You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের সংগ্রামের পূর্বকথা। মুজিবরের অতীত
(রাজনৈতিক সংবাদদাতা)

ঢাকায় পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের তেসরা মার্চ অধিবেশন বাতিল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান গণআন্দোলন আহ্বানের সঙ্গে সঙ্গে নিজ দল ও অন্যান্য দলের মধ্যে ঐক্যের ভিত্তিতে বাঙালির সর্বব্যাপী একটি বিরাট সুসংবদ্ধ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য সাংগঠনিক প্রস্তুতি শুরু করেন।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ছাত্রাবস্থায় শেখ মুজিবের রাজনীতিতে হাতেখড়ি কলকাতায় নেতাজী সুভাষের কাছে, তার বয়স মাত্র সতের। তখন থেকেই মুজিব কলকাতার বিপ্লবী আন্দোলনে যােগ দেন এবং নেতাজী ও শ্রদ্ধেয় শরৎ বসু মহাশয়ের অত্যন্ত প্রিয় হয়ে ওঠেন। তখন ত্রিশ দশকের মাঝামাঝি এবং নেতাজী তখন স্বদেশে এবং বিদেশে বহু ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে যােগাযোেগ রেখেছেন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে তােলার জন্য।
মুজিব নেতাজীর এই সাংগঠনিক প্রস্তুতির অবস্থায় তাঁর সান্নিধ্যে আসেন। উনিশশ তেত্রিশ সালে নেতাজী তার মৌলিক রাজনৈতিক দর্শন উপস্থাপিত করেন লন্ডনে এক ছাত্র সভায়। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী সংগ্রাম এবং সাম্যবাদ’। এই বক্তৃতায় ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী আন্দোলন ব্যাপক হওয়া সত্ত্বেও আপসমুখী নেতৃত্বের জন্য কীভাবে পঙ্গু হয়ে গেছে তার এক বিরাট ইতিবৃত্ত নেতাজী তুলে ধরেন।
মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের অবশ্যই বিরােধী তিনি ছিলেন না। কিন্তু নেতাজী আন্দোলনের স্তর উন্নয়ন সম্পর্কে একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা সভায় উপস্থাপিত করেন। তিনি আন্দোলনের সাফল্যের জন্য চারটি প্রাথমিক পদক্ষেপের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন :
(এক) সরকারের কর এবং অন্যান্য রাজস্ব আদায় সম্পূর্ণ বানচাল করার ব্যবস্থা।
(দুই) সরকারি প্রশাসন, পুলিশ এবং সম্ভব হলে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে জাতীয় আন্দোলনের প্রতি সমর্থন ও সহানুভূতি সষ্টির প্রচেষ্টা করা যাতে আন্দোলন দমন করার সরকারি নির্দেশ কার্যকরী না হয়।
(তিন) আন্দোলন চলাকালীন সরকারের সঙ্কটময় মুহূর্তে সমস্ত সরকারি সরবরাহ খাদ্য, অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য সবকিছু বিচ্ছিন্ন করার জন্য সুসংগঠিত ব্যবস্থা এবং (চার) শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সশস্ত্র প্রচেষ্টা।
নেতাজী তার বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, প্রথম তিনটি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারলে সরকারি প্রশাসন যন্ত্র ছন্নছাড়া হয়ে যাবে আর সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল হওয়ার ফলে আন্দোলন জয়ের পথে এগিয়ে যাবে। এই বক্তৃতায় নেতাজী ঠিক কোন স্তরে বিপ্লব সশস্ত্র আকার নেবে তার কোনাে উল্লেখ করেননি। তিনি শুধু বলেছিলেন, গান্ধীর নেতৃত্বে বিপ্লব ঠিক পূর্বোক্ত পথে এগােয় নি তা ব্যর্থ হয়েছে।
