You dont have javascript enabled! Please enable it!

শরণার্থী শিবিরে বিদেশী ত্রাণকর্মী

প্রতিদিন আসছেন শরণার্থীরা। এখন তাদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে আশী লক্ষ। এক কোটিতে পৌছাতে দেরী লাগবে না। সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে গড়ে উঠেছে আশ্রয় শিবিরগুলাে। নিরাপদ এলাকায় এসেই দুর্গত মানুষগুলাে একেবারে নিশ্চিত নন। এখানে নেই ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনীর তাড়া, কিন্তু আছে রােগব্যাধির প্রকোপ। পর্বত প্রমাণ সমস্যা ভারতের একার পক্ষে সামলান সম্ভব নয়। শরণার্থীরা গােটা বিশ্বের সমস্যা। বাইরের সরকারি সাহায্য যা আসছে প্রয়ােজনের তুলনায় তা সামান্য। আর্তের সেবায় দেশী বিদেশী ত্রাণ সংস্থার কর্মীদের অবদানও কম নয়। বিপুল সংখ্যায় শরণার্থী আগমনের প্রথম ধাক্কা সামলাতে তাদের সাহায্য কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবেন প্রত্যেকটি জনদরদী মানুষ। গত চার মাসে কাজ এগিয়েছে অনেকখানি। কর্মীরা এখন অধিকতর সংহত এবং বাস্তবমুখী। শরণার্থীদের মধ্যে থেকেই উপযুক্ত লােক বেছে কাজের দায়িত্ব দেবার কথা ভাবছেন কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে সেবার কাজ চলবে আরও সুষ্ঠুভাবে। অনেক বিদেশী সেবারব্রতী দিনরাত খাটছেন আশ্রয় শিবিরগুলােতে। তাদের মানবতাবােধ দাগ কেটেছে সবার মন। ওদের চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন নয়াদিল্লী। তাতে ক্ষুধ্ব হয়েছেন বিদেশী কর্মীরা। অনেকে হয়ত ভুল বুঝছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। কোন গােপন মতলব নেই কর্তৃপক্ষের। তাদের মধ্যে অবশ্যই নেই কৃতজ্ঞতার অভাব। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী সুইস বেতারের প্রতিনিধির কাছে ব্যাখ্যা করেছেন সরকারি নীতি। পাইকারীহারে সব বিদেশী সেবারব্রতীকেই একযােগে চলে যেতে বলা হয় নি। যারা চলে যাবেন তাদের শূন্য স্থান নেবেন দেশী কর্মীরা। ভারতের লােকবল অপর্যাপ্ত। এদের কাজে লাগান অত্যাবশ্যক। আমরা বসে থাকব, আর বিদেশীরা এসে আমাদের কাজ করে দেবেন—এ ধারণা অসঙ্গত। প্রথম পর্যায়ে ওটার হয়ত দরকার ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়ে তার পরিবর্তন যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া আছে ভাষার সমস্যা। যারা শরণার্থীদের ভাষা বুঝেন না তাদের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া সহজসাধ্য নয়। সুষ্ঠু সেবার জন্য আরও দরকার ভারত এবং বাংলাদেশের পারিপাশ্বিৰ্কের সঙ্গে নিবিড় পরিচিত। দেশীয় সমাজ এবং মানসিকতার উপলব্ধি। বিদেশী সেবাব্রতীদের কাছে এ ধরনের জ্ঞান প্রত্যাশিত নয়। যেসব মানবদরদী এখানে এ তাঁদের স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে নজর রাখা ভারতেরই কর্তব্য। কারণ তারা সেবাব্রতী অতিথি। এই কর্তব্য পালনে অনেক ঝকমারী পােহাতে হয় কর্তপক্ষকে। দেশী কর্মীদের বেলায় ওসবের বেশী দরকার নেই। কারণ তারা স্থানীয় অধিবাসী। স্বদেশের পারিপার্শ্বিকে নিজেদের ঘর গুছিয়ে নিতে তারা অভ্যস্ত। বিশেষ করে, ভাষার হাঙ্গামা নেই। সরাসরি তারা কথা বলতে পারেন শরণার্থীদের সঙ্গে। দো-ভাষীর দরকার পড়ে না।
বিদেশে যারা কাজ করেন তারা জানেন স্থানীয় ভাষা এবং সামাজিক রীতিনীতি না জানার বিড়ম্বনা। কোন ভারতীয় যদি না জানেন ইংরেজী ভাষা তবে তাঁর পক্ষে বৃটেনে গিয়ে কাজ করা সম্ভব নয়। সেবাব্রতীদের পক্ষে একথা বিশেষভাবে প্রযােজ্য। বাংলাদেশ থেকে যারা আসছেন তারা স্বতন্ত্র দুয়িনার মানুষ। তাদের চোখের সামনে ভাসছে পাক-সৈন্যদের নারকীয় অত্যাচারের বিভীষিকা। অনেকেই নন শহুরে জীবনে অভ্যস্ত। স্বাভাবিক | চিন্তাশক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে। ওরা বলেন, পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলার ভাষা। বাংলা সবারই মাতৃভাষা, কিন্তু উচ্চারণ এবং বলার ভঙ্গী আলাদা। দেশী কর্মী ছাড়া তাদের মনের ভিতর ঢােকা অসম্ভব। ঢুকতে না পারলে সেবার অঙ্গহানি অনিবার্য। আশ্রয় শিবিরের বাসিন্দাদের বেশী দিন অলসভাবে বসিয়ে রাখাও ঠিক নয়। তাতে ঘটবে মানসিক বিকার। এর প্রতিকারের জন্যই প্রয়ােজন বেশী পরিমাণ দেশী কর্মীকে এবং শিবির বাসিন্দাকে কাজে টেনে আনা। বিদেশী সেবারব্রতীরা অবশ্যই বুঝবেন কেন্দ্রীয় সরকারের মনােভাব। তাদের অবদান স্বীকৃত এবং ভারতবাসীমাত্রই তাদের কাছে কৃতজ্ঞ! অনির্দিষ্টকালের জন্য তাদের এদেশে থাকা সম্ভব নয়। শরণার্থীরা কত দিন থাকরেন জানা নেই। বিদেশী মানবপ্রেমিকদের আরধ্ব কাজ যদি দেশী সেবাব্রতীরা চালিয়ে যেতে চান, ভাল কথা। নিঃস্বার্থ বিদেশী ত্রাণকর্মীরা এ উদ্যমে অবশ্যই সমর্থন জানাবেন।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৪ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!