You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিব বাহিনী, রক্ষী বাহিনী বনাম সেনাবাহিনী | ঢাকা সেনানিবাসে বঙ্গবন্ধুর একমাত্র সভা

আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামে একটি নতুন বাহিনী সৃষ্টি করে, যার নেতৃত্বে ছিল আওয়ামী লীগের সমর্থক যুবকেরা। এদের অস্ত্রশস্ত্র, পােশাক, প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য সরঞ্জাম ভারতীয় সেনাবাহিনী সরবরাহ করে। জনমনে ক্রমশ নানা কারণে ভারতবিরােধী মনােভাব চাঙা হয়ে ওঠে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনুরূপ অলিভ গ্রিন ইউনিফর্মে সজ্জিত রক্ষীবাহিনীর প্রতি দেশের জনসাধারণ বিভিন্ন কারণে বিরূপ মনােভাব পােষণ করে। এ বাহিনীকে থানা পর্যায়ে মােতায়েন করা হয়। স্থানীয় সংসদ সদস্যের নিয়ন্ত্রিত এ বাহিনী বিরােধীদলীয় নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে ব্যবহার করার কারণে জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
যুদ্ধোত্তর দেশে সেনাবাহিনীর সার্বিক অবস্থা খুবই নাজুক ছিল। সৈনিকদের পােশাক, বুট, কম্বল ইত্যাদি অত্যাবশ্যকীয় সরঞ্জামের অভাব প্রকট ছিল। অন্যদিকে সমান্তরাল সংস্থা রক্ষীবাহিনীর সাজসরঞ্জাম, পােশাক, যানবাহন ছিল আধুনিক ও ঝকমকে। ফলে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের মনে ক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠে। গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সরকার সেনাবাহিনী বিলুপ্ত করে জাতীয় রক্ষীবাহিনীকেই সশস্ত্র বাহিনীর মর্যাদা দেবে অদূর ভবিষ্যতে ।
দেশের কলকারখানা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় স্বল্পসংখ্যক, কিন্তু এর মালিকানা ছিল অবাঙালিদের হাতে। তারা স্বাধীনতালাভের আগেই পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ার ফলে সরকারকে বাধ্য হয়েই শিল্পপ্রতিষ্ঠানসমূহকে জাতীয়করণ করতে হয়। প্রতিটি শিল্পকারখানায় প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়, যার সিংহ ভাগ ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের সদস্য। শিল্প পরিচালনায় দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। শিগগিরই এগুলাে লােকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং জাতীয় অর্থনীতিতে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং মুক্তিবাহিনীর সামরিক নেতৃত্বের মধ্যে মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি হয়। সেনা অফিসাররা জীবন বিপন্ন করে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। অপর দিকে রাজনৈতিক নেতারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বহুদূরে নিরাপদ অবস্থানে থেকে নিরুদ্বেগ জীবন যাপন করছেন, এমন ধারণা থেকেই কিছুটা দূরত্বের সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং সেনাপ্রধান আতাউল গনি ওসমানীর অজান্তে ভারত সরকার মুজিব বাহিনী নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলে, যা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠে। জেনারেল উবানের নেতৃত্বে এ বাহিনী গঠনের উদ্দেশ্য ও কার্যক্রম পরিচালনায় গােপনীয়তা মুক্তিবাহিনীর অফিসার ও সদস্যদের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করে। স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পরই ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতা, বিশেষ করে ‘চার খলিফা’ নামে পরিচিত ছাত্রনেতাদের একজন প্রকাশ্যে বলে বসলেন, সেনাবাহিনী প্রতিপালনের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই। ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করবে। পাকিস্তানি আমলে সামরিক শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হওয়ার কারণে তারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী সামরিক বাহিনীকেও অপ্রয়ােজনীয় ভাবতে শুরু করেন।
বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর মুক্তিযুদ্ধে সামরিক বাহিনীর অফিসারদের দেশপ্রেম, শৌর্যবীর্য সম্পর্কেও তাঁকে সঠিকভাবে অবহিত করা হয়নি বলে ধারণা করা হয়। বিশেষ করে মার্চের শেষ ভাগে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর বিদ্রোহ এবং মুক্তিবাহিনী গঠনে তারা যে প্রশংসনীয় ভূমিকা রেখেছে, সে সম্পর্কেও তাঁকে অন্ধকারে রাখা হয়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা সাধারণভাবে নিজেদের কৃতিত্বকেই বড় করে দেখতে অভ্যস্ত, তাঁদের মধ্যে অন্যকে ছােট করে নিজেকে বড় করার প্রবণতা প্রায়শ দৃশ্যমান।