শেখ মুজিবর রহমানের কাছে নেতাজীর এই বক্তৃতা প্রথম রাজনৈতিক জ্ঞানােদয়ে সাহায্য করেছে এবং এবারের পূর্ববাংলার মুক্তি আন্দোলন সংগঠনে প্রথম রাজনৈতিক দীক্ষার ছাপ সুস্পষ্ট। প্রথমেই মুজিব আন্দোলনের লক্ষ্যে স্থির, হয় সরকার তার ছয় দফা দাবি মেনে নিক, অন্যথায় তার সংগ্রাম আপসহীন। আন্দোলনের কৌশল অবশ্যই অহিংস-অসহযােগ, কিন্তু হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রয়ােজনীয়তার কথাও তিনি তার বক্তৃতায় অনেক দিন থেকেই বলে আসছেন। আক্রমণ হিংস্র এবং বীভৎস পর্যায়ে যেতে পারে এই ধারণা তাঁর এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের ছিল এবং সেই অনুযায়ী বিভিন্ন পর্যায়ে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশে সাংগঠনিক প্রস্তুতিও করেছেন লীগ নেতারা।
দোসরা মার্চ থেকে অসহযােগ আন্দোলনের প্রথম পর্যায় চলে চৌদ্দই মার্চ পর্যন্ত। তারপর শুরু হয় দ্বিতীয় পর্যায় এবং শেখ মুজিবর ঘােষণা করেন তার পঁয়ত্রিশ দফা নির্দেশ। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বীরত্বপূর্ণ গণসংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যারা স্বাধীনতার জন্য জীবনপণ সংগ্রাম করছেন তারা যেন আমাদের সংগ্রামকে বিশ্ব জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবে মনে করেন। বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রমাণ করেছে কীভাবে তাদের সংগ্রামী ঐক্য ও দৃঢ়তা পাশবিক শক্তির দ্বারা স্বাধীনতাকে যারা নিস্পিষ্ট করতে চায় সেই ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শক্তিশালী দুর্গে পরিণত করতে পারে।
আজ বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ-পুরুষ, মহিলা এমনকি শিশুরা পর্যন্ত উন্নতশির। নগ্নহিংসা দিয়ে যারা মানুষকে অবদমিত করতে চেয়েছে তারা আজ পর্যুদস্ত। সরকারি ও অফিস কর্মচারী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র, বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ নিশ্চিতভাবে ঘােষণা করেছে যে, তারা আত্মসমর্পণের পরিবর্তে আত্মদানে প্রস্তুত।
‘সামরিক আইন অনুসারে নির্দেশ জারি করে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন থেকে নিরস্ত করার জঘন্য প্রচেষ্টা চলছে। বাংলাদেশের সমস্ত মানুষ সামরিক আইনের সামনে অবনমিত না হওয়ার দৃঢ়তায় ঐক্যবদ্ধ। যাদের বিরুদ্ধে এই নির্দেশ ঘােষিত হয়েছে তাদের নির্দেশ অমান্য করতে অনুরােধ জানাই। বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি লোেক তাদের এবং তাঁদের পরিবারবর্গের সমর্থনে বদ্ধপরিকর। দমননীতির দ্বারা বাংলাদেশের মানুষকে যেমন দমানাে যায়নি, সেভাবে এই সমস্ত কর্মচারীদের উপর সামরিক নির্দেশও ব্যর্থ হতে বাধ্য।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন করা যাবে না। আমরা অজেয় কারণ প্রয়ােজন হলে আমরা মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত- যাতে আমাদের ভবিষ্যত বংশধররা স্বাধীনতা ও সম্মানের সঙ্গে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারে। তাই আমাদের সংগ্রাম নতুন উদ্যমে উদ্দেশ্য সিদ্ধ না হওয়া পর্যন্ত এগিয়ে যাবে। যে কোনাে আত্মত্যাগের জন্য আমি মানুষকে প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাই এবং আন্দোলনকে হিংসার দ্বারা দমন করা সমস্ত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার আহ্বান জানাই।
পনেরােই মার্চ থেকে আন্দোলন সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নতুন নির্দেশ নিম্নে দেয়া হলাে। সরকারি সংস্থা সম্পর্কে এক নং নির্দেশ : সারা বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক
বিচারালয় ও অন্যান্য বিচারালয় নিম্নে বর্ণিত নির্দিষ্ট নির্দেশ এবং বিভিন্ন সময় প্রচারিত ব্যাখ্যা সাপেক্ষে হরতাল পালন করবে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ
