You dont have javascript enabled! Please enable it!

নিজের কবর খুঁড়ছেন ইয়াহিয়া খান

কোনদিক সামলাবেন ইয়াহিয়া খান। অদ্ভুত এই মুক্তিবাহিনী। ওরা যত মরে তার বেশী মারে। প্রত্যেকের ক্ষরিত রক্তবিন্দু থেকে বেরিয়ে আসে এক একটি বীর যােদ্ধা। এদের নিঃশেষের উপায় জানা নেই ইসলামাবাদের। অগতির গতি বিদেশে পাক-দুতাবাসগুলাে। প্রভুর নির্দেশে অবাধে চালায় তারা মিথ্যা প্রচার। বাঙালী কর্মীদের নিয়ে সেখানেও বেঁধেছে ফ্যাসাদ। ইয়াহিয়ার সুরে গান গাইতে চান না তারা। ইসলামাবা। বলেন, বাংলাদেশ শান্ত। ওরা জানেন—দেশটা ভয়ানক অশান্ত। ইসলামাবাদ বলেন—গণহত্যা “লায় নি তাদের সৈন্যদল। বাঙালী কূটনৈতিক কর্মীদের আত্মীয়স্বজনের প্রেতাত্মা হাসেন অট্টহাসি। ঘাতকের খঙ্গ পড়েছিল ওদের ঘাড়েই। অন্তর্দ্বন্দ্ব রুপে নিচ্ছে বিদ্রোহে। বিশ্বাস নেই বাঙালী কূটনৈতিক কর্মীদের। ইয়াহিয়ার হুকুমে তারা দায়িত্বপূর্ণ পদগুলাে থেকে অপসারিত। অবাঙালী পাক-চঁইদের কড়া নজর রয়েছে তাদের উপর। প্রকৃতপক্ষে বাঙালী কর্মীরা গৃহবন্দী। অসহনীয় হয়ে উঠেছে নির্যাতন। একজন একজন করে ছাড়ছেন তাঁরা পাক-আনুগত্যে। বাংলাদেশের নামে নিচ্ছেন শপথ। পথ দেখিয়েছেন কলকাতার প্রাক্তন পাক-ডেপুটি হাইকমিশনের বাঙালী কর্মীরা। তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিশ্বস্ত সেবক।
দেশাত্মবােধের ঢেউ লেগেছে সর্বত্র। যেখানে আছেন বাঙালী সেখানেই চলছে প্রচণ্ড আলােড়ন। ইসলামাবাদের মুখে মুখে লাথি মেরেছেন দিল্লির দুজন প্রাক্তন পাক-কূটনৈতিক অফিসার। তারাও এখন জয় বাংলার দলে। তারপর এসেছে প্যারিস, সুইডেন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন এবং লণ্ডনের পাক-মিশনের পালা এসব দূতাবাসের কথা আলাদা। সেখানে যিনি ইসলামাবাদের নকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন তিনি বাঙালী নন, পাকিস্তানি। বড় হয়ে উঠেছে তার কাছে বিবেকের তাড়না। দূর থেকে তিনি দেখছেন বাংলাদেশের রক্তস্রোত। মিথ্যার ক্লেদে পঙ্কিল করতে চান নি তিনি নিজের রসনা। হতে চান নি ইয়াহিয়ার বর্বরতার গৌণ শরিক। গাইতে চান নি মানবতার মহাশত্রু জঙ্গীশাহীর সাফাই। নীরবে ছেড়েছেন তিনি সুইডেনের পাক দূতাবাস। পিছনে রেখে গেছেন মানুষের বিবেকী সত্মার গৌরব স্পিহা। ওয়াশিংটনের পাক-দূতাবাসের আবদুল মাল মহিথ [আবুল মাল আবদুল মুহিত] দায়িত্বশীল অফিসার। তিনি ছিলেন অর্থনৈতিক পরামর্শদাতা। পাকিস্তানের হাঁড়ির খবর রাখেন তিনি। তার ভবিষ্যৎবাণী গােটা মানবজাতির দুঃস্বপ্ন। আগামী তিন মাসের মধ্যে অনাহারে মরবেন বাংলাদেশের অন্ততঃ দেড় কোটি মানুষ। সম্ভাব্য