পাক হামালার উত্তর নির্মম প্রতিশােধ
সীমান্তের ভারতীয় গ্রামগুলাে বিপন্ন। সেখানে পড়ছে পাক-গােলাগুলী। ত্রিপুরা সীমান্তের অবস্থা মারাত্মক। মাত্র ক’দিন আগে গােটাকয় গ্রামে মারা গেছেন আঠারজন। আহত হয়েছেন অনেকে। কোনাে কোনাে মহলের ধারণা, হতাহতের সংখ্যা আরও বেশী। নির্বিচারে পাকসৈন্যরা দেগেছে কামান। ভয়ে গ্রামবাসীরা পালাচ্ছেন বাড়ীঘর ছেড়ে। এ পর্যন্ত পাক গােলা বর্ষণে নিহত ভারতীয়দের সংখ্য পঞ্চাশ ষাটজন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বারবার ভারত প্রস্তুত। সীমান্তরক্ষীদের পিছনে আছে সৈন্যদল। দরকার পড়লে পিটিয়ে ঠাণ্ডা করা হবে হামলাকারীদের। হুমকির সঙ্গে মিলছে না কাজের নমুনা। গত ক’মাস ধরেই ভারতীয় গ্রামগুলােতে চলছে পাকবাহিনীর খুশীমত গােলাবর্ষণ। লােকজনও মরছেন। কেন্দ্রীয় সরকার শুধু পাঠিয়েছেন প্রতিবাদ এবংয় কোন কোন ক্ষেত্রে চেয়েছেন ক্ষতিপূরণ। সীমান্তরক্ষীদের পাল্টা গুলীবর্ষণ ছাড়া পিটিয়ে ঠাণ্ডা করার প্রয়ােজনের কথা মনে আসে নি কর্তাদের। দুঃসাহস বাড়ছে পাক-দুশমনদের। মাঝে মাঝে ওরা ভারতীয় এলাকায় ঢুকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নাগরিকদের। জোরালাে সক্রিয় প্রতিরােধ কোথায়? শরণার্থীরা মার খাচ্ছেন সীমান্তের পথে এবং সীমান্তের এপারে ভারতীয় এলাকায়। তাঁদের সঙ্গে প্রাণ দিচ্ছেন এদেশের নরনারী। যেসব ঘাঁটি থেকে আসছে পাক আক্রমণ সেসব ঘাটি নিশ্চহ্ন করতে না পারলে বন্ধ হবে না জঙ্গশাহী দৌরাত্ম।
সীমান্ত গ্রামগুলাের উপর পাক-হামলা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তার পিছনে হয়ত আছে গুঢ় উদ্দেশ্য। পাকদরদীরা উঠে পড়ে লেগেচে বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরােধের রূপ দিতে। নেপথ্যে চলচে শয়তানির পাঁয়তারা। ইসলামাবাদ করছেন তারই পটভূমি তৈরী। এ হামলা কমবে না। যতদিন যাবে তত বাড়বে। দুনিয়াকে বােঝাতে চাচ্ছেন ইয়াহিয়া খান মুক্তিবাহিনী ভারতেরই সৃষ্টি। ভারতীয় এলাকা থেকে ওরা হানা দিচ্ছে বাংলাদেশে। নাজেহাল করছে পাক-চমুকে। ওদের শায়েস্তার জন্য পড়ছে ভারতীয় নাগরিক হত্যার কথা। পাক-প্রচার যে দিকেই চলুক না কেন, তাতে কিছু আসে যায় না। অবাঞ্ছিত ঘটনাবলীর সত্যতা ভালভবেরই জানেন নয়াদিল্লী। রাষ্ট্রের সার্বভূেম মর্যাদা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা সরকারের প্রাথমিক কর্তব্য। পালনের গাফিলাত করতে কারেন না কোন দায়িত্বশীল পবর্ণমেন্ট। তার জন্য সীমিত অভিযানের দরকার পড়লে তাও নেওয়া যুক্তিযুক্ত। যুদ্ধের ভয় যদি পাকিস্তানের না