আমি আমার ছেলে-মেয়েদেরকে ঢাকায় পাঠানোর জন্য ঢাকা যাওয়ার রাস্তা ঠিক আছে কিনা দেখার জন্য ১৩ ই এপ্রিল হোণ্ডা নিয়া ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া চলে যাই। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিসে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে পাক বাহিনী বিমান থেকে শেলিং আরম্ভ করে। পাকবাহিনী ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া ট্রেজারী অফিস ও রেলওয়ে স্টেশনের উপরেই বেশীরভাগ শেলিং করে। এই সময় ২ জন লোক মারা যায় এবং ৫-৬ জন লোক আহত হয়। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে রওনা হয়ে বিকালে তালশহর রেল ষ্টেশনে যখন পৌঁছাই তখন দেখতে পাই দক্ষিণে লালপুর বাজারে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প পাক বাহিনী বিমান আক্রমন চালাচ্ছে। প্রায় ১ ঘণ্টা এই আক্রমণ চলে, বিমান থেকে ব্যাপকভাবে শেলিং ও বোমা ফেলা হয়। খবর পাই এতে বহু মুক্তিযোদ্ধা হতাহত হয়।
রাত্রিতে আমি আশুগঞ্জ সোনালী ব্যাংকে অবস্থান করি। ১৪ এপ্রিল ৬ টার সময় থেকে আশুগঞ্জের উপর আক্রমন চলে। পাক বাহিনী হেলিকপ্টার করে আশুগঞ্জ ওয়াপদার পার্শ্বে অবতরন করে। পাক বাহিনীর এই অবস্থান সোনালী ব্যাংকের উপর থেকে নোয়াখালির একজন টেলিফোন অপারেটর দেখতে পায় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভৈরব ব্রীজের পূর্ব তীরে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে টেলিফোন যোগে খবর দেয়। সে নিজে দোতলার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে এবং আমাদেরকে বলে যে, যদি বাঁচতে চান তবে পালান।
মুক্তিবাহিনী তাদের অবস্থান গুটিয়ে সঙ্গে সঙ্গে ব্রাক্ষ্মনবাড়ীয়ার দিকে পিছু হটে যায়। পাক বাহিনী আশুগঞ্জ অবতরণ করার পর পরেই তারা সারা শহর চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং বৃষ্টির মত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই সময় সেখানে যে লোককে তারা পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। আমার মনে হয় যদি পাক বাহিনীর অবস্থানের খবর টেলিফোন অপারেটর মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে না জানাত, তবে একজন মুক্তিযোদ্ধাও সেদিন পাক বাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেত না। পাক বাহিনী পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে অগ্নীসংযোগ করে। আমরা আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পাই এবং কয়েকজন আমাদের ব্যাংকের দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে, তখন আমি পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে একটা চিপা গলি দিয়ে নদীর পাড়ে চলে আসি। নদীর পাড়ে এসে আরু কয়েকজন নরনারীকে অসহায় অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতে পাই। নদীর মাঝখানে একটা নৌকা বাঁধা ছিল। আমি সাঁতার কেটে নৌকাটাকে নদীর পাড়ে নিয়ে আসি এবং অসহায় লোকগুলিকে নৌকায় তুলে নিয়ে উত্তর দিকে পালিয়া যাই।
আমি যখন নদীর পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম, তখন আমি রাস্তার উপর ১৫-১৬ জন লোককে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই এবং অনেককে গুলি লেগে আহত অবস্থায় কাতরাতে দেখি। চারদিকে শুধু গুলি আর নারী-পুরুষদের করুণ চিৎকার ভেসে আসে।
অতঃপর আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া চলে আসি। আমি ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া পৌঁছেই দেখতে পাই যে ব্রাক্ষ্মণবাড়ীয়া থেকে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প তুলে নিয়ে ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার উত্তর দিকে তেলিয়াপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ বাদশাহ মিয়া
ম্যানেজার
শ্রীমঙ্গল সোনালী ব্যাংক
শ্রীমঙ্গল, সিলেট।
১৭.১০.৭৩ ইং