You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের দু’লাখ অতিথি

সীমান্ত পেরিয়ে দু’লক্ষাধিক মানুষ ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত ভূমিতে পৌঁছেছেন। এই সংখ্যা ক্রমে আরও বাড়বে। এঁরা প্রকৃতই অতিথি। প্রচলিত অর্থের উদ্বাস্তু এঁরা নন। উদ্বাস্তুরা ভারতের পুনর্বাসন চান। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষেরা দুর্যোগের অমানিশার মধ্যে ক্ষণকালের আশ্রয় চাইছেন। তিব্বত ছেড়ে আসা রাজনৈতিক পলাতকদের মতােও এঁরা নন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ওঁরা বাংলাদেশকেই আপন মনে করেন এবং আগুনে পুড়িয়ে-পিটিয়ে নিজেদের স্বাধীন স্বদেশকে গড়বার জন্যই তাঁরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলাদেশ ছেড়ে আসা এই মানুষদের প্রিয়জনরা আজ সীমান্তের ওপারে লড়ছেন। সেই মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই মৃত সৈনিকের স্ত্রী, কিংবা রণাঙ্গণে আহত পঙ্গু, কিংবা বােমায় বিধ্বস্ত পরিবার আমাদের দেশে এসেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিসগ্রামের প্রতি যে ভারতবাসী দ্ব্যর্থহীন সমর্থন ঘােষণা করেছেন, ওঁরা এসেছেন তাদেরই কাছে। ওপার থেকে আগতদের সেবা ও সাহায্যদান ভারতবাসীর সে জন্যই অপরিহার্য কর্তব্য হয়েছে। যতদিন বাংলাদেশের লড়াই চলবে, ততদিন সীমান্তের ওপারের ভাই-বােনদের ভারত সাহায্য দিতে বাধ্য। বাংলাদেশের মুক্তি ও গণতন্ত্রের জন্য মরণজয়ী সংগ্রামের প্রতি ভারতের ভাবাবেগ পূর্ণ সংহতিকে এভাবেই বাস্তব, কার্যকর ও পদ্ধতিগত সংহতিতে রূপান্তরিত করা হবে।
পশ্চিমবাংলার খাদ্য দপ্তরের মন্ত্রী এ রাজ্যে বাংলাদেশের অতিথিদের কথা উল্লেখ করে নয়াদিল্লীর কাছে অধিক খাদ্য বরাদ্দের দাবি করেছেন। এই দাবি স্বাভাবিক এবং ন্যায্য। কিন্তু পশ্চিমবাংলার উপর ন্যস্ত গুরুদায়িত্ব কেন্দ্রের নিকট থেকে কিছু অধিক খাদ্য আদায়ের দ্বারাই হাসিল করা যাবে না। খাদ্য হােক, বস্ত্র হােক, আচ্ছাদন হােক, কিংবা অত্যাবশ্যকীয় যে কোনাে পণ্য হােক তার দর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পশ্চিমবাংলা সরকারকে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। গত দিন সপ্তাহ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যেই পশ্চিমবাংলায় চালের দর যে বেড়েছে তা কিছুতেই একটি কাকতালীয় ঘটনা নয়। বাংলাদেশের একটি সংবাদে প্রকাশ যে, আকাশে ইয়াহিয়া খানের বােমারুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শকুন উড়ছে। মহাভােজের আনন্দে শকুনেরা আত্মহারা। মুনাফালােভী ধনিক-বণিকেরা শকুনেরই সগােত্র। মানুষের সর্বনাশে ওদের পৌষমাস। ভারতবাসীর মহৎ দানকে ভারতের ধনিক-বণিকেরা বিকৃত না করে তার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা ভারত সরকার এবং পশ্চিমবাংলা সরকারের আশু ও অপরিহার্য কর্তব্য।
ঘােলা জলে মৎস্য শিকারের জন্য মাল পাচারকারীরা ওঁৎ পেতে রয়েছে। সীমান্তে চোরাকারবারীদের গতিবিধি দীর্ঘদিনের। আজ বৃহৎ ব্যবসায়ীরাও সীমান্তে জাল ছড়াবে এবং বাংলাদেশের পাট থেকে শুরু করে যাবতীয় ফসল ও পণ্য জলের দরে কেনার অন্য ঘাঁটি বানাবে। বাংলাদেশের বড় শহর ও বন্দরে যতদিন ইয়াহিয়া খানের জঙ্গি শাসন বহাল থাকবে, ততদিন নিজেদের কৃষিপণ্য বিক্রয় ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ক্রয়ের জন্য বাংলাদেশের পল্লীবাসীদের এক বিরাট অংশের কাছে সীমান্তের এপারই হলাে ভরসা। সেই অসহায় চাষিদের মাথায় এ দেশের ব্যবসায়ীরা কাঁঠাল ভাঙতে না পারে তার পূর্ণ দায়িত্ব ভারত সরকার এবং পশ্চিমবাংলা সরকারকে গ্রহণ করতে হবে।
এসব অত্যন্ত বাস্তব অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়ােজনেও অবিলম্বে বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়ােজন। উভয় রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি কায়দায়, পারস্পরিক ব্যবস্থায় এবং গ্রাহ্য বিনিময়-হারে ব্যবসা-বাণিজ্য সংগঠিত না করার অর্থ এই নয় যে, পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনিময় বন্ধ হয়ে থাকবে, তার প্রকৃত অর্থ হলাে এই যে, স্বাভাবিক বাণিজ্যের বদলে অস্বাভাবিক বাণিজ্য খােলা কারবারের বদলে চোরা কারবার সীমান্তে জেঁকে বসবে- আর যার ফলশ্রুতি হলাে দু’রাষ্ট্রেরই বিপুল ক্ষতি। লক্ষ লক্ষ লােক যখন এপার ওপার হচ্ছেন তখন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ভিত্তিতে তার নিয়ম-কানুন নির্ধারণে আর কোনােরূপ বিলম্ব করা যায় না। বিধিবদ্ধ নিয়মের বদলে অবিধিবদ্ধতা এবং অনিশ্চয়তা রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিকর। কেননা, ‘দু’রাষ্ট্রের সীমানা উড়িয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও’ বলে বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষেই ক্ষতিকর রাজনীতি যারা প্রচার করে থাকেন (লক্ষণীয়—ঐরূপ দেয়াল-লিখন যেমন আমরা বাঙালি’ তেমনই ‘সিপিএম এর স্বাক্ষরে রাজপথে দৃষ্ট হয়), এই দুটি রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্কের অনিশ্চয়তা ঐসব বিভেদকামীদেরই সহায়ক হয়। অন্যদিকে অর্থনৈতিক, সামাজিক ক্ষেত্রেও এই অনিশ্চয়তা ক্ষতিকর কেননা, এই ঘােলা অবস্থায় জনগণের শত্রুরা পুঁজিপতি শকুনেরাই- মুনাফা কামায়।

সূত্র: কালান্তর
২০.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!