You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাষ্ট্রপতির ভাষণ

স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরির ভাষণ গতানুগতিক থেকে আলাদা। তাতে নেই আত্মতুষ্টির বলগাহীন উচ্ছাস এবং অবাস্তব প্রতিশ্রুতি বাহুল্য। জাতির সামনে তুলে ধরেছেন তিনি ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সঙ্কট। সঙ্গত কারণেই তাঁর ভাষণে প্রাধান্য পেয়েছে শরণার্থী সমস্যা, ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি এবং আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্ন। পঁচাত্তর লক্ষাধিক শরণার্থী এসে পড়েছেন ভারতে। আর কত পাঠাবেন ইয়াহিয়া খান, জানা নেই। জলের মত খরচ হচ্ছে টাকা। এটা বন্ধ না হলে হয়ত দেখা দেবে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলাের কাটছাঁটের আশঙ্কা। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের উপর নির্ভর করছে শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। কেন্দ্রীয় সরকারের কথা-বার্তায় মিলছে না সমাধানের কোন ইঙ্গিত। ভারত সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তিতে মস্কোনয়াদিল্লী চেয়েছেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলে রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা অর্পণ। সােজা কথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা। রাষ্ট্রপতির ভাষণের পরিপূরক হিসাবে যদি ধরা যায় প্রতিরক্ষামন্ত্রীর অভিমত তবে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের আশা ছেড়ে দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তি বেছে নিয়েছেন সংগ্রামী পথ। দিচ্ছেন ইয়াহিয়ার গণহত্যার পাল্টা জবাব। ওরা জয়যুক্ত হলেই শরণার্থীরা পাবেন মনের জোর এবং ফিরবেন স্বদেশে। এই সহজসত্য নয়াদিল্লীর জানা থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকারকে এখনও দেন নি তারা কুটনৈতিক স্বীকতি এবং কাটছে না তাদের ইতস্ততঃ মনােভাব। রাষ্ট্রপতি নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। রাজনৈতিক সমস্যার চুলচেরা বিচার এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণ তাঁর কাছে প্রত্যাশিত নয়। ওটা করবেন মন্ত্রিসভা।
বাংলাদেশ সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার হালচাল বিশ্লেষণে ভুল করেন নি রাষ্ট্রপতি গিরি। চোখের সামনে ঘটল বাংলাদেশে নারকীয় হত্যাকাণ্ড এবং ভিটেমাটি ছাড়লেন লক্ষ লক্ষ মানুষ, তবু বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে নিতে পারল না কোন সক্রিয় ব্যবস্থা। হার মানল তারা ইসলামাবাদের জঙ্গীশাহীর পৈশাচিক তাণ্ডবের সামনে। মানবতার কোন মূল্য নেই বর্তমান যুগে। যাদের হাতে আছে অমিত শক্তি তাদের কাছে সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ এবং শক্তিবিন্যাসে ভারসাম্যের খেলাই বড়। বাংলাদেশ সমস্যাকে তারা ভাবছে পাকভারত শক্তি সাম্যের ভিত্তিতে। স্বাধীন যদি হয় পূর্ব বাংলা; তবে নিঃসন্দেহে দুর্বল হবে পাকিস্তান। শক্তি বাড়বে ভারতের। বাইরের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে এশিয়ার এই পরিবর্তন দেখতে অনিচ্ছুক। ভারতকে হাতের মুঠোর মধ্যে রাখার জন্যই তারা জইয়ে রাখতে চায় ইসলামাবাদের বলদিপত জঙ্গীশাহী। তাতে যদি গণতন্ত্র এবং মানবতার অপমৃত্যু ঘটে, ক্ষতি নেই। বৃহৎ শক্তিগুলাের এ খেলা পুরানাে। পরপর দুটি মহাযুদ্ধ এবং শক্তিশালী নতুন নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়েও হয় নি তাদের সাবেকী মনােভাবের পরিবর্তন। বাংলাদেশ আজ এই খেলার বলি। তার দুঃখ -দুর্দশায় জেগে উঠছে না সক্রিয় বিশ্ববিবেক। গণহত্যা এবং স্বদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ নরনারীর সমূল উচ্ছেদ মানবতার চরম অপমান। এ অপমানের প্রতিকারের দায়িত্ব গােটা বিশ্বের। যারা মনে করেন বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা তারা ভ্রান্ত। ইয়াহিয়ার অত্যাচার বন্ধ না হলে এবং শরণার্থী সমস্যার সমাধান দীর্ঘদিন অমীমাংসিত থাকলে এশিয়ার এ অঞ্চলের শান্তি বিঘিতে হতে বাধ্য। ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর বােঝা মাথায় নিয়ে বেশীদিন বসে থাকতে পারবে না ভারত। প্রতিকারের সক্রিয় উপায় অবশ্যই খুঁজতে হবে তাকে। পাকিস্তান জানে, মুক্তিবাহিনীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন নয়াদিল্লী। তাদের বিজয় এবং ইসলামাবাদের সামরিক শাসনের অবসান প্রত্যেকটি বিবেকবান মানুষের কাম্য। তাই হামেশাই চলছে ইয়াহিয়ার রণ হুঙ্কার। আমেরিকা এবং চীন দিচ্ছে তাঁকে আস্কারা।
এই সঙ্কটজনক মূহুর্তে স্বাক্ষরিত হয়েছে ভারত-সােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি। রাষ্ট্রপতি গিরির ধারণা, এ চুক্তি শান্তির পথে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। দৃঢ়তর হবে তাতে ভারতের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি। যে কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদনে ইচ্ছুক নয়াদিল্লী। শীগিরির অনুমান অনেকাংশে সত্য। ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি যুদ্ধবাজদের উকট মনােবৃত্তির উপযুক্ত প্রতিষেধক। ব্ল্যাক মেইলের রাজনীতির উপর ওটা একটা নিদারুণ।
আঘাত। কিন্তু যতদিন থাকবে বাংলাদেশের এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সমস্যার সক্রিয় সমাধানে। রাষ্ট্রপতির আশাবাদ কাজে রুপায়ণের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় সরকারের। এ কথা সত্য, ভারতের কাঁধ থেকে বিরাট বােঝা নামাবার প্রাথমিক উদ্যোগ করতে হবে সহযােগী, পথনির্দেশক নয়। তার জন্য দরকার ত্যাগ স্বীকার, শৃঙ্খলাবােধ এবং কর্তব্য পালনের স্বেচ্ছা উদ্যম। তা হলেই আসবে আত্মনির্ভরতা এবং সমাজতান্ত্রিক পথে। অগ্রগতি। স্বাধীনতা দিবসে রাষ্ট্রপতির এ বাণী নব-জীবনের আশ্বাস এবং ভবিষ্যতের পাথেয়।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৭ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!