You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972 | বঙ্গবন্ধুর আমলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলীকরণ আইন ও সিদ্ধান্তসমূহ - সংগ্রামের নোটবুক

বঙ্গবন্ধুর আমলে পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলীকরণ আইন ও সিদ্ধান্তসমূহ

সম্পত্তির দখল সংক্রান্ত অন্যতম প্রধান আইনটি প্রণয়ন করা হয় ১৯৭২ সালের ৩রা জানুয়ারী, এবং পরবর্তীকালে সংবিধানের মাধ্যমে এটিকে রক্ষা করা হয়। এটি ছিলো শিল্প এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানসমূহের ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণ দখল সংক্রান্ত একটি আদেশ। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর অবাঙালী মালিকানার কোটি কোটি টাকা মূল্যের অসংখ্য শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিঠান রেখে মালিকরা পালিয়ে গেলে সেগুলো রক্ষা করার জন্য এই আইন প্রণয়ন করা হয়। এর উদ্দেশ্য ছিলো প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎপাদন অব্যাহত রাখা, যাতে করে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিঘিাত না হয়। ১৯৭২ সালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ১ নং আদেশ (A P 0-1) হিসেবে পরিচিত এই আদেশে বলা হয় যে, যেসমস্ত প্রতিষ্ঠানের মালিক, পরিচালকমণ্ডলী অথবা ব্যবস্থাপকব, কিংবা তাদের অধিকাংশ বাংলাদেশ পরিত্যাগ করেছেন কিংবা প্রতিষ্ঠান চালানাের জন্য উপস্থিত নেই, সরকার সেসমস্ত প্রতিঠানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সরকার এমন সব প্রতি ঠানেরও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারবেন, যেগুলোর মালিক অথবা পরিচালক মণ্ডলী উপস্থিত থাকলেও জনস্বাথে তাদের হাতে পরিচালনাভার ন্যস্ত করা উচিত হবেনা। এতে বলা হয় যে, প্রষ্ঠিানগুলো পরিচালনার জন্য সরকার ব্যবস্থাপনা বোড বা প্রশাসক নিয়োগ করবেন। | এই আদেশে আরাে বলা হয় যে, এসমস্ত প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ভার এবং এগুলাের হিসাবরক্ষণের দায়িত্ব সরকার মনোনীত ব্যবস্থাপকমন্ডলী অথবা প্রশাসকদের হাতে কিংবা অন্যান্য কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত হবে। প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনা গ্রহণের নিয়ম কানুন ও শর্তাবলী নির্ধারণ করবেন সরকার এবং সরকারের চাহিদা মােতাবেক তারা সরকারের কাছে প্রতিষ্ঠান বিষয়ক প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করবেন। | মল আদেশে যে কোন সম্পত্তি দখলের আগে একটি অফিসিয়াল গেজেট নোটিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করা হয়েছিলাে। কিন্তু পরবতীকালে ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির ১৫১ নং আদেশবলে এই নোটিফিকেশনের বিষয়টি প্রত্যাহার করে সম্পত্তি দখলের জন্য সরকারকে অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতদসত্ত্বেও পীডবাড নেভিগেশন কোম্পানীর সঙ্গে সরকারের একটি মামলার রায়ে আদালত থেকে বলা হয় যে, রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১৫১,১৯৭২-এ নোটিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা প্রত্যাহার করা হলেও ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ নং ১, ১৯৭২কে সরকারের একটি সিদ্ধান্ত বলেই গ্রহণ করতে হবে এবং এতে সরকার কোন প্রতিষ্ঠানকে নোটিফিকেশন ছাড়া সম্পত্তি দখলের অনুমতি দিতে পারেন নি।
