উ থান্টের এই আকস্মিক উদ্বেগ কেন?
রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব উ থান্ট আকস্মাৎ নড়ে চড়ে বসলেন কেন? মধ্য রাত্রিতে তিনি ভারতীয় প্রতিনিধি শ্রীসমর সেন ও পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগা শাহীকে এমন জরুরী তলব পাঠালেন কেন? স্বস্তি পরিষদের সভাপতিকেই বা তিনি জরুরী চিঠি পাঠাতে গেলেন কেন। তিনি নাকি বাংলাদেশ সংক্রান্ত প্রশ্ন নিয়ে ভাবিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু সেখানে এমন কি হল যাতে পুত্তলিকার মতাে এতদিন যিনি চক্ষু আছে তবু দেখতে পান না, কর্ণ আছে তুব শুনিতে পান না, তিনি তড়িঘড়ি একটা কিছু করার দরকার মনে করছেন?
নয়াদিল্লী থেকে একটি সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান খবর দিয়েছিলেন যে, মহাসচিব মহাশয় নাকি স্বস্তি পরিষদের সদস্যদের একটি ঘরােয়া বৈঠক ডাকার চেষ্টা করছেন। তাঁর উদ্দেশ্য নাকি ভারত-পাকিস্তান। সংঘর্ষের সম্ভবনা নিয়ে স্বস্তি পরিষদের মতামত নেওয়া। কিন্তু বুধবার রাজ্যসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীস্বরণ সিং এই সংবাদ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বিষয়ে আলােচনার জন্য স্বস্তি পরিষদের আনুষ্ঠানিক বা ঘরােয়া, কোন বৈঠক আহ্বানেরই প্রস্তাব উ থান্টের কাছ থেকে আসেনি। ভারতের দিক থেকে এটা পরিষ্কার কথা। বিষয়টি স্বস্তি পরিষদে এলেই বরং ভারতের অস্বস্তির কারণ হতে পারত। কেননা, তাহলে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটি ভারত-পাকিস্তান কলহের ব্যাপারে পরিণত হত এবং মুরুব্বি দেশগুলি নিজেদের মুরুব্বিয়ানা ফলিয়ে আসল প্রশ্নটি ধামাচাপা দেওয়ার সুযােগ পেত।
কিন্তু স্বস্তি পরিষদে মামলা সােপর্দ করা যদি উ থান্টের উদ্দেশ্য না হয় তাহলে আসলে উদ্দেশ্যটা কি? বাংলাদেশ প্রশ্নটি তাে আজ বড় হয়ে ওঠে নি। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে গভীর মর্মবেদনা প্রকাশ করা ও ভারতে আগত আশ্রয়প্রার্থীদের সাহায্যদানের ব্যাপারে রাষ্ট্রসঙ্রে শরণার্থী সংক্রান্ত হাইকমিশনারের দপ্তরের কাজে লাগাবার বেশী আর কিছু তাে এতদিন মহসচিবকে করতে দেখা যায় নি। পূর্ব বাংলায় যখন ইসলামাবাদের ঘাতকরা দশ লাখ মানুষকে মেরেছে, অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম নিয়েছে, গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে তখন তিনি তার কোন করণীয় খুঁজে পান নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ যাতে দেশত্যাগ করতে বাধ্য না হয় সেজন্য তার কিছু করার ছিল না। এই জনস্রোত বন্ধ করার জন্যও তিনি কিছু করেন নি। আমেরিকা যখন পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীকে অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে উৎসাহ দিয়েছে তখন তিনি তাতে হস্তক্ষেপ করার প্রয়ােজনবােধ করেন নি। এখন তাকে হঠাৎ আবার আলাপ-আলােচনায় ব্যস্ত হয়ে উঠতে দেখে সংশয় জাগা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাধতে পারে, এটাই যদি উ থান্টের উদ্বেগের কারণ হয় তাহলে তার এই উদ্বেগ সম্পর্কে ভারতের উদ্বেগ বােধ করার যথেষ্ট কারণ আছে। কেননা আসলে এটা বাংলাদেশ পশ্নের মধ্যে ভারতকে অযথা একটি পক্ষরূপে অন্তর্ভুক্ত করারই উদ্যোগ। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষের সম্ভাবনাটা কোথায়? ২৫ মার্চ তারিখ পর্যন্ত ঢাকায় ইয়াহিয়া খা কি ভারতের সীমান্তে শান্তিরক্ষার জন্য কথাবার্তা বলেছিলেন? সেই আলােচনা ভেঙ্গে যাওয়ার পর কি ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ববঙ্গের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল? আজ যখন ইয়াহিয়ার অনুচররা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে মার খাচ্ছে তখন খাঁ সাহেব সীমান্তের ওপার থেকে যুদ্ধের হুঙ্কর ছাড়ছেন। কিন্তু সেজন্য ভারতকে উপদেশ দিয়ে কি লাভ? পাকিস্তান যুদ্ধ চাইলে ভারতের কাছ থেকে যুদ্ধই পাবে, ভারত একথা বলবেই। ভারতের আত্মরক্ষার অধিকার রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব কখনই কেড়ে নিতে পারেন না। আর সীমান্তের এপারে-ওপারে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগের প্রস্তাবটি কাজে পরিণত করাই যদি উ থান্টের এই নতুন তৎপরতার আসল উদ্দেশ্য হয় তাহলে ভারত কিছুতেই তাঁর উদ্দেশ সার্থক হতে দেবে না। ভারত সরকার দৃঢ়তা ও স্পষ্টতার সঙ্গে বলে দিয়েছেন, এই ধরনের প্রস্তাব যারা করবেন তাদের কাজকে “অমিত্রোচিত” বলে গণ্য করা হবে।
যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের মহাসচিব হিসাবে উ থান্টের চাকরির মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে তাহলেও এই ভদ্রলােক তার পশ্চিমী মনিবদের মুখ চেয়ে কাজ করার পুরানাে অভ্যাস কিছুইে ছাড়তে পারছেন না। বাংলাদেশ প্রশ্ন নিয়ে তিনি আবার কোন্ চক্রান্ত আঁটছেন সেবিষয়ে ভারত সরকারের সতর্ক থাকা দরকার। তাদের পক্ষ থেকে উ থাল্টকে এই মােন্দা কথা বলে দেওয়ার দরকার যে, তিনি পাকিস্তানকে যদি স্পষ্ট কথা না বলতে পারেন। তাহলে তিনি বরং চুপ করে থাকুন, অনর্থক কথা বাড়িয়ে জল ঘােলা করবেন না।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ জুলাই ১৯৭১