মড়কের ব্যাপকতা ছাপিয়ে উঠবে ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের মহামারীকে। গণহত্যা এবং মহামারীর স্রষ্টার সঙ্গে মহিথ রাখবেন না কোন সম্পর্ক। নিয়েছেন তিনি জয় বাংলার শপথ। বক্তব্য অতি পরিষ্কার। ইয়াহিয়া খুঁড়ছেন নিজের কবর। তিনি হয়ত হতে চান প্রাচীন মিশরের ফারাও। মনে রাজসিক উন্মাদনা। তার মৃতদেহের সঙ্গে কবরে ঢুকবে জ্যান্ত সাঙ্গপাঙ্গের দল। এই জঘন্য স্বৈরচারীর সঙ্গে সহমরণে যাবেন না মহিথ। কেটে পড়েছেন তিনি। হতাশার নিদারুণ ঘনঘটায় একমাত্র ভরসা স্বাধীন বাংলাদেশ। তার পদমূলেই ঢেলেছেন তিনি অকৃপণ আনুগত্যে। বাংলাদেশের জয় এবং তার জয় আজ অভিন্ন।
প্রায় তিন মাস আগে গড়ে উঠেছে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার। তারপর তেয়াত্তরজন পাক-কূটনৈতিক কর্মী ছিড়ে ফেলেছেন পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক। ভাল করে চূণকালি মাখিয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার মুখে। হাটের মধ্যে ওরা ভেঙ্গেছেন ইসলামাবাদের হাঁড়ি। বেরিয়ে পড়েছে মিথ্যার উৎকট আবর্জনা। তবু লজ্জা নেই জঙ্গীশাসক গােষ্ঠীর। বিরামহীন প্রলাপ চলছে আগের মতই। মার্কিন প্রবােধে পাওয়া যাচ্ছে না কোন ফল। আমেরিকা নিজেও নাজেহাল। বাংলাদেশের দুর্গত মানুষগুলাের জন্য দিচ্ছে সে রুটি। আবার তাদের ঘায়েল করার জন্য জোগাচ্ছে ইয়াহিয়ার অস্ত্র। এই শয়তানি খেলা বুঝে ফেলেছেন সবাই। মার্কিন রাষ্ট্রনায়কের উপর বিশ্বাস নেই কারও। ওদের কূটবুদ্ধি আজ আহাম্মকীর সামিল। তাতে শেষ রক্ষা অসম্ভব। উন্মাদ ইয়াহিয়া খানের চেখের সামনে ভাসছে দুর্ভেদ্য অন্ধকার। বেরুবার প্রায় সব পথ বন্ধ। বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলােতে তিনি জ্বালিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন ইসলামাবাদের প্রচারযন্ত্রের দীপাবলী। তৈলের বদলে ঢেলেছিলেন সেখানে বাঙালীর রক্ত। একটি একটি করে নিভে যাচ্ছে প্রদীপ। স্বাধীন বাংলাদেশে জ্বলছে আশার বর্তিকা। পাক-পতঙ্গের দল পুড়ে মরছে সেখানে। তাদের চিতার আগুনে পথের নিশানা পাচ্ছেন মুক্তিবাহিনী। আহত জানােয়ারের মত ইয়াহিয়া দিচ্ছেন ভারতবিরােধী রণহুঙ্কার। ভুট্টো ধরেছেন ফেউ। তাতে কি নিস্তার পাবেন জঙ্গীচক্র? কখনই নয়। পাক-দূতাবাসগুলাের নির্বাপিত দীপগুলােই ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। যত দিন যাবে ইসলামাবাদের জোয়াল থেকে বাঙালী তত খসবে। ইয়াহিয়া নিজে খুঁড়ছেন নিজের কবর। মুক্তিবাহিনী তার শবের উপর দেবেন মাটি চাপা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!