ফাঁকা বুলির কাজ নয়
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা তাঁর সংসদীয় দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছেন যে, এক বা দু’মাসের মধ্যেই কি তারও আগে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যাবেন। এটা আশার কথা সন্দেহ নেই; কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তিনি এ কথা বললেন তিনিই জানেন, জনসাধারণ এ বিষয়ে এখনাে অন্ধকারে। তার মতে বিশ্ব জনমতের বিপুল অংশই বাংলাদেশের প্রশ্নে ভারতের অনুকল আর পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর উপদেশ, এ অবস্থায় ভারতের সংযত আচরণ করা দরকার। বিদেশ সফর করে এসে সংযম সম্পর্কে তাঁর এই উপদেশ দানে মনে হয় ভারত কি তাহলে এতদিন অসংযত আচরণ করে এসেছে?
সংসদের বিরােধী দলের নেতাদের কাছে প্রধানমন্ত্রী আশা প্রকাশ করেছে যে, বাংলাদেশের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনােভাবের পরিবর্তন হতে পারে। মার্কিন সরকার নাকি তাকে এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যে, তৃতীয় দেশের মারফতেও তারা পাকিস্তানকে অস্ত্র দেবেন না। মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন বলেও প্রধানমন্ত্রীর ধারণা।
তিনি কি তারই উপর নির্ভর করে বলেছেন যে, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের দিন আগত? মার্কিন রাষ্ট্রপতি ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীকে কার্যত কী আশ্বাস দিয়েছেন আমাদের জানা নেই। সাম্রাজ্যবাদীদের আশ্বাসের মূল্যই বা কী? এটাই স্বাভাবিক যে, তাদের দিক থেকে এমন একটা প্রস্তাব হয়তাে আসবে যাতে থাকবে পাক মিলিটারি জুন্টার অপকীর্তি আড়াল করার চেষ্টা। তার দ্বারা শুধু কালহরণ করা হবে এই উদ্দেশে যাতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের কোনাে কোনাে অংশের মধ্যে একটা দ্বিধার ভাব আসে। ভারত তখন পড়বে সেই সাম্রাজ্যবাদী ফাঁদে যার ফলে আসল বিষয়টাই তালগােল পাকিয়ে যাবে।
দুশমন যখন ঘাড়ে তখন অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে বসে থাকা হয় সমস্যা এড়িয়ে যাওয়া, নতুবা ভয়ভীতির শিকার হয়ে হাত গুটিয়ে নেয়া মৌখিক কিছু সহানুভূতি জানিয়ে এবং সাহায্যের নামে যৎসামান্য খুদান্ন দিয়ে সাম্রাজ্যবাদীরাও যেমন চায় শরণার্থীরা দীর্ঘদিন ভারতের কাঁধেই বেঁচে থাকুক, ইয়াহিয়াচক্র তেমনি চায় আলােচনার অজুহাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানে ভারত বিলম্ব করুক আর সেই ফাঁকে দম নিয়ে
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ঘায়েল করার সুযোেগ আসুক। ঘটনাচক্রে মনে হয় সাম্রাজ্যবাদীরা শ্ৰীমতী ইন্দিরাকে মিষ্টি কথায় তুষ্ট করে তলে তলে এই ফন্দিই আঁটছে।
বিনাশর্তে জনাব মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিয়ে তার সঙ্গে আলােচনায় না বসলে যে কোনাে মীমাংসাই সম্ভব নয়, এ কথা তাে দিবালােকের মতাে স্পষ্ট। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রধানমন্ত্রীর ফেরার পর পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী সুলতান মহম্মদ খান সাংবাদিকদের কাছে খােলাখুলিই বলেছেন যে, অবৈধ ঘঘাষিত আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে এখন আলাপ-আলােচনা করার কথাই ওঠে না। মজার ব্যাপার এই যে, সাংবাদিকদের কাছে এ কথা বলার আগে তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রজার্স সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করেন। বৈঠকের পর আবার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী সেক্রেটারির সঙ্গেও খান সাহেবের মােলাকাত হয়। এর পরও কি নিক্সনের আশ্বাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর অচল বিশ্বাস আছে?
মনে হয় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান ও শরণার্থী সমস্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দ্বিধার আবর্তে পড়েছেন। অথচ তার কাছে দেশের জনমতের দাবি একটা স্থির সিদ্ধান্ত ও সুনিশ্চিত পথ অবলম্বন। জনমতকে খানিকটা আশ্বস্ত করার উদ্দেশে শরণার্থীদের আশু প্রত্যাবর্তনের মৌখিক আশ্বাস যদি তিনি দিয়ে থাকেন তবে সেই ফাঁকা বুলিতে দেশের লােক সন্তুষ্ট হবে না। তিনি তার প্রত্যয়ের ভিত্তি খােলাখুলি প্রকাশ করুন। তবেই জনসাধারণ বিচার করে দেখতে পারে তিনি যে পন্থার কথা ভাবছেন তা সমর্থনযােগ্য কি না।
সূত্র: কালান্তর
১৮.১১.১৯৭১