স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি কত দূর?
প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী গিয়েছিলেন ইসলামপুরে। আশ্বাস দিয়েছেন শরণার্থীদের। ঠেলে পাঠান হবে না তাদের বাংলাদেশে। ওদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আগে দরকার সেখানে নিরাপত্তার পরিবেশ। দরকার ছিল এ আশ্বাসের। প্রধানমন্ত্রী নিজেই একসময় বলেছিলেন ছয় মাসের মধ্যেই শরণার্থীরা ফিরে যাবেন নিজেংেদর বাড়ীঘরে। ভুল হয়েছিল সব হিসাব-নিকাশে; পরিস্থিতিটা পাল্টেগেছে একেবারে। তবে ফিরতে পারবেন শরণার্থীরা তা এখন নিশ্চয় করে বলা মুস্কিল। ওদের প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করার জন্য নয়াদিল্লী চান বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। এ সমাধান বলতে তারা বুঝেন জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ এবং মুজিবুরের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর। ওটা করবেন ইসলামাবাদ। বিদেশী মহলে চলছে প্রকাশ্য এবং গােপন কূটনৈতিক তৎপরতা। বিভিন্ন ধরনের পরিকল্পলা নিয়ে ঘুরাঘুরি করছেন অনেকে। তার মধ্যে একটি কনফেডারেশন। বিবদমান পক্ষ দুটির মধ্যে একজন ইয়াহিয়া খান এবং অপরজন শেখ মুজিবুর রহমান। পাক-কারাগারে বন্দী রয়েছেন শেখ সাহেব। তাঁকে ঘিরে চলছে বিচারের প্রহসন। বাংলাদেশে স্বাধীন সরকার বাস্তব। বিস্তৃত অঞ্চল তাদের দখলে। মুক্তি বাহিনীর মারের চোটে পাক সৈন্যরা ব্যতিব্যস্ত। মুজিবের হয়ে কথা বলার একমাত্র অধিকারী এই স্বাধীন সরকার। তাদের মতামতের উপরই নির্ভর করবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের যেকোন পরিকল্পনার সার্থকতা।
কদিন আগে ডি পি ধর এসেছিলেন কলকাতায়। পররাষ্ট্র দপ্তরের নীতি নির্ধারক কমিটির চেয়ারম্যান তিনি। গিয়েছিলেন মুজিবনগরে। দেখা করছেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সঙ্গে। জেনে নিয়েছন তাদের মনােভাব। স্পষ্টই বলছেন শ্রীডি পি ধর—স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন কথাই ভাবছেন না তারা। লড়াই করে বাংলাদেশ ছাড়া করবেন তারা পাক-সৈন্যদের। মুক্তিবাহিনীর হাতিয়ার আগের চেয়ে এখন বেশী শান্তি। যতদিন বাংলাদেশ সরকারের মনােভাব রইবে অপরিবর্তিত ততদিন এই চরম সমাধানের কথাই মনে রাখতে হবে নয়াদিল্লীকে। মাঝখানে থাকবে না কোন জোড়াতালির ইঙ্গিত। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছে তাতে বাংলাদেশ সরকারের মনােভাব পরিবর্তনের সম্ভাবনা কম। বহু রক্ত ঢেলেছেন তারা। গােটা জাতির সঙ্কল্প দৃঢ়তা বিস্ময়কর। জয়লাভ সম্পর্কে তাদের মনে নেই কোন দ্বিধা। শ্রীধর নিজেও উপলিব্ধ করেছেন। তার গভীরতা। ভারতের উদ্বেগ শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন নিয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে নিরাপত্তার পরিবেশ সৃষ্টির মৌল শর্ত স্বাধীনতা। তার পূর্ণে প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত শরণার্থীদের থাকতে হবে ভারতের আশ্রয়ে। এদিকে বাংলাদেশের অবস্থাও সুবিধা নয়। মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বেপরােয়া হয়ে উঠছে পাক-বাহিনী। তাদের অধিকৃত অঞ্চলে সাধারণ মানুষের উপর চলছে দলবদ্ধ অত্যাচার। বন্যায় জলে অবরুদ্ধ দুর্গত মানুষগুলাে জল কমে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রাণের দায়ে নতুন শরণার্থীর পাড়ি জমাবে ভারতে। ইতিমধ্যেই আশী লক্ষের কোঠা ছাড়িয়ে গেল তাদের সংখ্যা। দেরী লাগবে না কোটির ঘরে পৌছাতে। পশ্চিম বাংলা নুইয়ে পড়েছে শরণার্থীর ভারতে অন্যান্য রাজ্যে তাদের পাঠাবার কাজ খুবই মন্থর এ সম্পর্কে সরকারের আন্তরিকতায় জাগছে বিভিন্ন মহলের সংশয়। পুনর্বাসন মন্ত্রী শ্রীখাদিলকার দিচ্ছেন নানা রকমের অজুহাত। রেল লাইনের কাছাকাছি মিলবে না জলের সুবিধাযুক্ত উপযুক্ত স্থান, শিবির নির্মানে জিনিসপত্রের অভাব—আরও কত কি। তার উপর বৃষ্টি এর বন্যায় সৃষ্টি করেছে। নিদারুণ সঙ্কট। এসব অজুহাতে অনেকগুলােই পুরান। তবে বৃষ্টি এবং বন্যাটা নতুন। এর ব্যাপকতা বেড়েছে মাত্র দু’সপ্তাহ আগে। শরণার্থীদের ভরসা পােষণের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছেন কেন্দীয় সরকার। ইতিমধ্যেই ব্যয় হয়েছে একশ বিশ কোটি টাকা। আগামী ছ’মাসে দরবার পড়বে তিনশ’ ষােল কোটি টাকার। বাইরের থেকে পাওয়া গেছে যে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি তার পরিমাণ প্রায় দু’শ কোটি টাকা। কিন্তু হাতে এসেছে মাত্র আশী কোটি চল্লিশ লক্ষ টাকা। বাকিটার দশা কি হবে তার অজানা। এসব তথ্য দিয়েছেন শ্রীখাদিলকার নিজে কতদিনে স্বাধীন হবে বাংলাদেশ তা বলতে পারছেন না কেই। বলাটাও সম্ভব নয়। স্বাধীন না হলে স্বদেশে ফিরতে পারবেন না শরণার্থীরা। অন্য ধরণের কোন সমাধানের কথাও বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক। কল্পনার বাইরে তা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। সুতরাং শরণার্থীদের ভারতে অবস্থানের মেয়াদ অনির্দিষ্ট। জাতীয় স্বার্থের তাগিদে তুরান্বিত করা দরকার, স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষ প্রতিষ্ঠা। তার প্রথম ধাপ স্বাধীন সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদান। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিলেই লড়বে বাধাবে পাকিস্তান—এ আশঙ্কার ভার কেটেছে অনেকখানি ভারতসােভিয়েট মৈত্রী চুক্তি ইসলামাবাদের সম্ভাব্য হারকারিতার প্রতিষেধক। সুতরাং কেন আর কাল হরণ?
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১ সেপ্টেম্বর ১৯৭১