পিকিং-এ উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল
প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি হিসেবে ভুট্টো নেতৃত্ব করছেন
উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে
(সালামত আলী প্রেরিত)
ইসলামাবাদ, ৫ই নভেম্বর। -জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে আট সদস্যবিশিষ্ট্য একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল আজ সকালে একটি বিশেষ বিমানযোগে এখান থেকে চীন রওয়ানা হয়ে গেছেন। দু’দেশের মধ্যে অব্যাহত আলোচনার অংশ হিসেবে গণচীনের আমন্ত্রণক্রমে এই প্রতিনিধিদল চীনে গেছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধি হিসেবে জনাব ভুট্টো দলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
কয়েকদিনব্যাপী চীনে অবস্থানকালে প্রতিনিধিদলটি প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ও অন্যান্য নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন বলে জানা গেছে। পিপিপির চেয়ারম্যান জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো ছাড়াও প্রতিনিধিদলে রয়েছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান সেনাপতি এয়ার মার্শাল এ রহিম খান, পররাষ্ট্র সেক্রেটারী জনাব সুলতান মোহাম্মদ খান, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চীফ অব জেনারেল স্টাফ লেঃ জেনারেল গুল হাসান খান, পাকিস্তান নৌবাহিনীর চীফ অব স্টাফ রিয়ার এডমিরাল রশীদ, পররাষ্ট্র দফতরের দুজন ডিরেক্টর জেনারেল জনাব আফতাব আহমদ খান ও জনাব তবারক হোসেন এবং পররাষ্ট্র দফতরের ডিরেক্টর জনাব আহমদ কামাল। অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সেক্রেটারী জনাব এম এ আলভী এখানে সাংবাদিকদের উক্ত প্রতিনিধিদলের চীন রওয়ানা হওয়ার বিষয়টি জানান।
জনাব আলভী প্রতিনিধিদলটিকে অত্যন্ত উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বলে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে, পাকিস্তান ও গণচীনের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনার ব্যবস্থা রয়েছে এবং অব্যাহত রীতির ভিত্তিতেই প্রতিনিধিদলটি পিকিং রওয়ানা হয়েছেন। তিনি বলেন যে, প্রতিনিধিদলটির সঙ্গে চীনের নেতাদের উভয় দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় এবং উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে।
প্রতিনিধিদলটি যেভাবে গঠন করা হয়েছে তাতে অস্ত্র আনার জন্য সেটি যাচ্ছে এরুপ আভাস রয়েছে কিনা এই মর্মে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন যে, চীন থেকে অস্ত্র সরবরাহ করাটা কোন নতুন কিছু হবে না। তিনি বলেন, যে ধরণের সহযোগিতা রয়েছে তা আপনাদের ভালই জানা আছে।
এই প্রতিনিধিদলের চীন যাত্রা একাধিক কারনে গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথমতঃ সম্প্রতি ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি রয়েছে এবং ভারত ইতিমধ্যেই রাশিয়া থেকে আরো অস্ত্র ও সমর্থন আদায়ের জন্য চুক্তিটি কাজে লাগিয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ দু’মাসেরও বেশী সময় যাবৎ পাকিস্তান ও ভারতের সসস্ত্র বাহিনীগুলোর প্রায় সমস্ত শক্তি সীমান্ত বরাবর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রয়েছে এবং যে কোন মুহূর্তে সার্বিক যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার মারাত্মক আশংকা রয়েছে।
তৃতীয়তঃ যদিও চীন সর্বদাই পাকিস্তানের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছে তবুও সাম্প্রতিক সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশেষভাবে ভারত ঘেঁষা বিবৃতিগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কোন কিছু এ যাবৎ পাওয়া যায়নি।
চতুর্থতঃ বর্তমানে ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য গণচীন কূটনৈতিক পর্যায়ে তৎপরতা চালানোর ক্ষমতা নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি বৃহৎ শক্তিতে পরিণত হয়েছে। কিছুদিন যাবৎ পাকিস্তান পাক-ভারত বিরোধ নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপনের যথার্থতা বিবেচনা করছে এবং এ ব্যাপারে বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে।
অতিরিক্ত পররাষ্ট্র সেক্রেটারী অবশ্য জানান যে, অবিলম্বে নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত বিরোধের প্রশ্ন উত্থাপনের কোন বিকল্প নেই। যাহোক চীন যেহেতু শীঘ্রই নিরাপত্তা পরিষদে বসবে এবং যেহেতু কোন না কোন বৃহৎ শক্তি অথবা সেক্রেটারী জেনারেল উথান্ট কর্তৃক নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতির বিষয়টি উত্থাপনের সম্ভাবনা রয়েছে।
কাজেই প্রতিনিধিদলটি পিকিং-এ অবস্থানকালে স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যাপারে আলোচনা করবে। প্রতিনিধিদলটির গঠন প্রকৃতি এই মর্মে আভাস বহন করে যে, পাক-ভারত বিরোধের সামরিক ও কুটনৈতিক দিকসহ সকল বিষয়ে পুর্ণাঙ্গ আলোচনার ইচ্ছা রয়েছে।
ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তার তিনটি সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন করায় প্রতিনিধিদলে পাকিস্তানের তিনটি সশস্ত্র বাহিনী সর্বোচ্চ পর্যায়ের কমান্ডারদের অন্তর্ভুক্তি তাৎপর্যপূর্ণ বলে গণ্য হচ্ছে। এপিপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়েছে, প্রতিনিধিদলটি চীনা নেত্রীবৃন্দের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র জানান যে, প্রতিনিধিদলটি চীনে কয়েকদিন অবস্থান করবেন।
প্রতিনিধিদলটি যেরুপ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন করে গঠন করা হয়েছে তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে সেটির প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ও চীনের অন্যান্য সংশ্লিষ্ট নেতা ও মন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কর্মসূচী রয়েছে। মুখপাত্রটি বলেন, গণচীন সাধারণতন্ত্রের আমন্ত্রনক্রমে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট একটি প্রতিনিধিদলকে পিকিং-এ প্রেরণ করেছেন।
পিকিং থেকে এএফপি পরিবেশিত খবরে বলা হয়, পর্যবেক্ষকরা মনে করেন যে, প্রতিনিধি দলটির এই আকস্মিক পিকিং সফর পাক-ভারত সীমান্তের উত্তেজনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এক বছর আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পিকিং সফরের পর এটাই গণচীন সফরকারী বৃহত্তম পাকিস্তানী প্রতিনিধি দল।
উক্ত খবরে বলা হয় যে, পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বর্তমানে রাজনৈতিক নেতা জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো মন্ত্রী থাকাকালে কয়েকবার পিকিং সফর করেছেন। ৬ বছর আগে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রাক্কালের তিনি শেষবারের মতো পিকিং সফর করেন।
এতে উল্লেখ করা হয় যে,পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পিপলস পার্টির নেতা জনাব ভুট্টো বর্তমানে কোন সরকারী পদে অধিষ্ঠিত নেই। এখানে পর্যবেক্ষকরা বলেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের বিরোধ এবং পূর্ব পাকিস্তানে তথাকথিত বাংলাদেশ বিদ্রোহের প্রতি জনাব ভুট্টো কঠোর মনোভাবাপন্ন মহলের সমর্থক বলে মনে হয়।
উক্ত খবরে বলা হয় ভুট্টো এমনি এক সময়ে পিকিং সফর করছেন, যখন ১৯৬২ সালের সীমান্ত সংঘর্ষের পর থেকে তিক্ত চীন-ভারত সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য উন্নতির আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তবে চীন অথবা ভারত কোন পক্ষই সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে কোন সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
গত সপ্তাহে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী চীনের জাতিসংঘভুক্তিতে অভিনন্দন জানিয়ে চীনের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর অভিনব কুটনৈতিক অস্ত্র টেবিল টেনিসকেও চীন-ভারত সম্পর্কোন্নয়নে ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমানে ভারতীয় টেনিস দল পিকিং-এ আফ্রো-এশীয় বন্ধুত্বমুলক টেবিল টেনিস টুর্নামেন্টে অংশ গ্রহণ করছে।
চীনের বন্ধুরাষ্ট্রের খেলোয়াড় দলকে সাধারণতঃ যেরুপ অভ্যর্থনা জানানো হয় ভারতীয় টেবিল টেনিস দলকেও সেরুপ অভ্যর্থনা জানানো হয়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের অবশ্য এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই যে, পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ও পাকিস্তানের বহু কারিগরি ও শিল্প প্রকল্পে সহযোগিতাকারী চীন প্রয়োজনে একনিষ্ঠতম বন্ধু হিসেবে পাকিস্তানের পাশে থাকবে।
তবে যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তানীদের সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করার জন্য চীনা সৈন্য পাঠানোর সম্ভাবনা নেই বলে তারা মনে করেন।
পিকিং উপস্থিতি
পিকিং থেকে রয়টার ও এএফপি পরিবেশিত খবরে প্রকাশ, প্রতিনিধিদলটি এখানে এসে পৌঁছেছেন। বিমানবন্দরে চীনের অস্থায়ী সহকারী প্রধানমন্ত্রী মিঃ চী পেং ফি প্রতিনিধিদলকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য উপস্থিত ছিলেন।
জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিহিত প্রায় ২ হাজার চীনা তরুণ তরুণী প্রতিনিধিদলটিকে স্বাগত জানায়। বিমানবন্দরে ব্যানারে লেখা ছিল পাকিস্তানের বিশিষ্ট মেহমানদের স্বাগত জানাচ্ছি।
এছাড়া তারা আফ্রো-এশীয় জনগণের সংহতি প্রকাশ করে ও বিদেশী আক্রমণ ও হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী জনগনের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন জানিয়ে শ্লোগান দেয়।
জনাব ভুট্টো পরে মিঃ চী পেং ফি-এর সঙ্গে পিকিং-এর রাষ্ট্রীয় মেহমানদের বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান।
Ref: দৈনিক পাকিস্তান ৬ নভেম্বর, ১৯৭১