ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি ও সিপিএম
প্রত্যেকেই জানেন, দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক অগ্রগতির নায়ক সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরােধিতা এবং সাম্যবাদ-বিরােধিতা একার্থক। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিভীষণ চীনের কুমন্ত্রণা থেকে আমাদের দেশে জাত হয়েছিল কমিউনিস্ট’ নামধেয় একটি দল বা সংক্ষেপে সিপিএম। অবশেষে পৃষ্ঠপােষক মাওবাদী নেতৃত্বও এই ভূঁইফোড় দলটিকে আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করেছিল। তারপর থেকে সিপিএম-এর অবস্থা না ঘর কা না ঘাট কা। পৃথিবীতে এমন আর কোনাে কমিউনিস্ট নামধেয় পার্টি আছে কি না জানি না, আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট সম্মেলনগুলাে যাদের চিমটে দিয়েও ছোঁয়নি, বিশ্ব কমিউনিস্ট শ্রমিক আন্দোলনের ভ্রাতৃত্বমূলক সংহতি থেকে যারা বহুদূরে দাঁড়িয়ে নিছক জাতীয় থেকে ক্রমশ একটি প্রাদেশিক দলে রূপান্তরিত হচ্ছে। পেটিবুর্জোয়া উৎকট সুবিধাবাদ দ্বারা জন্ম-মুহূর্ত থেকে চালিত এই দলটির চরিত্রের শেষতম নগ্ন প্রকাশ ঘটেছে ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতিকে নিন্দা করার মাধ্যমে।
ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সিপিএম-এর সমরাধিনায়ক প্রমােদ দাশগুপ্তের গলায় আবার ‘সােভিয়েত সংশােধনবাদী’ নেতৃত্বের নিন্দায় মুখর তাঁদের প্রাক্তন প্রভু মাওবাদী নেতৃত্বের কণ্ঠস্বর শােনা গেল। চীন-প্রীতিতে আপুত প্রমােদবাবুর অবস্থা অনেকটা যে তােমায় ছাড়ে ছাড়ক, আমি তােমায় ছাড়বাে না মা’! ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কয়েকটি ইতিবাচক কাজের প্রশংসা করে ফেলে সােভিয়েত প্রমােদবাবুর ‘সাচ্চা বামপন্থী বিবেককে ক্ষিপ্ত করে তুলেছে। অবশ্য যেহেতু তাঁর ‘কমিউনিস্ট পার্টি একটি প্রাদেশিক দলে পরিণত হতে যাচ্ছে, তাই তাঁর পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগােষ্ঠী মুক্ত কণ্ঠে স্বাগত জানিয়ে থাকে। তাছাড়া এখন হঠাৎ প্রমােদবাবুর এতটা ‘আপসহীন বিপ্লবী হয়ে ওঠার কারণ কী? ইতিপূর্বে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চীন যখন বারবার জওহরলাল নেহরু ও তার নেতৃত্বাধীন সরকারের বিভিন্ন কার্যকমের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছে, তখন তিনি মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন কেন?
মাত্র দেড়মাস আগে সিপিএম-এর সাধারণ সম্পাদক সুরাইরা বিবৃতি দিয়েছিলেন, ভারত সরকার ৯ আগস্ট নয়দিল্লীতে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যে শান্তি, মৈত্রী ও সহযােগিতার চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে, তা একটি শুভ পদক্ষেপ, যেহেতু এটা ভারতকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী চাপ ও ব্ল্যাকমেলকে রােধ করতে এবং ইয়াহিয়া খাঁর যুদ্ধের হুমকিকে স্তব্ধ করতে সাহায্য করবে’ (দেশহিতৈষী, ২০ আগস্ট, ১৯৭১)। ঐ বিবৃতিরই আর এক জায়গায় সুরাইয়া বলেছেন, ভারতীয় শাসকশ্রেণীগুলােকে এটা উপলব্ধি করতে হয়েছে যে, তাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্ল্যাকমেলকে বাধা দিতে হলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মিত্র বন্ধন প্রয়ােজন।’
সােভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে সিপিএম-এর এসব কথা আমাদের কানে অনেকটা ভূতের মুখে রামনামের মতাে লেগেছিল। তারপর হঠাৎ মাত্র দেড় মাসের মধ্যে এমনকি ঘটে গেল, যাতে প্রথমে ঐ পার্টির এক নেতা এবং তার পিছে পিছে সিপিএম-এর পলিটব্যুরাে হঠাৎ সােভিয়েতের প্রতি সাময়িক দুর্বলতা কাটিয়ে এবং জনসংঘ, স্বতন্ত্র প্রভৃতি মার্কিন-প্রেমী দলকেও লজ্জা দিয়ে একেবারে সরাসরি সােভিয়েত-বিরােধিতায় নেমে পড়লেন?
সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ভারত-সােভিয়েত বিবৃতিটিকে সিপিএম এক বিরাট অধঃপতন’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। ইন্দিরা সরকারের কিছু কিছু কাজকে প্রশংসা করার পর থেকেই তারা সােভিয়েতের উপর তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। ভারত-সােভিয়েত বিবৃতির নিন্দা করে সেই জ্বলুনিকেই সর্বসমক্ষে প্রকাশ করা হয়েছে। সিপিএম পলিটব্যুরাে এখন বলছেন যে, তারা আশা করেছিলেন যে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্নে ভারত সরকারের দোদুল্যমানতা কাটাতে সমর্থ হবে। কিন্তু চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সিপিএম সম্পাদক ঘােষিত বিবৃতিতে এই আশার কথাটিকে একবারও ভুলে প্রকাশ করা হয়নি কেন?
সিপিএম পলিটব্যুরাে এ রকম বেসামাল উক্তিও করে ফেলেছেন, ‘যুক্ত বিবৃতিতে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছবার জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়েছে, যার অর্থ জনগণের অচ্ছেদ্য অধিকার লাভের জন্য ব্যবস্থা গ্রহণে খুনি ইয়াহিয়াকে আবেদন করা। ইতিপূর্বে সােভিয়েত যখন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছিলেন, তখন কিন্তু সিপিএম নেতা সুরাইয়ার কানে তা মধুরই লেগেছিল। পলিটব্যুরাের সাম্প্রতিক উদ্দেশ্যমূলক বিবৃতিটিতে অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এ কথা চেপে যাওয়া হয়েছে যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমান বিবৃতিটিতে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান না বলে পূর্ববাংলা’ কথাটি ব্যবহার করেছেন, পাকিস্তানের গত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা মুজিবরের দাবির কথা উল্লেখ করেছেন এবং পূর্ববাংলার জনগণের ইচ্ছা, অনস্বীকার্য অধিকার ও ন্যায়সঙ্গত স্বার্থ রক্ষাকেই একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান হিসেবে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন। সােভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকো দৃঢ় ভাষায় ঘােষণা করেছেন, ‘পূর্ব বাংলার ঘটনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। যে কোনাে কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তি এখন বিচার করে দেখতে পারেন উপরােক্ত বিবৃতিগুলাে সিপিএম পলিটব্যুরাে কথিত ‘খুনি ইয়াহিয়াকে আবেদন করা কি না।
সিপিএম-এর উগ্র সােভিয়েত বিরােধিতা এমন এক উন্মত্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, তারা কুৎসায় মুখর হয়ে বলছেন, সােভিয়েত কর্তৃক ‘ধাপে ধাপে ভারত সরকারকে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামে সমর্থনের অবস্থান থেকে সরে আসতে বাধ্য করা হচ্ছে। সিপিএম-এর দুভার্গ্য যে, বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণ তাঁদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে তাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নসহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলােকেই আখ্যা দিয়ে থাকেন। অবশ্য ইন্দিরা-ইয়াহিয়া এক হ্যায়’ এর মতাে বালকোচিত স্লোগান যে পার্টি দিতে পারেন, তাদের মুখে যে কোনাে কথাই মানিয়ে যায়।
বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ ও প্রজাতন্ত্রিক সরকার সিপিএমকে তাদের মুক্তিযুদ্ধের কততখানি নির্ভরযােগ্য সমর্থক হিসেবে মেনে নিতে পারবেন, তাতে গভীর সন্দেহ আছে। জনসাধারণ ভুলে যান নি যে বাংলাদেশে সংযুক্ত মুক্তিফ্রন্ট গড়ে তােলার প্রচেষ্টার মাঝখানে হঠাৎ সিপিএম ভাসানী ন্যাপ ও কয়েকটি ছােট ছােট গ্রুপ নিয়ে গঠিত বলে কথিত একটি কো-অর্ডিনেশন কমিটির ঢাক পিটিয়ে ঐক্যের বদলে তাদের স্বভাবসুলভ বিভেদপন্থা আনয়নের প্রচেষ্টা করেছিলেন। যে তথাকথিত ‘কো-অর্ডিনেশন কমিটি নিয়ে সিপিএম এতাে প্রচার ও মাতামাতি শুরু করেছিল, স্বয়ং ভাসানী তার সঙ্গে নিজেকে সম্পর্কহীন বলে ঘােষণা করার পরও ঐ দলটির বিন্দুমাত্র লজ্জা-শরম হয়নি। ইয়াহিয়ার খুনি চক্রের আদুরে দুলাল দেশদ্রোহী মশিউর রহমানকে নিয়ে সিপিএম-এর মাতামাতির কথাও নিশ্চয় বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধারা বিস্মৃত হননি। এখন সিপিএম ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতির শিকড় ঘেঁষে তার কুৎসার খড়গ চালাচ্ছে। এরপর ওরা ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের জনগণ যে তথাকথিত বামপন্থী দলটির গলা চীন, মার্কিন ও দেশের প্রতিক্রিয়া শক্তিগুলাের সােভিয়েত বিরােধী কণ্ঠস্বরের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, সেই দলটিকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক হিসেবে গণ্য করতে পারবেন?
সূত্র: কালান্তর
৪.১০.১৯৭১