You dont have javascript enabled! Please enable it!

সােভিয়েট নেতাদের নয়া দায়িত্ব

মস্কো ফিরে গেছেন সােভিয়েট পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদ্রে গ্রোমিকো। এখনও কাটে নি গােটা দুনিয়ার আকস্মিক বিস্ময়ের জের। ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তির সামরিক তাৎপর্য ব্যাখ্যায় মাথা ঘামাচ্ছেন অনেকে। নয়াদিল্লীর সামনে মুখ্যে সমস্যা বাংলাদেশ এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী। এদের কেন্দ্র করেই আবহাওয়া হয়ে উঠেছে গরম। হামেশাই ইয়াহিয়া দিচ্ছেন রণ হুঙ্কার। শরণার্থীদের আশু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কেন্দ্রীয় সরকারের একান্ত কাম্য। তা না হলে ভেঙ্গে পড়বে ভারতের অর্থনৈতিক কাঠামাে। অথচ বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে শরণার্থীরা ফিরতে পারবেন না নিজেদের বাড়ীঘরে। ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি এ সমস্যা সমাধানের কতখানি ইঙ্গিতবাহী তা দেখার জন্য সবাই উৎসুক। মস্কো এবং নয়াদিল্লী কি ধরনের সমাধানের কথা ভাবছেন তার খানিকটা হদিশ মিলবে ভারত-সােভিয়েট যুক্ত ইস্তাহারে। উভয় রাষ্ট্রেরই ধারণা, পাকিস্তানের জনগণের কল্যাণের জন্যই দরকার পূর্ব-বাংলার সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। ইসলামাবাদের সামরিক মত্ততা এ পথের প্রতিবন্ধক। ছাড়তে হবে পাক-শাসকদের বলদর্পিত গােয়াতুমী। ফিরিয়ে আনতে হবে স্বাভাবিক অবস্থা। তা হলেই ফিরবেন শরণার্থীরা। শান্তি আসবে এশিয়ার এই অশান্ত অঞ্চলে।
কথাগুলাে মােটেই নতুন নয়। বাংলাদেশে গণহত্যা এবং ভারতে শরণার্থী আগমনের সূত্রপাতেই নয়াদিল্লী বলেছিলেন এসব কথা। তাদের মতে, রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ আওয়ামী লীগ এবং পাক-শাসকদের সঙ্গে বােঝাপড়া। তারপর ঘটেছে অবস্থার আমূল পরিবর্তন। গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। মরণপণ করে লড়ছেন মুক্তিবাহিনী। চলছে মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন। আপােষ আলােচনার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। গােটা বাংলাদেশ উত্তাল। এ অবস্থায় পাক-রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব কিনা—এ প্রশ্ন জাগবে অনেকের মনে। তা ছাড়া সংসদের সর্বসম্মত প্রস্তাবে পূর্ব পাকিস্তানের নবরুপ ঘটেছে পূর্ব বাংলায়। বেতারে দিনের পর দিন বলা হচ্ছে “বাংলাদেশ।” ভারত-সােভিয়েট ইস্তাহারে রয়ে গেছে “পূর্ব পাকিস্তান” কথাটি। তাতে হয়ত কোন কোন মহলে দেখা দেবে সংশয়। হয়ত তারা ভাববেন—দু কদম এগিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেছেন নয়াদিল্লী।
বাস্তব দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির পর্যালােচনা দরকার। বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের মত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েনি সােভিয়েট রাশিয়া। নয়াদিল্লী যখন প্রকাশ করছিলেন পাকবিরােধী উম্মা তখন মস্কোর চলছিল নরম-গরম আবেদন নিবেদনের পালা। এ পালার সমাপ্তি ঘটেছে এখন। তারা এগিয়ে এসেছেন দু’ কদম। বাংলাদেশ শাসনের নৈতিক অধিকার হারিয়েছেন ইসলামাবাদ। কিন্তু আন্তর্জাতিক আইনের নিয়ম মাফিক কর্তত্ব এখনও তাদের হাতে। বাংলাদেশ সরকারকে অন্য কোন রাষ্ট্র যদি দিত কূটনৈতিক স্বীকৃতি তবেই ঘটত স্থিতাবস্থার পরিবর্তন। দুনিয়ার আইন অনুগদৃষ্টিতে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশে সরকার মাত্র একটি। কার্যতঃ সেখানে চালু দুটি। সােফিয়েট রাশিয়া ভিন্ন রাষ্ট্র। আইনের দৃষ্টি তার কাছে বড়। তাই বাংলাদেশ তার কাছে পূর্ব পাকিস্তান। ভারতের চোখে বাংলাদেশ বাস্তব। তবু আন্তর্জাতিক আইনের ব্যাখ্যায় তাকে স্বীকার করতে হয়েছে “পূর্ব পাকিস্তান।” ব্যবস্থাটা খুবই সামরিক সব কিছু নির্ভর করছে আসন্ন ভবিষ্যতের উপর। রাজনৈতিক সমাধান চেয়েছে রাশিয়া। গত নির্বাচনে যে দল পেয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মর্যাদা তার সম্মতি ছাড়া কিছুতেই হতে পারে না রাজনৈতিক সমাধান। ভাবগতিক দেখে মনে হয় না, এ পথে পা বাড়াবেন ইয়াহিয়া খান। আওয়ামী লীগ, বেআইনী। জাতীয় পরিষদে তার ঊনআশীজন সদস্যের আসন খারিজ। রাজ্যের আইনসভারও ঘটবে একই দশা। স্বয়ং মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়ার চোখে “রাষ্ট্রদ্রোহী।” এই “রাষ্ট্রদ্রোহীদের” যারা নেভা তাদের প্রাপ্য পাকদণ্ড মত। গত পঁচিশে মার্চ রাত্রিতে জঙ্গী নেতারা ম ফেলেছেন পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভবনা। ইয়াহিয়ার পতন এবং পাকিস্ত নের শাসকগােষ্ঠীর পরিবর্তন ছাড়া তার পুনরাবির্ভাবের নেই কোন আশা। চেষ্টা করে দেখতে পারেন। সােভিয়েট নেতারা। যদি সক্ষম হন ভাল কথা। যদি ব্যর্থ হয় তাদের উদ্যম তবে সংখ্যাধিক্যের রায়ের মর্যাদা দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। স্বাধীনতা যদি হয় গােটা পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু পূর্ব বাংলার কাম্য তবে তাই মানতে হবে। রাজনৈতিক সমাধানের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকা দরকার। ক্রমবর্ধমান শরণার্থী নিয়ে অনন্তকাল অপেক্ষা করতে পারে না ভারত। অবশ্যই মস্কো উপলব্ধি করছেন নয়াদিল্লীর সঙ্কট। ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির দায়িত্ব নিয়েছেন তারা নিজের কাঁধে। ভারত সেখানে দর্শক। মস্কোর এই নয়া ভূমিকা কাজে না এলে স্বাধীন বাংলাদেশ এবং তাকে স্বীকৃতিদান অনিবার্য।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!