রায়গঞ্জ থানা রেইড
ভূমিকা
সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার উপর মুক্তিযােদ্ধাদের রেইড পরিচালনা মুক্তিযুদ্ধের গতিকে আরও সচল করেছিল। এক দিকে যেমন নতুন নতুন মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তেমনি অন্যদিকে তারা বিভিন্ন যুদ্ধে শত্রুর মােকাবিলা করছিলেন। রায়গঞ্জ থানার উপর তেমনি একটি নব্য প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধার দল রেইড পরিচালনা করেছিলেন। যদিও এ রেইডে মুক্তিযােদ্ধারা সফলতা পান নি তবুও এটি তাদের ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার সুযােগ করে দিয়েছিল।
পটভূমি
সদ্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে ছড়িয়ে পড়লে তাদের কাছে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিল নিতান্তই অপ্রতুল। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চপর্যায় থেকে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ সগ্রহ করার নির্দেশ আসে। এমনি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সিরাজগঞ্জ জেলার রায়গঞ্জ থানার মুক্তিযােদ্ধারা রায়গঞ্জ থানা আক্রমণ করে অস্ত্র ও রসদ সংগ্রহের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জায়গার বর্ণনা ও ভূমি পরিচিতি রায়গঞ্জ থানাটি রায়গঞ্জ উপজেলার ধানগড়া ইউনিয়নে অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ শহর থেকে ২৪-২৫ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। এ অপারেশনের লক্ষ্যবস্তু ছিল পুলিশ স্টেশন এবং জায়গাটি ছিল খােলা মাঠের মধ্যে। থানার আশপাশের এলাকাটি ছিল সমতল ভূমি। সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে বগুড়া যাওয়ার রাস্তার। পাশে রায়গঞ্জ থানার অবস্থান। এ থানার অদূরে যমুনা নদীর শাখা প্রবাহিত। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: পুলিশ ও রাজাকার ৬০জন, অস্ত্র (৩০৩টি | রাইফেল, এসএলআর, এলএমজি)। খ. মুক্তিবাহিনী: ৮০জন মুক্তিযােদ্ধা, অস্ত্র (২৫টি এসএলআর, ১৫টি এসএমসি, ৪০টি .৩০৩ রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড)। শত্রুপক্ষের অবস্থান। শত্রুপক্ষের অবস্থান ছিল রায়গঞ্জ থানার পুলিশ ক্যাম্প। এখানে পুলিশ ও রাজাকার মিলে চতুর্মুখী অবস্থান গ্রহণ করে।
যুদ্ধের বর্ণনা
এ রেইডটি পরিচালনা করা হয় ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর। রেইডটির উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর পুলিশ স্টেশন রেইড করে ধ্বংস করা এবং কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করা। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা অনুযায়ী রায়গঞ্জ থানাকে শত্রুমুক্ত করতে হলে রায়গঞ্জ থানা ধ্বংস করার প্রয়ােজন ছিল অনিবার্য। তাই পরে রেইড করে শত্রু ধ্বংসের চেষ্টা করা হয়, কিন্তু তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী রেইড ব্যর্থ হয়। এ রেইডে যারা অংশগ্রহণ করেন তাঁরা হলেন:
১. শেখ আলাউদ্দিন (অধিনায়ক)
২. আবুল মােমেন
৩. আলী আশরাফ
৪. আহমেদ হােসেন (শহিদ হন)
৫, ইছাহাক হােসেন তালুকদার।
৬. রউস উদ্দিন জয়নাল
৭. মজিবর রহমান
৮. আশরাফ আলী
৯. রফিকুল ইসলাম
১০. ময়েজ উদ্দিন।
১১. মঈন উদ্দিন
১২. রেজাউল করিম
১৩. আজমল
১৪, মতিউর রহমান
১৫. কোবাদ হােসেন।
১৬. ফিরােজ
১৭, মনিরুজ্জামান
১৮. আব্দুল মােতালিব
প্রমুখ। স্থানীয় লােকজনের মাধ্যমে জানা যায় থানায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের কথা। মুক্তিবাহিনী অবস্থান নেয় লক্ষ্মীখােলা গ্রামে। সবাই রাত ৯টায় রায়গঞ্জ গােরস্থানে মিলিত হন। দল ভাগ করা হয় ৩ ভাগে। ১টি গ্রুপ থানা রােডের পূর্বে, ১টি গ্রুপ পশ্চিমে এবং ১টি গ্রুপ উত্তরে অ্যাকশন পার্টি হিসেবে অবস্থান নেয়। পূর্ব দিকের গ্রুপ ভুলবশত থানার দিকে হাঁটা শুরু করে। পাকিস্তানি বাহিনী তখন তাদের দেখতে পেয়ে ফায়ার শুরু করে। এ রেইডে আহমেদ হােসেন শহিদ ও রফিকুল আহত হন। এ যুদ্ধ সাফল্য অর্জন করতে ব্যর্থ হয়।
বিশ্লেষণ/পরাজয়ের কারণ ও পর্যালােচনা
ক, মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পনা ও দিকনির্দেশনা সঠিক ছিল না, যে কারণে তারা প্রধান সড়ক ব্যবহার করে সহজে পাকিস্তানি বাহিনীর নজরে পড়ে যায়।
খ, থানা রেইড করার জন্য কার্যকরী দল ঠিকমতাে থানা এলাকায় প্রবেশ করে শত্রুকে ঘায়েল করার সুযােগ পায় নি। গ. রেইড পরিচালনা করার জন্য যে পরিমাণ প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রের প্রয়ােজন, তার যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। শিক্ষণীয় বিষয় ক. রেইডের মতাে একটি কঠিন অপারেশনের জন্য দরকার সুপ্রশিক্ষিত বাহিনী এবং প্রয়ােজনীয় অস্ত্র ও বিস্ফোরক। আর এ দুইয়ের নিখুঁত সমন্বয়ই পারে এ জাতীয় জটিল অপারেশনে সম্পূর্ণ সফলতা এনে দিতে। শত্রু সম্পর্কে উপযুক্ত ধারণা ব্যতিরেকে যে-কোনাে যুদ্ধে শত্রুকে পরাস্ত করা একটি কঠিন কাজ।
গ. রেইডের মতাে জটিল অপারেশনের পরিকল্পনা নিখুঁত এবং নির্ভুল হওয়া বাঞ্ছনীয়।
উপসংহার
এ যুদ্ধে পরিকল্পনা এবং যথার্থ রণকৌশলের প্রচুর ঘাটতি থাকার কারণে শক্রকে পরাস্ত করা সম্ভব হয় নি। মুক্তিবাহিনী কর্তৃক এ রেইডে সশস্ত্র বাহিনীর কোনাে সদস্য ছিল না বিধায় রেইডটি পরিচালনার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রের যথেষ্ট ঘাটতির কারণে সম্পূর্ণ সফলতা অর্জিত হয় নি।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড