You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.19 | একটি নয়া রাষ্ট্রের অভ্যুদয় | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

একটি নয়া রাষ্ট্রের অভ্যুদয়

ইতিহাস একটি নয়া রাষ্ট্রের জন্ম দিল। স্বাধীন বাংলা গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের এই জন্মলগ্ন চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিংশ শতকের শেষার্ধে সারা দুনিয়ার দিকে দিকে যে গণতান্ত্রিক অভ্যুদয়, স্বাধীন বাংলাদেশের আবির্ভাব তারই মধ্যে। মুক্তি পাগল একেকটা জাতির গণতান্ত্রিক চেতনাকে আর পুরনাে শাসন ও শােষণের মধ্যে বন্দি করে রাখা যাচ্ছে না। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে অপরাজেয় শক্তিতে সে আত্মপ্রতিষ্ঠ হচ্ছে। বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ আজ সেই মুক্তিচেতনায় উদ্বুদ্ধ ও আত্মপ্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্প। এই চেতনা তাদের মৃত্যুঞ্জয় করে দিয়েছে, এই দৃঢ় সংকল্প তাদের বজ্র কঠিন করে তুলেছে। বুকের পাঁজর দিয়ে তাঁরা গড়ে তুলেছেন নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র ও তার সরকার। কোনাে বিদেশি শক্তির সহায়তায় নয়, কোনাে পরদেশে নয়, স্বভূমে স্বজাতির মধ্যে দাঁড়িয়ে আপন শক্তিতে জন্ম নিয়েছে এ রাষ্ট্র। তাই এ রাষ্ট্র স্বমহিমায় উজ্জ্বল, স্বগৌরবে গরীয়ান। আত্মপ্রত্যয়ে যার জন্ম সে অমর, অবিনশ্বর।
ইতিহাসের কলঙ্ক নরঘাতক ইয়াহিয়া খান চেয়েছিলেন রক্তের স্রোতে বাংলাদেশকে ভাসিয়ে দিয়ে এই নবজাতকের আবির্ভাব অসম্ভব করতে। কিন্তু তাঁর চেয়ে অনেক বেশি বলদর্পী পাষণ্ডও ব্যর্থ হয়েছে ইতিহাসের গতিরােধে। ইয়াহিয়া খানের মৃঢ়তা শুধু পেয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অখণ্ডতা চূর্ণ করতে। যে গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র গােটা পাকিস্তানেরই নবরূপায়ণ এনে দিতে পারতাে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্ররূপে পাকিস্তানকে বিশ্বের দরবারে যােগ্য মর্যাদার আসনে পৌছে দিতে সক্ষম হতাে, ইয়াহিয়ার অস্ত্রাঘাত তাই অসম্ভব করে দিল। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য দায়ী তিনি। পাকিস্তানকে জবাই করেও কিন্তু তিনি গণতন্ত্রকে কবরে পাঠাতে পারেননি। গণতন্ত্র জন্ম দিয়েছে স্বাধীন বাংলাকে। তবে এ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অনেক রক্ত ঝরছে এবং আরাে ঝরবে। কিন্তু সেই রক্তসিক্ত পথেই গণতন্ত্র এগিয়ে যাবে দুর্বারগতিতে কবর দেবে ইয়াহিয়া খানের জঙ্গি নৃশংসতাকে। রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে স্বাধীন বাংলার ভবিষ্যত। এই রক্তের ধারা একদিন মুছে গিয়ে দেখা দেবে শাসন সবুজ সােনার বাংলা আকাশ-বাতাস মথিত করে ধ্বনিত হবে বাংলার নবজীবনের জয়গান।
চরম বিপদের মধ্যে যার আবির্ভাব সেই শিশু রাষ্ট্রকে বাঁচিয়ে রাখা, বাড়িয়ে তােলা ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেরই অবশ্য কর্তব্য। এতে দ্বিধাগ্রস্ত হবার অর্থ গণতন্ত্রের আদর্শেরই প্রতি সংশয় প্রকাশ করা। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনাে গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে নয়, এ যুদ্ধ গণতন্ত্রের পরম শত্রু জঙ্গিশাহীর বিরুদ্ধে। সুতরাং বাংলাদেশের নবজাত এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি না দেয়া ও সাহায্য না করার অর্থ গণতন্ত্রের আদর্শ থেকে সরে গিয়ে বর্বর জঙ্গিশাহীকেই সমর্থন করা। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি পর্যুদস্ত হলে অন্যত্র তার প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে সদ্য স্বাধীন উন্নয়নশীল দেশগুলােতে জঙ্গিচক্র চাঙ্গা হয়ে চাইবে গণতান্ত্রিক শক্তিকে পিষে মারতে। স্পেনের গৃহযুদ্ধে যেমন চলেছিল গণতান্ত্রিক শক্তি ও ফ্যাসিস্ট শক্তির মধ্য প্রত্যক্ষ লড়াই, বাংলাদেশেও আজ চলেছে তেমনি গণতন্ত্র অপর জঙ্গিবাদের মধ্যে সরাসরি সংগ্রাম। স্পেনের গৃহযুদ্ধে যেমন সেদিন আন্তর্জাতিক বিবেক জেগে উঠেছিল আজ বাংলাদেশের মুক্তিযোেদ্ধাদের আহ্বানেও তেমনি আন্তর্জাতিক বিবেকের সাড়া মেলা উচিত।
বিলম্বে অনর্থ ও ক্ষয়ক্ষতি অনেক হবে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনােবল দৃঢ় হলেও সশস্ত্র সংগ্রামে অস্ত্রবলের কথা অবশ্যই বিবেচ্য। পাকবাহিনী সর্বপ্রকার আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত। তার বিরুদ্ধে প্রায় নরস্ত্র একটা জাতির শুধু মনােবলের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধে জয়লাভ করা তাে দূরস্থান, বেশিদিন প্রতিরােধ চালিয়ে যাওয়াও দুষ্কর। তদুপরি কলকারখানা থেকে শুরু করে ফসলের ক্ষেত পর্যন্ত পাক দস্যুরা যেভাবে ধ্বংস করছে তাতে রসদের সঙ্কটও দেখা দেবে। যুদ্ধাবস্থায় যদি অর্থনৈতিক বিপর্যয় চরমে গিয়ে উপনীত হয় তবে মুক্তিযােদ্ধা ও সাধারণ মানুষের মনােবল ভেঙে যাবে। তেমন বিপদাশঙ্কা আছে বলেই অবিলম্বে এই শিশু রাষ্ট্রকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেয়া দরকার। শুধু নৈতিক সমর্থন যথেষ্ট নয়। আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেবার পথে যে বাধা ছিল তা অপসারিত। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র তার সরকার সক্রিয়। সুতরাং কুটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়ে এখন তাকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করলে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের যুক্তি ধােপে টিকবে না। আক্রান্ত ও বিপন্ন কোনাে বন্ধু রাষ্ট্রকে এভাবে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করা আন্তর্জাতিক কনভেনশনে আটকায় না।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের দায়িত্ব এ সম্বন্ধে সর্বাধিক। সংসদীয় গণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপরই বর্তমান ভারত সরকার প্রতিষ্ঠিত। ইয়াহিয়া খান যুদ্ধ চাপিয়ে দিলেও সংসদীয় গণতান্ত্রিক নির্বাচনে যারা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন তাদের দ্বারাই স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের সরকার গঠিত। এ কোনাে সংখ্যালঘুদলের সরকার নয়। এ সরকার সম্পূর্ণ বৈধ ও গণতান্ত্রিক। সুতরাং এমন একটি বৈধ ও গণতান্ত্রিক সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের বাধা নেই। আন্তর্জাতিক জটিলতা যদি কিছু থেকেও থাকে, এই গণতান্ত্রিক কর্তব্য পালনের পথে তা অন্তরায় হওয়া উচিত নয়। ভারতের মতাে একটি প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চোখের সামনে যদি জঙ্গিশাহীর অস্ত্রাঘাতে আর একটি নবজাত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অপমৃত্যু ঘটে তবে তা হবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। অতএব আর কালবিলম্ব না করে ভারত সরকারের উচিত বাংলাদেশের স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া ও সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য হস্ত প্রসারিত করা।

সূত্র: কালান্তর
১৯.৪.১৯৭১