা-৪