দুই নং নির্দেশ : বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা
তিন নং নির্দেশ : (ক) ডেপুটি কমিশনার ও সাব ডিভিশনাল অফিসাররা কোনাে অফিস না খুলে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার এবং এসব নির্দেশ পালন করার জন্য যেসব উন্নয়নমূলক কাজকর্মের প্রয়ােজন সেসব সমেত অন্যান্য কর্তব্য সম্পন্ন করবেন।
কর্তব্যকর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে ঘনিষ্ট যােগাযােগ রক্ষা এবং তাদের সঙ্গে সহযােগিতায় কাজ করবেন।
(খ) পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কর্তব্য সম্পাদন করবেন, যদি প্রয়ােজন হয় আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকদের সাহায্যে।
(গ) জেলরক্ষী ও জেলের অফিসাররা সক্রিয় থাকবেন।
(ঘ) আনসাররা তাদের কর্তব্য করে যাবেন।
চার নং নির্দেশ : পাের্ট কর্তৃপক্ষ সর্বক্ষেত্রে সক্রিয় থাকবেন, জাহাজ চলাচল করবে। কিন্তু পাের্ট কর্তৃপক্ষের সেই শ্রেণীর অফিসাররা কাজ করবেন, সুষ্ঠুভাবে জাহাজ চলাচলের জন্য যাদের প্রয়ােজন। শুধু জনগণকে দমনের জন্য ব্যবহার্য সৈন্যদল ও অস্ত্রশস্ত্র সমবেত করার জন্য কোনাে সহযােগিতা করা হবে না। সমস্ত জাহাজ, বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য খাদ্যশস্য বহনকারী জাহাজ থেকে মাল খালাস যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেই চেষ্টা পুরােদমে করতে হবে। বন্দর ক্তৃপক্ষ বন্দরের প্রাপ্য এবং জাহাজের বন্দর প্রবেশের জন্য দেয় অর্থ আদায় করবেন।
আমদানি
পাঁচ নং নির্দেশ : বন্দরে প্রবেশকারী সমস্ত জাহাজ থেকে দ্রুত মাল খালাস করতে হবে। শুল্ক বিভাগের প্রয়ােজনীয় শাখা এই ব্যাপারে কাজ করবে মাল খালাসের অনুমতি দেবে। তার আগে যে পরিমাণ শুষ্ক ধার্য হবে সেটা ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে একটি বিশেষ অ্যাকাউন্ট খুলে জমা দিতে হবে। এই অ্যাকাউন্ট আওয়ামী লীগের নির্দেশ অনুযায়ী শুল্ক বিভাগের কালেক্টর অপারেট করবেন। এই আদায়ীকৃত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিলে জমা করা হবে না।
রেলপথ
ছয় নং নির্দেশ : রেলওয়ে সক্রিয় থাকবে, কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষের শুধুমাত্র সেই অফিস যা রেল চালানাের জন্য প্রয়ােজনীয়। জনগণকে দমনের জন্য সৈন্যবাহিনী বা অস্ত্রশস্ত্র আনার ব্যাপারে কোনাে সহযােগিতা করা হবে না। বন্দর থেকে দেশের মধ্যে খাদ্যশস্য চলাচলের জন্য রেলওয়ে ওয়াগন সরবরাহকে সবচেয়ে জরুরি বলে গণ্য করতে হবে।
পরিবহন
সাত নং নির্দেশ : আন্তর্দেশীয় নদীকেন্দ্রিক বন্দর সুষ্ঠুরূপে চালু রাখার জন্য ই পি এস সি এবং আন্তর্দেশীয় নদী পরিবহন এবং টি ডব্লিউ টি এর প্রয়ােজনীয় স্বল্পসংখ্যক কর্মচারী কাজ করবেন, কিন্তু জনগণকে দমনের উদ্দেশে সৈন্যবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহে কোনাে সহযােগিতা করা যাবে না।
ডাক ও তার
আট নং নির্দেশ : শুধু বাংলাদেশের মধ্যে চিঠিপত্র টেলিগ্রাম ও মনি অর্ডার বিলি করার জন্য ডাক ও তার বিভাগ কাজ করবে। বিদেশি মেল সার্ভিস এবং সবশ্রেণীর বিদেশি টেলিগ্রাম সংশ্লিষ্ট দেশগুলােতে সরাসরি পাঠানাে যেতে পারে। ইন্টার-উইং টেলিপ্রিন্টার চ্যানেল তিনটি থেকে চারটে পর্যন্ত অর্থাৎ এক ঘণ্টার জন্য ভােলা থাকবে সােমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার শুধুমাত্র পঁচিশ নং নির্দেশ অনুযায়ী বিভিন্ন বার্তা যাতে ব্যাঙ্কগুলাে টেলিপ্রিন্টারে পাঠাতে ও গ্রহণ করতে পারে।

সূত্র: দর্পণ
০২.০৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!