You dont have javascript enabled! Please enable it!

যুদ্ধের পর বিহারী ক্যাম্পে আক্রমণ কীভাবে প্রতিরোধ করা হয়েছে?

‘৭২-এর মার্চের মাঝামাঝি ভারতীয় সামরিক বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে ফিরে যায়। ঢাকার মােহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় বিহারি জনগােষ্ঠী অনেক বছর আগে থেকেই সংঘবদ্ধভাবে অবস্থান করছিল। সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অবাঙালিরা এই দুটি এলাকায় স্বাধীনতালাভের অব্যবহিত পর আশ্রয় নেয়। একাত্তরে যুদ্ধ চলাকালে বিহারিরা পাকিস্তানি বাহিনীর সহযােগীরূপে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারনির্যাতন চালায়, স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরাও প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় ছিল। ১৬ ডিসেম্বর ‘৭১ থেকেই ভারতীয় বাহিনী মােহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকায় কড়া পাহারা বসায়, যাতে বিহারিদের জানমাল রক্ষা পায়। ভারতীয় বাহিনীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বিহারিদের পাহারা দিয়ে রাখার দায়িত্ব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর বর্তায়।
৩০ জানুয়ারি ‘৭২ দুপুরে ১ম ইস্ট বেঙ্গল মােহাম্মদপুর এবং ২য় ইস্ট বেঙ্গলকে মিরপুরে বিহারি-অধ্যুষিত এলাকায় মােতায়েন করা হলাে। আমরা দুটি কোম্পানি নিয়ে মােহাম্মদপুরে সামরিক কায়দায় অবস্থান গ্রহণ করি। মােহাম্মদপুর থানার পাশে একটি পরিত্যক্ত ভবনে আমরা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করি। পুরাে আবাসিক এলাকাটি আমার কোম্পানির সৈনিকেরা ঘিরে রাখে। ২৪ ঘণ্টার কারফিউ জারির ঘােষণা মাইকযােগে বাসিন্দাদের জানিয়ে দেওয়া হলাে। এলাকার প্রবেশমুখে প্রতিটি রাস্তায় চেকপােস্ট বসানাে হলাে। যেকোনাে ধরনের অনুপ্রবেশ রুখে দেওয়ার জন্য সৈনিকদের কড়া নির্দেশ দিলাম। বিহারিদের জানমাল রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর, এ ব্যাপারে কোনাে শৈথিল্য সহ্য করা হবে না বলে জানিয়ে দিলাম।
বেলা দুইটার সময় স্থানীয় বিহারিদের একটি প্রতিনিধিদল আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। তাদের চোখেমুখে আতঙ্ক। ভারতীয় বাহিনী এত দিন তাদের পাহারা দিয়ে রেখেছে। এদের অবর্তমানে মুক্তিবাহিনী তাদের নিরাপত্তা বিধান করবে কি না, এ নিয়ে তারা শঙ্কিত। তাদের জীবন ও নারীদের ইজ্জত রক্ষার জন্য আমার কাছে আকুল আবেদন জানায়। আমি তাদের বুঝিয়ে বলি যে আমরাও ভারতীয় বাহিনীর মতােই নিয়মিত সেনাবাহিনী। আমাদের সেনাপ্রধান দায়িত্ব দিয়েছেন অবাঙালিদের রক্ষা করার জন্য। জীবনের বিনিময়ে হলেও আমরা এ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করব । বিহারিরা আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। তাদের ধারণা, আজ রাতই তাদের জীবনের শেষ রাত। একটু পরই উচ্ছল বাঙালিরা প্রতিশােধপ্রবণ হয়ে তাদের হত্যা করবে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা সংখ্যায় ১০, অধিকাংশই ষাটোর্ধ্ব, শরিফ কিসিমের মানুষ। অনন্যোপায় হয়ে তারা আমাকে প্রস্তাব দিল, আমি যদি তাদের জীবন ও সম্মান রক্ষা করি, তারা মােহাম্মদপুর এলাকার ১০০টি বাড়ি কোর্টে গিয়ে আমার নামে দলিল করে দেবে। তাদের হাতে তেমন অর্থকড়ি নেই। পরিবারের অলংকার পুরােটাই আমাকে দান করবে। অধীর হয়ে তারা আমার পা জড়িয়ে ধরে প্রাণভিক্ষা চায়। আমি অবশেষে তাদের রূঢ়ভাবে ধমক দিয়ে বিদায় করি। তারা কাঁদতে কাঁদতে নিজ বাড়িতে ফিরে যায়।
বেলা সাড়ে তিনটা থেকেই অসংখ্য বাঙালি দুবৃত্ত বিহারিদের সম্পদ লুট করার জন্য চারদিকে সমবেত হতে থাকে। বিভিন্ন চেকপােস্ট থেকে ফিল্ড টেলিফোনে এনসিও এবং জেসিওরা আমাকে জানায় যে বাঙালি জনতা তাদের নিষেধাজ্ঞার প্রতি কর্ণপাত না করে আবাসিক এলাকায় ঢােকার জন্য

