You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.12 | মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের নতুন কৌশল | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের নতুন কৌশল

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ নিজের স্বার্থে যেমন অপর দেশকে আক্রমণ করে, দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধাবার জন্য আর্থিক ও সামরিক সাহায্য দেয়, তেমনই তারা স্বীয় স্বার্থে মানুষের শান্তির আগ্রহকেও ব্যবহার করে। ভিয়েতনাম থেকে সৈন্য অপসারণ ও যুদ্ধ বিরতির কথা বলেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আর পাক-ভারত যুদ্ধবিরতির জন্য তারা রাষ্ট্রসংঘে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে। চীনও রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবকে সমর্থন করে শান্তির পরাকাষ্ঠা দেখাতে কুণ্ঠিত হয়নি। সাম্রাজ্যবাদের পতনের যুগে কেবল অপর দেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন নয়, শান্তির আগ্রহকে অত্যন্ত ধুর্তভাবে ব্যবহার কাই সাম্রাজ্যবাদীদের অন্যতম কৌশল। এটাই হচ্ছে শান্তিকামী রাষ্ট্রসমূহ এবং সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রকৃষ্ট উপায়। উপরন্তু এর ফলে সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন নীতিকে সাময়িকভাবে গােপন করা চলে। সাম্রাজ্যবাদের অনুসৃত এই পথকে অনুসরণ করে চীনও অনুরূপ কৌশল অবলম্বন করেছে।
রাষ্ট্রসংঘে সমাজতান্ত্রিক দেশ রুমানিয়া, যুগােস্লাভিয়া এবং অন্যান্য সদ্যস্বাধীন দেশগুলাে সােভিয়েত প্রস্তাবকে বিরােধিতা করে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবকেই সমর্থন করেছে। আপাত দৃষ্টিতে মার্কিন প্রস্তাবের সঙ্গে রুমানিয়া, যুগােস্লাভিয়া এবং অন্যান্য সদ্যস্বাধীন দেশসমূহের মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই। কিন্তু আসলে মার্কিন ও চীনের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রসংঘের অন্যান্য সদস্যদের শান্তির আগ্রহকে অত্যন্ত ধুর্তভাবে সুকৌশলে ব্যবহার করেছে।
মার্কিন ও চীনের প্রতিনিধিদের পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য হলাে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের থেকে ভারতকে বিচ্ছিন্ন করা যাতে ভারতের সৈন্য অপসারণকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করার জন্য ব্যবহার করা চলে। বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসেবে রাখার চক্রান্তই মার্কিন ও চীনের প্রদত্ত যুদ্ধ বিরতি প্রস্তাবের মূল উদ্দেশ্য। এর অর্থ হচ্ছে বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসন কায়েম রাখা, জাতি হত্যার অভিযান অপ্রতিহত রাখা এবং সর্বোপরি সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা। এই ধুরন্ধরেরা পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতিকে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করতে চায়। যুদ্ধ বিরতি থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যাকে বিচ্ছিন্ন করতে পারলেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং চীনের চক্রান্তকে আবার পূর্ণ উদ্যমে পুনরুজ্জীবিত করা সম্ভব হবে। আসলে এই যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব হলাে বাংলাদেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের যুদ্ধবিরতি বা ধ্বংস এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার শ্লোগানের বিলােপ সাধন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এক নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। ভিয়েতনামের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে সরাসরি আক্রমণ, সদ্য স্বাধীন আরব প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে ইজরাইলকে দিয়ে আগ্রাসন সংগঠিত করা এবং বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে ধ্বংস করার উদ্দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে পাক-ভারত যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য অপসারণের প্রস্তাব হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ধুর্ত কৌশল। এই কারণে বলা হচ্ছে মার্কিন ও চীনের প্রতিনিধিরা রাষ্ট্রসংঘের অন্যান্য সদস্যদের শান্তির আগ্রহকে অপব্যবহার করার জন্য ধুর্ত কৌশল অবলম্বন করেছে।
যুদ্ধ বিবৃতি ও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান ওঁতপ্রােতভাবে জড়িত। মার্কিনীরা ও চীনের নেতারা বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায় অনুসারে রাজনৈতিক সমাধান চান না। তাঁরা ইয়াহিয়া খানের নিরঙ্কুশ আধিপত্য বজায় রাখতে চান বলেই যুদ্ধ বিবৃতিকে রাজনৈতিক সমাধান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কৌশল অবলম্বন করেছেন। এই কৌশল চরিতার্থ করার জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা যাতে রাষ্ট্রসংঘে তঁাদের বক্তব্য উপস্থিত করতে না পারে তার জন্য চাদের প্রতিনিধিরা জিদ ধরেছিলেন।
বাংলাদেশের ঘটনাবলী এবং আসল সমস্যা সম্পর্কে রাষ্ট্রসংঘের অনেক সদস্যরা ওয়াকিবহাল নন। উপরন্তু কোনাে শান্তি প্রস্তাব যদি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের অগ্রগতির প্রতিবন্ধক হয়, তাহলে সেই শান্তি প্রচেষ্টা বা প্রস্তাব সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত ও বিভেদ প্রচেষ্টারই উর্বর ভিত্তি হয়ে দাড়ায়। শান্তি প্রচেষ্টাও জাতীয় মুক্তির মধ্যে কোনাে বিরােধ নেই। কিন্তু কৃত্রিমভাবেই সেই বিরােধ সৃষ্টি করা সাম্রাজ্যবাদের ও চীনের লক্ষ্য। জাতিসংঘের অন্যান্য সদস্যরা সেই ফাঁদেই পা দিয়েছেন।

সূত্র: কালান্তর
১২.১২.১৯৭১