You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতার চক্রবৃদ্ধি সুদঃ বাঙালা

পঁচিশ বছর ধরে আমি যে স্বপ্নটা দেখতাম, ভৌতিক ছায়ার মতাে বরাবর সেটা সরে গেছে। দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দেশভাগ স্বাধীনতা এবং স্বাধীন জীবন। পঁচিশ বছরের আয়তনে এত-গুলি ঘটনা ধরে আমি আমার জীবনের লাভক্ষতির হিসাব কষছিলাম। দেখলাম স্বপ্নটা এখনও তফাতে—সেই শ্যাওড়া গাছের ছায়ায় কিংবা গাবতলায়।
একদা ওপার বাংলার এক গ্রামে জন্মেছিলাম—বাল্য ও কৈশােরের কয়েকটা বছর জল-বিল হিজল বনবাদাড়—ওপরে নীল নীচে সবুজ এক ভূখণ্ডের মায়ায় বেড়ে উঠছিলাম ঠিক তখনই স্বাধীনতা এবং দেশ ভাগ—ফলং দেশত্যাগ। বীভৎস আতঙ্কের মধ্যে সর্বস্ব খুইয়ে প্রপারে এসে উঠলাম। কলকাতা শহর। পথে পথে ঘুরে বেড়াই। এক স্কুলে ভর্তি হই, মাইনে দিতে পারি না, নাম কাটা যায়। বছর ঘুরে গেলে আবার আর এক স্কুলে। সেখানেও তেমনি করে নাম কাটা যায়—পরীক্ষা হয় না। অথচ বয়স বেড়ে যায়। অনেক পথের ধূলাে খেয়ে যখন স্কুলফাইনালের কাঁটা তার ডিঙ্গোলাম, তখন বয়স চাকরির নির্দিষ্ট বয়ঃসীমা পেরিয়ে গেছে এবং চাকরির বিজ্ঞাপনের চিরাচরিত সেই—“অন্যানু… বছরের অভিজ্ঞতা থাকা চাই’ নামক কুমীরের ভয়ঙ্কর লেজটা তেমনি ঝােপের আড়ে দেখা যাচ্ছে। অতএব আমার স্বপ্ন… গাবতলিতে ভূতের ছায়ার মতাে তফাতে এবং অস্পষ্ট।
জন্মেছি এই বাংলায় কথাটা যে স্বাধীন ভারতবর্ষে আনন্দ এবং সুখের নয়, তা বােধকরি বঙ্গবাসী ‘হ্যাভ মটস’দের শতকরা একশ জনই স্বীকার করবেন এবং এটাও কবুল করবেন যে, এ বঙ্গে বেঁচে থাকাটা জীবনের এক প্রচণ্ড ব্যঙ্গ এবং স্বাধীনতাটা এক হিমালয় প্রমাণ ধাপ্পা। গােটা ভারতবর্ষ এবং ভরতীয়ের পক্ষে নয় বাংলা এবং বাঙ্গালীর পক্ষ।
না, আমি প্রাদেশিক নই, আমি নিতান্তই বঙ্গদেশীয় এবং যে বঙ্গ গােটা ভারতের স্বাধীনতার জন্য চক্রবৃদ্ধিহারে সুদ জুগিয়ে যাচ্ছে। এ সুদের নাম রক্ত এবং জীবন। ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করে গেছে এ বাংলারই সর্বাধিক প্রাণ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গেছে এ বাংলারই প্রাণ, দেশ ভাগ, নির্যাতন, উদ্বাস্তু জীবনের সেই ভয়ঙ্কর দিনগুলিতে গেছে এ বাংলারই প্রাণ এবং সর্বশেষে এই সত্তর-একাত্তরেও যাচ্ছে এই বাংলারই তরুণ প্রাণ! সুদ! গড়ে মাসে আড়াইশ-তিনশ তাজা জীবন।
সুদ গুনে যাচ্ছি সুদ। অতীতে বােধহয় অনেক ঋণ ছিল, অনেক বেশী খেয়েছিলাম। এখন দেনার ভারে বিকোচ্ছি।
এখন জয়বাংলা। একদা তেইশ বছর আগে উদ্বাস্তু নামের রাষ্ট্রীয় খেতাবটি নিয়ে আমরা এপারে এসেছিলাম, কপাল থেকে আজও সেই সম্মানটি মুছে ফেলতে পারিনি, আবার নতুন করে সত্তর লক্ষ খেতাবধারী এসেছেন। যেহেতু আমরা বাঙ্গালী তাই এই সুদ গুণে চলেছি এবং চলব যতদিন না নিশ্চিহ্ন! হই।
অনেকে বলবেন কেন পাঞ্জাবও তাে ভাগ হয়েছিল। হ্যা, হয়েছিল এবং উদ্বাস্তুও হয়েছিল তারা, কিন্তু মাত্র কয়েকটি মাসের জন্য। তারা আবার সব আদায় করে নিয়েছে সরকারের কাছ থেকে। বাড়ির বদলে বাড়ি, ব্যবসার বদলে ব্যবসা। ওরা পেয়েছে ক্ষতিপূরণ আর বাংলায় উদ্বাস্তুরা পেয়েছে ভিক্ষা, আশ্রয়। তফাৎটা এই খানেই। এখানে হজরতের চুল চুরি গেলে শতদ্রুতে আর রক্ত ঝরে না, কিন্তু পদ্মা মেঘনায় করে। এবং এই একাত্তর সালেও পশ্চিম পাকের জঙ্গী দানব বাঙ্গালী হিন্দুর রক্তের প্রতি সতৃষ্ণ।
অনেক রক্ত দিয়ে পূর্ব বাংলা বাংলাদেশ হল হিন্দু এবং মুসলমান বাঙ্গালী হল এবং সম্ভবত একটি পাপমুক্ত স্বদেশ গড়ে উঠছে। হয়ত সত্যকারের স্বাধীনতা আসছে। আসুক তবু দেখে যেতে পারব বারাে কোটির অন্ত ত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী যাচ্ছে আর বাকি সাড়ে চার কোটি পরস্পরের মুণ্ড নিয়ে গেণ্ডুয়া কিংবা মাথা ছিড়ে নিজেই রক্ত খাচ্ছে। এ হল সুদের চক্রবৃদ্ধি সুদ। বিনয়-বাদল-দীনেশ রাম, সূর্য সেন, বাঘা যতীন, নেতার দেশবন্ধুর বাংলায় এই পাপ পাপ? এবং এই রক্ত এবং জীবনের কার ঋণের সুদ?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!