সংঘবদ্ধ চেষ্টা চালাচ্ছে। দুবৃত্তরা নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করামাত্রই গুলি চালানাের জন্য আমি সৈনিকদের নির্দেশ দিলাম। সৈনিকেরা সামরিক কায়দায় ১০০ গজ দূরত্বে সাদা ফিতা বিছিয়ে দিয়ে সমবেত দুর্বত্ত দলকে হ্যান্ডমাইকে সতর্কবাণী জানায় ফিতা অতিক্রম না করার জন্য। উচ্ছল ব্যক্তিদের ধারণা, বাঙালি সৈনিকেরা বাঙালিদের ওপর কখনাে গুলি চালাবে না। তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হলাে।
বিকেল পাঁচটার দিকে দুটি চেকপয়েন্টের সামনের রাস্তার উচ্ছল জনতা সাদা ফিতা অতিক্রম করে আবাসিক এলাকায় প্রবেশের উদ্যোগ নিতেই আমাদের সৈনিকেরা কয়েক রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে। এতে সাত-আটজন আহত হয় এবং মুহুর্তের মধ্যে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। গুলির শব্দে মােহাম্মদপুর এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং নারী-পুরুষের আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে । রাতটি নিরুপদ্রবে কেটে গেল। আর কোনাে হামলা হয়নি।
সকাল হতেই ছুটে এল গতকালের বিহারি ডেলিগেশন। তাদের চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু। তারা আবার আমার পা জড়িয়ে ধরে বলে, বিশ্বাস করতে পারিনি আমাদের রক্ষা করার জন্য আপনারা স্বজাতির ওপর গুলি চালাবেন।’ সেই বয়ােবৃদ্ধ মানুষগুলাে সারা রাত আতঙ্কে ঘুমাতে পারেনি, পরিবারপরিজন নিয়ে আকুল হয়ে সৃষ্টিকর্তাকে ডেকেছে। এরা আমার ফুটবলার পরিচিতি জেনে সঙ্গে নিয়ে এসেছে একজন সাবেক খেলােয়াড় রশিদ চুন্নাকে। তিনি এককালে কলকাতার ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবে এবং পাকিস্তান জাতীয় দলেও খেলেছেন। ইদানীং বিজি প্রেস দলের প্রশিক্ষক ছিলেন। রশিদ ভাই আমার পূর্বপরিচিত, অমায়িক সজ্জন। আমাকে দেখে তিনি সজল চোখে জড়িয়ে ধরলেন। আশ্বস্ত করার জন্য আমি তাঁকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর বাড়িতে গেলাম। তিনি জানালেন যে বিত্তশালী অবাঙালিরা সবাই স্বাধীনতালাভের আগেই পাকিস্তানে চলে গেছে। মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র অভাগারাই বাংলাদেশে রয়ে গেছে। তিনি আরও জানালেন, ঘরের সাধারণ আসবাব বিক্রি করেই তিনি কষ্টেসৃষ্টে পরিবার-পরিজন নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। কতিপয় দুষ্কৃতকারীর কৃতকর্মের। জন্যই বৃহৎ অবাঙালি জনগােষ্ঠী আজ বাঙালিদের রুদ্ররােষের শিকার হয়েছে। আমি রশিদ ভাইকে আশ্বস্ত করলাম, যেকোনাে বিপদে আমি তাদের রক্ষার জন্য এগিয়ে আসব।
একই দিন দুপুরে মিরপুরে দায়িত্বপ্রাপ্ত ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সৈনিকেরা অপ্রত্যাশিতভাবে মহাদুর্ভোগে নিপতিত হয়। সারা বাংলাদেশে যেসব বিহারি দুবৃত্ত বাঙালি নিধনে অংশ নিয়েছিল, তাদের বৃহৎ অংশ স্বাধীনতালাভের পর মিরপুর এলাকায় আত্মগােপন করে। এদের অবস্থান সম্পর্কে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের

সৈনিকেরা কোনাে ধারণাই পায়নি। তারা যে মুহূর্তে মিরপুরের একটি রাস্তায় তল্লাশি অভিযান চালাতে যায়, সশস্ত্র বিহারিরা অতর্কিত তাদের ওপর হামলা করে। হঠাৎ আক্রমণে বাঙালি সৈনিকদের ৩৯ জন নিহত হয় এবং ৫০ জন। মারাত্মকভাবে আহত হয়। আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন বীর মুক্তিযােদ্ধা সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সেলিম শহীদ হয় এবং লেফটেন্যান্ট হেলাল মাের্শেদ গুরুতর আহত হয়। | পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিহারিরা এভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর চড়াও হবে, এটি কেউ ভাবতেও পারেনি। পরবর্তীকালে এ জন্য তাদের চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। খ্যাতনামা লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সারকে মিরপুরে খুঁজতে গিয়ে তাঁর ভাই চিত্রপরিচালক জহির রায়হানও বিহারিদের হাতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। মিরপুরের তুলনায় মােহাম্মদপুরের অবাঙালিরা শান্তশিষ্ট, সজ্জন ব্যক্তি ছিল। বলে আমরা কোনাে বিরূপ পরিস্থিতির সম্মুখীন হইনি। [1, pp. 119–122]

References:
[1] হাফিজ উদ্দিন, সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পচাত্তর [Military life, seventy one the pride, seventy five the blood bath], 1st ed. Prothoma, 2020.

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!