সশস্ত্র সংগ্রামকালীন তার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু মুজিব ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অবিসংবাদিত নেতা। সর্বশ্রেণির মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অতুলনীয়। মুক্তিযােদ্ধারা আশা করেছিলেন যে দেশে ফেরার পর প্রথম সুযােগেই তিনি সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটসমূহ পরিদর্শন করবেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র পর্ব সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে সরাসরি অবহিত হবেন। কিন্তু যেকোনাে কারণেই হােক, তার দেশে ফেরার পর কয়েক মাস কেটে গেল কিন্তু কোনাে সামরিক স্থাপনায় তাঁর পদার্পণ ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত মুজিবনগরেও তিনি যাননি। বছরের মাঝামাঝি, অর্থাৎ মে কিংবা জুন মাসে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতাে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে যান। তিনি ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন পরিদর্শন করেন এবং সৈনিকদের ট্রেনিং সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। কোয়ার্টার গার্ডের সামনে আমরা সিনিয়র টাইগার অফিসাররা তাঁর সঙ্গে পরিচিত হই। ১ম ইস্ট বেঙ্গলের ট্রেনিং গ্রাউন্ডে অফিসারদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক ছবি তােলার পর তিনি সেনা সদর দপ্তর ভিজিটে যান। সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, উপপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সেনা সদরের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসাররা তাকে স্বাগত জানান। সেনাবাহিনীর ভিত্তি পাঁচটি ব্রিগেডের কমান্ডাররাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর সফরের জন্য সেনা কর্তৃপক্ষ যাবতীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধে প্রশংসনীয় দক্ষতা, শৌর্যবীর্য প্রদর্শনকারী সেনাবাহিনী লােকবল ও সাজসরঞ্জামের দিক থেকে তখন দুর্বল অবস্থানে ছিল। সেনাবাহিনীর বিদ্যমান পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং লক্ষ্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীকে ব্রিফ করার দায়িত্ব দেওয়া হয় কৃতী অফিসার লে. কর্নেল মােহাম্মদ জিয়াউদ্দিন বীর উত্তমকে। সেনাপ্রধানের অনুরােধে গােপনীয়তা রক্ষার খাতিরে প্রধানমন্ত্রী কোনাে সহায়তাকারী ব্যতিরেকে একাই কনফারেন্স রুমে সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাদের মুখােমুখি হন। পরবর্তী ঘটনাক্রম জিয়াউদ্দিন এভাবেই বর্ণনা করেন আমার কাছে : ‘আমি দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি বর্ণনা করে বাংলাদেশের জন্য কোন ধরনের সেনাবাহিনী প্রয়ােজন, সে বিষয়ে আলােকপাত করি। প্রতিবেশী দেশসমূহের জনসংখ্যা ও সেনাবাহিনীর আনুপাতিক সংখ্যা, লক্ষ্যমাত্রা ইত্যাদির তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি গঠনপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বক্তব্য রাখি। প্রধানমন্ত্রী একটি সাদা কাগজে পেনসিল দিয়ে নােট নিচ্ছিলেন মাঝে মাঝে। আমি ব্রিগেড কনসেপ্ট থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে ডিভিশন কনসেপ্টে যাওয়া অত্যাবশ্যক বলে মত প্রকাশ করি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা বিবেচনায় রেখেই আমি এক্সপ্যানশনের প্রস্তাব রাখি। একপর্যায়ে চিফ অব লজিস্টিকস ব্রিগেডিয়ার সি আর দত্ত আচমকা বলে বসলেন, “মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, এক্সপ্যানশনের ধারণা সম্পর্কে আমার আপত্তি আছে। এ ধরনের পরিবৃদ্ধি হলে দেশে সামরিক শাসন জারির সম্ভাবনা দেখা দেবে।” কক্ষে পিনপতন নীরবতা নেমে এল। প্রধানমন্ত্রী নােট নেওয়া বন্ধ করলেন। অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অস্বস্তিকর পরিবেশে সভা শেষ হলাে। ঢাকা সেনানিবাসে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সভা আর অনুষ্ঠিত হয়নি।’ [1, pp. 122–125]

References:
[1] হাফিজ উদ্দিন, সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পচাত্তর [Military life, seventy one the pride, seventy five the blood bath], 1st ed. Prothoma, 2020.

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!