যাই হােক, আদালতের রায় প্রকাশিত হলেও ইতিমধ্যে উক্ত আইন তার সমস্ত কার্যকরতা হারিয়ে ফেলে এবং পরবর্তীকালে এই আইনকে বাংলাদেশ পরিত্যক্ত সম্পত্তি আদেশ ( নিয়ন্ত্রণ, ব্যবস্থাপনা এবং বিক্রয়) ১৯৭২-এর সঙ্গে সমন্বিত করে নেয়া হয়। এ পি ও-১ যেখানে কেবলমাত্র সম্পত্তি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা দখলে অপার ক্ষমতা দিয়েছিলাে, সেখানে উক্ত আইনে রাষ্ট্রপতির ১৬নং আদেশের (PO 16) পরিধি ছিলাে আরাে বিস্তত, কারণ রাষ্ট্রপতির ১৬নং আদেশের মাধ্যমে শুধ, সম্পত্তির দখল নয়, তার বিয়ের অধিকারও সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। PO 16, 1972 এবং AP0 1, 1972 প্রণয়নের পেছনে যুক্তি ছিলো অভিন্ন। কিন্তু শেষােক্তটিতে সরকারের দখলীস্বত্ব অধিকার আরাে সনিদিষ্ট করে, বিশেষ করে পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলের উপর জোর প্রদান করা হয়। এই আইনের বলে দেশের আইনগত নাগরিকদের সম্পত্তি দখলের জন্য সরকারকে একরকম অসীম ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে। এই আইনের জরুরী এবং আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্যগুলাে ছিলাে নিম্নরুপঃ | (১) এই আইনে যেসমস্ত মালিক ব্যক্তিগতভাবে সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ বা ব্যবস্থাপনার জন্য উপস্থিত ছিলেন না, সেসমস্ত সম্পত্তি দখল করার পরােক্ষ অধিকার সরকারকে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ যেসমস্ত নাগরিক বিদেশে অথবা দেশের অভ্যন্তরে অন্য কোন স্থানে অবস্থান করছিলেন, তারাও সম্পত্তি হারাতে পারতেন। (২) পাকিস্তানী নাগরিকদের মালিকানার যেকোন সম্পত্তিই পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। (৩) এপিও-১, ১৯৭২ মারফত যে কোন দখলীকৃত সম্পত্তিকে বলা হতাে পরিত্যক্ত সম্পত্তি। এই আইনে যেখানে সম্পত্তির নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার উপর সরকারী দখলবত্ব কায়েম হতো, সেখানে পিও ১৬-এর মাধ্যমে সেই সম্পত্তি দখলের সাথে সাথে তার মালিকানা দাবী এবং বিক্রয়ের অধিকারও সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। (৪) পরিত্যক্ত সম্পত্তির দায় সল্পকে আইনে বলা হয় যে, ঋণপ্রদানকারীরা উক্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে যা-ই পাওনা থাকুক না কেন, এ ব্যাপারে তারা সরকারী সিদ্ধান্ত অথবা প্রতিষ্ঠানের দায় সংক্রান্ত সরকারের হিসাবের উপর বিশ্বাস স্থাপন করতে বাধ্য থাকবেন।

(৫) এই আইনের মাধ্যমে সরকার ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর সম্পাদিত সম্পত্তির যে কোন বরাদ, ইজারা বা চুক্তি অযােগ্য বলে বিবেচিত করতে পারতেন। অর্থাৎ আইনবলে যারা প্রকৃতপক্ষে সম্পত্তির বর্তমান মালিক ছিলেন না, তারাও সম্পত্তি সরকারের হাতে অপণ করে চুক্তিকৃত ব্যক্তিদের আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারতেন। অথাৎ এই আইনে সরকারকে এমন ক্ষমতা দেয়া হয়েছিলো, যা কোনদিন সম্পত্তির মল মালিকও ভােগ করেননি। | (৬) এই আইনের ১৪ নং ধারায় বলা হয় যে, সরকারের হাতে দখলীস্বত্ব যাওয়ার পর এই সম্পত্তির জন্য বাজেয়াপ্তকরণ, দেউলিয়া ঘোষণা কিংবা উচ্ছেদের মতাে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া যাবেনা কিংবা আদালত এ ব্যাপারে কোন নিষেধাজ্ঞা জারী করতে পারবেন। আইন জারী হওয়ার পরমহত থেকে এসমস্ত ব্যাপারে প্রচলিত আইনের যে কোন কার্যকরতা রহিত করা হয়।’ | (৭) অবশ্য সরকার ভুলক্রমে কোন সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে থাকলে, ক্ষতিগ্রস্ত লােকদের প্রতিকার বিধানের জন্য এই আইনে কতিপয় বিধান রাখা হয়। এক্ষেত্রে আইন কার্যকর হওয়ার তিনমাসের মধ্যে যথাযােগ্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন পেশ করার সুযােগ দেয়া হয়। এর জন্য নিয়মতান্ত্রিক পহায় একটি সংক্ষিপ্ত তদন্তের ব্যবস্থা থাকে, ও সংক্ষিপ্ত শুনানীর মাধ্যমে তা নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়। এই বিধানে সন্তুষ্ট না থাকলে, কোন ব্যক্তি আইনের ৭ নং ধারাবলে অপর একটি নির্দিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে একমাসের মধ্যে আপীল রজ করতে পারতেন। অবশ্য সরকার আইনের ৭ এবং ১৫ নং ধারাবলে নিজের কোন সিদ্ধান্ত সংশােধনেরও বিধান রাখেন।

শেষতঃ এই আইনে গহীত কোন সিদ্ধান্ত অথবা এর মাধ্যমে পরিচালিত কোন কার্যধারার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য কোন আদালতকে ক্ষমতা প্রদান করা হয়নি, এবং এক্ষেত্রে আদালতের সমস্ত ক্ষমতা রহিত অবস্থায় ছিল। | পিও ১৬র মাধ্যমে শুধুমাত্র পাকিস্তানীদের পরিত্যক্ত সম্পত্তির উপরই নয়, দেশের নাগরিকদের যে কোন সম্পত্তি দখল করার ব্যপারেও সরকারকে অনন্যসাধারণ ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পরিত্যক্ত সম্পত্তির সংজ্ঞাই ছিল বিতর্কিত। সম্পত্তির উপর বিভিন্ন নাগরিকের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মামলা পরিচালনার সময় কমপক্ষে দুজন এ্যটন জেনারেল আমার যক্তির বিরুদ্ধে আদালতকে বােঝাতে চেষ্টা করেছেন যে, যেহেতু সরকার। আইনের মাধ্যমে যে কোন সম্পত্তি দখলের অধিকার পেয়েছেন, সেহেতু সরকারের এই অধিকার পুরোপুরিভাবে আইনসম্মত। সরকারী সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকক বা না থাকক, কোন কোম্পানীর শেয়ার দখল, বোড এবং প্রশাসক নিয়ােগ, আইনগতভাবে ভােগ দখলকারী লােকদের সম্পত্তি হস্তান্তর এবং চুড়ান্তভাবে তাদের সম্পত্তি দখলের পর তা বিক্রি করে দেয়—এ ধরনের যে কোন প্রশ্নে আইনের প্রণীত বিধানগুলাে সবসময়েই আইনসঙ্গত বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা চালানাে হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের হাতে এ ধরনের ক্ষমতা দেয়ার কি যৌক্তিকতা রয়েছে তা কখনাে নিরাপণ করার প্রচেষ্টা চালানাে হয়নি। | যদিও আদেশের ৭, ১৫ এবং ১৬ নং ধারায় সম্পত্তির জন্য মামলা এবং কারণ দর্শাও ইত্যাদির বিধান রাখা হয়েছিলো, তথাপি এগুলো ছিলো পুরােপুরি ভাবে নিক্রিয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত লোককে তা কোনভাবে সাহায্য করতে পারেনি। “নিদিষ্ট কর্তৃপক্ষ তার “নিদিষ্ট নিয়মেই ১৯৭২ সালের জুলাই এবং আগষ্ট মাসে অর্থাৎ আইন জারীর ছয়মাসের মধ্যে আত্মপ্রকাশ করেনি, এবং স্বাভাবিকভাবে ইতিমধ্যেই আইনে প্রদত্ত সময়সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ায় এক শ্রেণীর নাগরিক আর্থসামাজিক জীবনে নিদারুণ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হন। ১৫ নং ধারায় উল্লেখিত আবেদনপত্র পেশ করার বিষয়টি হয়ে পড়ে পুরােপুরিভাবে নিরর্থক এবং নির্দিষ্ট নিয়মে নিদিষ্ট কতৃপক্ষের কাছে