থাকে তবে ভারতেরই থাকবে কেন? পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইলেই আপােষে তা পাওয়া যাবে না। আদায় করতে হবে ভারতীয় হত্যার মাশুল। রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রীপন্থ বলেছেণ– সীমান্ত বরাবর ক’মাইলের মধ্যে থাকতে পারবেন না কো পক্ষের সৈন্যবাহিনী। পাক-ভারত চুক্তিতে এই গ্রাউন্ড রুল স্বীকৃত। পাকিস্তান মানছে না এই চুক্তির শর্ত। হামেশাই তারা এসে পড়ছে সীমান্তের অতিকাছে। সেখান থেকে করছে গুলীবর্ষণ। তাদের মােকাবিলায় এগিয়ে যাচ্ছে সীমান্ত রক্ষীদল। এ লড়াই সমানে সমানে নয়। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ভারত। গ্রাম ছাড়ছেন স্থানীয় অধিবাসীরা। গ্রাউন্ড রুল যদি না মানে পাকিস্তান তবে ভারতেরই কি মাথা ব্যথা আছে তা মানার। এগিয়ে যেতে হবে সৈন্যদলকে। তাদের সহায়ক হিসাবে থাকবেন সীমান্তরক্ষীরা। জরুরী প্রয়ােজনে এ ব্যবস্থাই বাঞ্ছনীয়। গায়ে পড়ে আক্রমণ করবে না ভারতীয় সৈন্যদল। কিন্তু আক্রান্ত হলে ছাড়াছাড়ি নেই। যেসব ঘাঁটি থেকে আসবে পাক-গােলাগুলী উড়াতে হবে সেসব ঘাটি। নির্মম প্রতিরােধ এবং প্রচণ্ড মার ছাড়া বুঝবে না পাকিস্তান অবস্থার গুরুত্ব।
যথেষ্ট সংযম দেখিয়েছেন নয়াদিল্লী। সত্তর লক্ষাধিক শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। আরও আসছেন হাজারে হাজারে। প্রতিটি শরণার্থীর জন্য দৈনিক খরচ হচ্ছে তিন টাকা। ইয়াহিয়ার অপকর্মের মাশুল দেওয়া কতদিন চলবে তার নেই কোন ঠিক-ঠিকানা। এদিকে সীমান্তবর্তী ভারতীয় গ্রামগুলােতে তৈরী হচ্ছে নূতন উদ্বাস্তু। নিজেদের রাষ্ট্রে নিজেদের বাড়ীঘরেও নেই তাদের নিরাপত্তা। সেখানেও চলছে পাক-হানাদারী এবং গােলাবর্ষণ। মুক্তিবাহিনী স্বাধীন বাংলাশে সরকারের সৈন্যদল। মুক্ত অঞ্চল থেকে চলছে তাদের তৎপরতা। ওদের উচ্ছেদের জন্য ভারতীয় এলাকায় চলে পাক-হানাদারী তবে সীমান্তের পাক-হানাদারদের নির্মূল করার জন্য কেন চলবে না পাল্টা ভারতীয় ব্যবস্থা? যে আঘাত আজ পড়ছে ভারতের উপর তা যদি পড়ত অপর কোন শক্তিশালী এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্রের গায়ে তবে কি ঘটত? প্রতিবাদের বদলে সুরু হত ধােলাই অপারেশন। নয়াদিল্লীর সংযম এসে দাঁড়িয়েছে ক্লীবত্বের পর্যায়ে। জনসাধারণের মন আজ তিক্ততায় ভরা। তাঁরা চান বীরত্বের আস্ফালন। তাঁরা চান কাজ। প্রতিশােধ ছাড়া দমবে না পাকিস্তান। এ দাওয়াই যত তাড়াতাড়ি আসে তত ভাল। নইলে পাক-জঙ্গীশাহী হয়ে উঠবে বেপরােয়া।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৩১ জুলাই ১৯৭১