কোনাে প্রকার পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষ
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে মারাত্মক বিপদ
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ)-র পলিট বরাের প্রস্তাব
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
কলকাতা, ২৩ জুন— ভারত ও পাকিস্তানের সাথে কোনাে প্রকার সামরিক সংঘর্ষের অর্থই হলাে সামরিক চক্র ইয়াহিয়ার হাতকে শক্ত করা।
বাংলাদেশের প্রতিরােধ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এর পরিণাম হবে মারাত্মক। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ) তাই এরূপ কোনাে সংঘর্ষের বিরােধী। কোয়েম্বাটুরে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মাঃ)-র পলিট ব্যুরাের অধিবেশন থেকে এই প্রস্তাব গৃহীত হয়।
১৫ থেকে ১৯ জুন কোয়েম্বাটুরে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) পলিট ব্যুরাের সভা বসে। ১৬ জুন পলিট ব্যুরাে বাংলাদেশ সম্পর্কে সংবাদপত্রে একটি বিবৃতি প্রচার করেন। বিবৃতিটির পূর্ণ বয়ান এখানে প্রকাশিত হলাে:
ইয়াহিয়া খাঁর সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ যেদিন বিদ্রোহে মাথা তুলে দাঁড়ালেন এবং ঘােষণা করলেন তাদের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের অধিকার, তার পর থেকে তিন মাস পার হয়ে গেছে। ইতিহাসে নৃশংসতম অত্যাচারের যত কাহিনী আছে, সেই ধরনের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে আজও তারা বহু বাধা-বিঘ্নের বিরুদ্ধে সাহসের সঙ্গে লড়ে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া খা বাংলাদেশে এমন বিশ্বাসঘাতক পায়নি, যাতে একটা পুতুল সরকার বসিয়ে দুনিয়ার মানুষকে বােকা বানাতে পারে।
সি পি আই (এম)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি এপ্রিলে গৃহীত প্রস্তাবে দাবি করেছেন সরকারকে অবিলম্বে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং সর্বপ্রকারের সাহায্য করতে হবে, যাতে তারা ফৌজ আক্রমণের মােকাবিলা করতে ও তাকে পরাভূত করতে পারেন।’
কেন্দ্রীয় কমিটি পরিষ্কার করে বলেছেন যে, বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম, একটি ন্যায়সঙ্গত ও গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, এ সংগ্রাম শাসকচক্রের বিরুদ্ধে, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। কমিটি আরও বলেছেন যে, পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীই বিগত বছরগুলাে ধরে পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের সমস্ত গণতান্ত্রিক দাবি ও আশা-আকাক্ষা দমন করে আসছে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণের উপর গণহত্যার অভিযান শুরু করেছে। তারই ফলে বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের স্বাধীন বলে ঘােষণা করতে বাধ্য হয়েছেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের জনগণের এবং সমস্ত ইউনিটগুলাের সমমর্যাদা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের ঐক্য রক্ষা পেতে পারত।
‘পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সমস্ত ইউনিটের মেহনতি জনগণকে বাংলাদেশের জনগণের ন্যায় সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্যও কেন্দ্রীয় কমিটি আবেদন জানিয়েছেন এই বলে যে, নিজেদের স্বার্থেই তাদের এ সমর্থন করা দরকার এবং এটা তাদের নিজেদের গণতন্ত্রের জন্যও স্বৈরাচারী জঙ্গিশাহী খতম করার সংগ্রামকে সাহায্য করবে।’
ভারতের কোনাে কোনাে প্রতিক্রিয়াশীল অংশ পাকিস্তানের প্রতি ঘণা থেকে যে মনােভাব নিয়েছে, তাদের সঙ্গে আমাদের মনােভাবের তাই কিছুমাত্র মিল নেই এবং ঠিক বিপরীত। এ জন্যই কেন্দ্রীয় কমিটি ভারতের গণতান্ত্রিক জনগণকে সতর্ক করে দিয়েছেন, ‘যুক্ত বাংলার মতাে কোনাে কোনাে প্রতিক্রিয়াশীল মহলের উগ্র জাতীয়তাবাদী ধ্বনি ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে কোনাে স্লোগানকে কোনােরূপ আমল দেবেন না।
বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের জন্য সহানুভূতিতে বিগলিত হবার পরও এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতির প্রশ্নটা বিবেচনা করে দেখার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও ভারত সরকার স্বীকৃতির প্রশ্নে পিছু হটেছে এবং এখন একটা রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার কথা বলে চলেছে। পলিট ব্যুরাে ভারত সরকারের এই দ্বিধা সংকোচের নিন্দা করছে। স্পষ্টতই ভারত সরকার এটা করতে মার্কিন ও অন্যান্য কোনাে কোনাে মহলের চাপে পড়ে।
অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ও সকল রকম সাহায্য দিতে এই পার্থক্য বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং এরই ফলে বাংলাদেশ থেকে পঞ্চাশ লাখের উপর মানুষকে ভারতে বসে শরণার্থী নিতে হয়েছে। এই বিপুল শরণার্থী আগমন ভারতের পক্ষে বিশেষ করে সীমান্ত রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয়ের পক্ষে একটা বিরাট সমস্যার সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে ব্যর্থতার দরুন ভারত সরকারই তাই এ অবস্থার জন্য দায়ী।
পলিটব্যুরাে তাই দাবি করছে ভারত সরকারকে শরণার্থীদের দেখাশােনা করার ও তাদের প্রয়ােজনীয় সাহায্য ও আশ্রয় দেবার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতে হবে যতােদিন না তাদের নির্ভয়ে বাংলাদেশে ফিরে যাবার মতাে অবস্থা সৃষ্টি হয়।
পলিটব্যুরাে সমাজতান্ত্রিক ও আফ্রো এশিয়ান দেশগুলাের মনােভাবে দুঃখিত। এরা মুক্তি সংগ্রামে সাহায্য করবে আশা করা গিয়েছিল, কিন্তু এদের মনােভাব একেবারে নৈরাশ্যব্যঞ্জক।
পি বি লক্ষ করছে যে, সংসদ ও সংসদের বাইরে দাবি উঠছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত সরকারের সশস্ত্র হস্তক্ষেপের জন্য। পি বি’র মতে, এ ধরনের কাজ করা হলে, বাংলাদেশের যে সংগ্রাম মূলত গণতান্ত্রিক, তা পরিণত হবে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে এমন একটা সংঘর্ষে যেটা ঠিক ইয়াহিয়া সামরিক চক্র ও তাদের মুরুব্বিরা ঘটাতে চাইছে। বাংলাদেশের প্রতিরােধ আন্দোলনের পক্ষে এর ফল হবে মারাত্মক।
পলিটব্যুরাে তাই ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তি ও দলগুলাের কাছে আবেদন জানাচ্ছে, এ ধরনের দাবিকে আমল দেবেন না। কোনােরকম প্রভেদ না করে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ সমস্ত রকম দেয়া সাহায্য হােক ভারত সরকারের নিকট পি বি পুনরায় এ দাবি করছে ভারতের জনগণের কাছে পি বি’র আবেদন: এই উদ্দেশে ভারত সরকারের উপর এমন চাপ সৃষ্টি করুন, যাতে সরকার আর এড়িয়ে যেতে না পারে।
সূত্র: দেশের ডাক
০২ জুলাই, ১৯৭১
১৭ আষাঢ়, ১৩৭৮