আবেদনপত্র পেশ করার প্রসঙ্গই এভাবে অর্থহীন হয়ে পড়ে। যেহেতু এই ধারার অধীনে সুযােগ গ্রহণের বিধানটিই অনেক দেরীতে প্রকাশ করা হয়, সেহেতু আইনের প্রত্যক্ষ বিধান কার্যক্ষেত্রে তার অবদান রাখতে পারেনি। আইনে যে কোন রকম আপত্তি পেশের জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হলেও, এই ধারা প্রকাশ করা হয় অনেক পরে। কাজেই আইনের মধ্যে জনগণের অধিকার রক্ষার যে সামান্যতম নিশ্চয়তা হলেও দেয়। হয়েছিলাে, সেই সুযােগের বাইরে রেখে জনগণকে স্বাভাবিক সুবিচার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিলো বলে দাবী করা যায়। যদি আইনটি প্রণয়নের সময়ই ৭ নং ধারাটির কথা উল্লেখ করা হতো, তাহলে অধিকাংশ মামলা ইতিমধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব হতো। ৮ নং ধারায় উল্লেখিত কোম্পানীসমূহের শেয়ার দখল এবং ১০ নং ধারায় সম্পাদিত চুক্তিকে অবৈধ প্রতিপন্ন করার মতাে বিষয়গুলো নিয়ে অভিযোেগ দায়েরের সুযােগ পর্যন্ত দেয়া হয়নি। এভাবে ৫, ৭, ৮, ১ এবং ১৪ নং ধার পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, এই আইন সরকারকে শধুমাত্র সম্পত্তি দখলের অধিকারীই করেনি, এমনকি সরকারকে মল মালিকের চাইতেও অধিকতর ক্ষমতা প্রদান করেছে। চড়ান্তভাবে, ২৪ নং ধারাবলে এ সমস্ত বিরােধ নিষ্পত্তির জন্য আদালতের এখতিয়ারও খব করা হয়েছে। এই ধারায় পিও ১৬, ১৯৭২-র ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক দখলকৃত যে কোন সম্পত্তির বিরােধ সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য জেলা এবং নিম্ন আদালত সমুহের সমস্ত ক্ষমতা রহিত করে দেয়া হয়। এক্ষেত্রে হাইকোর্ট তাঁর যথাযথ ভূমিকা পালন করেছেন। আইনের মল সত্রগুলো বিচারকেরা পুত্থানপন্থরপে পরীক্ষা করেছেন এবং পিও ১৬-তে ঘোষিত বাংলাদেশের নাগরিক ব্যক্তিগত ভাবে সম্পত্তির দখলে না থাকলে তা সরকার দখল করে নেয়ার বিধান তারা নাকচ করে দিয়েছেন। আদালত এমন বক্তব্য পর্যন্ত উপস্থাপিত করেছেন যে, কেবলমাত্র মালিকের অনুপস্থিতি কোন সম্পত্তি দখলের উপলক্ষ্য হতে পারে না, কারণ এর আগে সরকারের এমন প্রমাণ দেখানো প্রয়োজন যে, সেই নাগরিকের অনুপস্থিতি ছিলো বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী। এ ব্যাপারে আদালতে যতগুলি মামলা দায়ের করা হয়েছে, তার একটি ক্ষেত্রেও সরকার তা প্রমাণ করতে পারেননি। সরকার বনাম পীডবাড নেভিগেশন কোম্পানীর একটি মামলায় ১০ বিচারপতি ভট্টাচার্য বলেছেন, এই আইনের সংজ্ঞার আক্ষরিক ব্যাখ্যা একটি অসম্ভব ফলাফলই প্রকাশ করবে (A literal interpretation of the definition clause will lead to absurd consequences) এবং এর উপর ভিত্তি করে আদালত এই সংজ্ঞার প্রকৃত উৎস নির্ণয়ের প্রচেষ্টা চালান। তাঁদের যথাথই ধারণা ছিলো যে, নিশ্চয়ই এই আইনের প্রণেতার মালিক হিসেবে অনুপস্থিত প্রত্যেকের সম্পত্তিই পরিত্যক্ত বলে ঘােষণা করতে চাননি। অন্য একটি মামলায় বিচারপতি মনীম এমন কথা পর্যন্ত বলেছেন যে, মালিকের অনুপস্থিতিতে যদি মালিকের পরিবারের অন্য কোন সদস্যও উপস্থিত থাকেন, তবুও সেই সম্পত্তিকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা যাবে না।১১ বিচারপতি কামালুদ্দীন হােসেন একটি মামলা শুনানীর সময় বলেছেন, কোন সম্পত্তির উপর মালিকের দখল না থাকলেই তাকে পরিত্যক্ত সম্পত্তি বলা যাবে না।