You dont have javascript enabled! Please enable it!

মানা-নূতনে পুরাতনে

সুদেব রায় চৌধুরী 

মানা (মধ্যপ্রদেশ), ১৬ জুন- আজ সকালে রুশ বিমান থেকে রায়পুর বিমানঘাটিতে নামতেই দেখি একদল মেয়ে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে। পরণে নীল শাড়ি। গলায় স্কার্ফ। শরণার্থীরা বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই নীল শাড়ি পরা এই সব মেয়ে তাঁদের কাছে ছুটে গেলেন। হাত ধরে তাদের নিয়ে গেলেন লরির কাছে। দশ বছর আগে এই সব দেখে-শুনে আমার মনে হয়েছে যে, বাংলাদেশের এই সব শরণার্থী তাদের দেশকে, দেশের মাটিকে ভুলতে পারেননি। স্বাধীন বাংলার দিকে তারা তাকিয়ে আছেন। রেডিও খােলেন। যদি কোন আশা মেলে এবং স্বাধীন বাংলা হলে নিশ্চয়ই আবার দেশে ফিরে যাবেন। মেয়ে বাপ-মার সঙ্গে দেশ ছেড়ে এখানে এসে বাসা বাঁধেন। আজ তাঁরাই স্বাগত জানাতে এসেছেন তাঁদেরই ফেলে-আসা গ্রামের মা-ভাই-বােনদের ।

বিমানঘাটি থেকে নওগা শরণার্থী শিবিরে গেলাম। সেখানে প্রায় দশ হাজার শরণার্থী এরই মধ্যে চলে এসেছেন। শুধু হিন্দু নয়, মুসলমান, খ্রিস্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের শরণার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছি।যশােহর জেলায় হাসিনা বেগম আমার হাত জড়িয়ে বললেন, ‘বাবা, আমরা কি আর দেশে ফিরা যাতি পারব না।’ হাসিনা বেগম তাঁর স্বামীকে হারিয়েছেন। পাকসৈন্যের গুলিতে তাঁর স্বামী মারা যান । ছ মাসের ছেলে কোলে জড়িয়ে হাসিনা বেগম বললেন, স্বাধীন বাংলা না হলি আর দেশে ফিরছি না। পাশেই একটি তাবুর ভিতরে ফরিদপুর জেলার বাগের গ্রামের শ্রীমতী অঞ্জলি মন্ডলের সঙ্গে আলাপ হল। তাঁবুতে ঢুকতেই তিনি বললেন, এই দেখুন আমার জায়ের ছেলে। দশ বছর আগেই মানায় আইছে। আমি ‘আসতে পারছি শুইন্যা আমাকে দ্যাখতে আইছে’। নওগাঁও এবং মানাভাটা শিবিরে প্রায় ষাট হাজারের মত শরণার্থীর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মানা শিবিরের চীফ কম্যান্ডান্ট করনেল শান্তিপদ নন্দী জানালেন, এরই মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার শরণার্থী এই দু জায়গায় এসে গিয়েছেন। তিনি বলেন, জায়গা এখানে আছে। কিন্তু ত্রিপলের খুবই অভাব।এখানে প্রতিটি শরণার্থীকে চাল, ডাল, আলু, পিয়াজ প্রভৃতি ১১টি জিনিস সরবরাহ করা হচ্ছে।

মানাভাটা শরণার্থী শিবিরের আন্না দেবী যশােহর জেলার বিরামপুর গ্রাম থেকে এসেছেন। সঙ্গে তাঁর পরিবারের দশজন লােক। আন্না-দেবীর কাছে প্রশ্ন করলাম, ‘মানা আপনার কেমন লাগছে?’ প্রশ্ন শেষ না করতেই আন্নাদেবী বললেন, আইছি ত পরশুদিন। চাল, ডাল, আলু, পিয়াজ, তেল সবই পাইছি। কাষ্ঠের অভাবে জ্বালাইয়া রান্নাড়া করতি পারতিছি না। দেখে-শুনে জায়গাটা ভালই লাগতেছে।

তাঁবুতে তাঁবুতে ঘুরে দেখলাম তাঁদের মধ্যে অনেকের কাছে ট্রানজিসটার। স্বাধীন বাংলার বেতারকেন্দ্র খুলে অনেকে রেডিও শুনছেন। ট্রানজিসটারের চারপাশে লােক। এছাড়া শেখ মুজিবরের কতকগুলি টেপরেকরড করা বক্তৃতাও অনেকে বাজিয়ে শুনছেন।

দেড় ঘণ্টার বিমান-পথ 

দমদম বিমানঘাঁটি থেকে মানা-পাঁচশ মাইল। দেড় ঘণ্টার পথ। বিমানে আসবার সময় ভেবেছিলাম এখানেও বােধ হয় পশ্চিমবঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলির মতাে বিশৃংখলাই দেখতে পাব। কিন্তু তা এখানে দেখতে হয়নি। এখনও পর্যন্ত মানা প্রতিটি শরণার্থীকে স্নেহের সঙ্গে কোলে টেনে নিয়েছে। মানা শিবিরে পুরানাে উদ্বাস্তু সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ। তারা আজ কোন না কোনভাবে পুনর্বাসিত। নতুন। শরণার্থীদের আগমনে তাঁদের পুরানাে স্মৃতি জেগে উঠছে। পুরানাে ও নতুনে মানা শিবির আজ মুখর।

১৭ জুন ‘৭১

Reference: ১৭ জুন ১৯৭১, দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!