১২ | সুপ্রীম কোর্টের আপীল ডিভিশন, যা দেশের সর্বোচ্চ আদালত, পরিত্যক্ত সম্পত্তি সম্পকিত প্রথম মামলায় পরিত্যক্ত সম্পত্তি শব্দটির সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতা বিষয়ক হাইকোট অথবা হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতিদের বক্তব্য সমর্থন করেছেন। এই জটিলতা নিরসনের জন্য আদালত আইনে উল্লেখিত বিভিন্ন সত্য ও সংজ্ঞাগুলাের পারস্পরিক সম্পর্ক সাবলীল করতে গিয়ে উল্লেখ করেন যে, কোন মালিক সম্পত্তির দখলদার হিসেবে উপস্থিত না থাকলেই তা দেশের স্বার্থবিরোধী কি না, সে সম্পকে সরকারের সুনির্দিষ্ট অভিমত থাকতে হবে।১৩ আদালত আরাে বলেছেন যে, পরিত্যক্ত সপত্তি হিসেবে সরকার কতৃক দখলকৃত সম্পত্তি সরকার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য।১৪ এভাবে বহ,ক্ষেত্রে আদালত আইনের ব্যাখ্যার মাধ্যমে সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করে জনগণের সমস্যা যথাযথভাবে সমাধান করেছেন। কিন্তু আদালতের রীট এখতিয়ার যেহেত, বহলি করা হয় ১৯৭৩ সাল থেকে, এবং ইতিমধ্যেই বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়ার জটিলতার কারণে মামলার নিষ্পত্তি বিলম্বিত হয়েছে, সেহেতু বিচার বিভাগের বিচার সকলের জন্য সহজলভ্য হয়ে ওঠেনি।১৫ আদালত আইনের নিঃসরতা সম্পকে চুড়ান্ত মতামত প্রকাশের আগেই অনেকে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছেন। তাছাড়া সম্পত্তির দখল নিয়ে নেয়ার পর যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের পণ্ঠপােষকতাপ্রাপ্ত সমকালীন দখলদারদের ভয়ে, আর্থিক অসুবিধা ও নিরাপত্তার অভাবে, দদশা থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য এগিয়ে আসার সাহস পাননি। | যখনই যুদ্ধকালীন অবস্থার সূত্রপাত ঘটে এবং তা একটি নতুন জাতির অভ্যুদয়ের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন জনগণের অভিবাসন ও স্থানচ্যুতি সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক ভারসাম্যকে কমবেশী বিঘিত করে এবং পরিস্থিতির মােকাবিলার জন্য তখন আইন প্রণয়ন করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এটা ধরে নেয়া হয় যে, প্রতিটি আইন জনগণের মঙ্গলাথেই প্রণয়ন করা হয় এবং এক্ষেত্রে পিও ১৬-র একটি অর্থবহ উদেশ্য ছিলো বলে নিদ্বিধায় স্বীকার করে নেয়া যেতে পারে। তবে একটি আইন কতটুকু মঙ্গলজনক হবে, তা সেই আইন বাস্তবায়নের উপর নির্ভর করে। পি ও ১৬-র ন্যায় আইনগুলাের মাধ্যমে সরকারী প্রশাসনযন্ত্রের হাতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করা হলে পক্ষান্তরে তা জনগণের আর্থ সামাজিক জীবনযাত্রার উপর। নিদারুণ বিরপ প্রতিক্রিয়ার সষ্টি করে এবং বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের। জন্য এর প্রতিক্রিয়া ছিলাে আরাে ভয়াবহ। আইনের প্রয়োেগ সপকে প্রশ্ন উত্থাপন করার অধিকার না থাকায় এর। প্রয়ােগবিধি ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত একশ্রেণীর লোকের জন্য লটপাটের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। এই আইন বেপরােয়াভাবে ব্যবহারের সুযােগ থাকায়, যারা দেশের বাইরে চলে গিয়েছিলেন শুধমাত্র। তাদের সম্পত্তিই নয়, এমনকি যারা সশরীরে উপস্থিত ছিলেন এমন অনেক মালিকের সম্পত্তিও দখল করে নেয়া হয়। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে। সঙ্গে এই আইন এক ধরনের লোকের জন্য সম্পত্তি অর্জনের উৎস হিসেবে। বিরাজ করতে থাকে। | পিও-১৬ বাস্তবায়িত করতে গিয়ে দেখা যায় যে, স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে সরকারী আমলাতন্ত্রের দুবলতা এবং উচ্ছংখলতার সুযােগে রাজনৈতিক সুবিধাভােগী শ্রেণী এবং ক্ষমতাসীন হিসেবে আওয়ামী লীগ কার্যত পরিস্হিতি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে। এই আইন অপরের সম্পত্তি আইনের আবরণে লুট করার সুযােগ এনে দিয়েছিলো। ক্ষমতাসীন সরকারের নেতা-কর্মীরা সরকারের ভীতসন্ত্রস্ত কমকতাদের মাধ্যমে পরিস্থিতির সদ্ব্যবহার করেন এবং পক্ষান্তরে তাদেরই সাহায্য নিয়ে সরকারের এক শ্রেণীর কমকতা তাদের লটের অংশীদারে পরিণত হন। এমনও দেখা গেছে যে, নিছক সামাজিক অথবা রাজনৈতিক শতাবশে মালিক উপস্থিত জেনেও একজনের সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে নেয়া হয়েছে। যে সমস্ত অবাঙালী ভারতীয় বা বিহারী বহবছর আগে বাংলাদেশে মাইগ্রেশন করে বসতি স্থাপন করেছিলেন, এবং পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করেননি, ভীতি প্রদর্শন করে এমন প্রায় সকল অবাঙালীর সম্পত্তি পরিত্যক্ত সম্পত্তি হিসেবে দখল করে নেয়া হয়। রাজনৈতিক প্রতারকেরা তাদের বিপর্যয়ের সুযােগ গ্রহণ করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। ১৬
২৫

প্রাথমিক ভাবে কোন বিধান জারী করা হয়নি বলে ছোট বড় সকল পরিত্যক্ত সম্পত্তির ব্যবস্থাপক, প্রশাসক এবং বােডসদস্য হিসেবে ঢালাওভাবে দলীয় নেতা-কর্মীদের অথবা রাজনৈতিক নেতা বা মন্ত্রীদের পণ্ঠপােষকতাপ্রাপ্ত লোকদের নিয়ােগ করা হয়। বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের প্রতিঠান পরিচালনার জন্য প্রশাসকের নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মী অথবা তাদের পণ্ঠপােষকতাপ্রাপ্তদের নিয়ােগ করা হতে থাকে।১৭ অনেক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে অভিজ্ঞতা এবং কারিগরী জ্ঞানবিহীন দলীয় নেতা-কমী অথবা প্রতিষ্ঠানের অধঃস্তন কর্মচারীদের ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ করা হয়। এভাবে দীর্ঘদিন যাবৎ পাকিস্তানী ব্যবসায়ী অথবা তাদের বিশ্বস্ত ব্যবস্থাপকদের দ্বারা পরিচালিত অসংখ্য পাটকল, বস্ত্রকল এবং শত শত বহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান কতিপয় অদক্ষ, অনভিজ্ঞ ম্যানেজারের করায়ত্ত হয়। গােলযােগ, দুনীতি, লুট হয়ে দাঁড়ায় এর অনিবার্য ফল। সংঘবদ্ধ চোরাচালানীদের মাধ্যমে শিল্প প্রতিষ্ঠানের দামী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়, উৎপাদন দুত নেমে আসে নীচের দিকে, যে কোন সুবিধাজনক মল্যে এই সম্পত্তি বিক্রি বা বিনিময় করা হতে থাকে। প্রতিষ্ঠানের নগদ অর্থ বা তার নামে ব্যাংকে রক্ষিত, টাকা হিসাববিহীনভাবে চলে আসে ব্যক্তিবিশেষের হাতে। ফলে অচিরেই এ ধরনের অধিকাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠান দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিংবা সেগুলাে বন্ধ বা বিক্রি করে দেয়া হয়। সম্ভবত এটা ছিলাে এমনি একটি ক্ষেত্র, যেখানে মন্ত্রী, সরকারী কমকত, ষোড়শ বাহিনীর সদস্য যাই হন না কেন, তাদের মধ্যে দেশপ্রেমের ছিটেফোঁটাও ছিল কিনা সন্দেহ—তাদের আত্মীয়স্বজন, সমথক এবং পৃষ্ঠপােষকতাপ্রাপ্তদের কথা তো বলাই বাহুল্য।

Reference: বাংলাদেশ শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল – মওদুদ আহমেদ