মায়াগাসি অ্যামবুশ
ময়মনসিংহ জেলার শেরপুর মহকুমার (বর্তমানে জেলা) নালিতাবাড়ি থানার অধীন রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের একটি গ্রাম মায়াগাসি। গ্রামের পশ্চিম দিক দিয়ে। বয়ে চলেছে ভুগাই নদী। নদীটি ভারতের অভ্যন্তর থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। গ্রামের উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে গজারি এবং শালবন। গ্রামের দৈর্ঘ্য। প্রায় ৩ কিলােমিটার এবং প্রস্থ প্রায় ১ কিলােমিটার। গ্রামের মধ্য দিয়ে পূর্বপশ্চিমে রয়েছে একটি সীমান্ত সড়ক, যা বর্ডার রােড নামে এলাকায় সমধিক পরিচিত। বর্ডার রােড থেকে ভারতের মেঘালয় সীমান্তের দূরত্ব কম-বেশি ১ কিলােমিটার। মায়াগাসি গ্রাম থেকে পূর্ব দিকে ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানা ৮ কিলােমিটার এবং পশ্চিম দিকে নালিতাবাড়ি থানা ১১ কিলােমিটার দূরত্বে অবস্থিত। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট থানা ও নালিতাবাড়ি থানা থেকে সীমান্ত সড়ক ধরে মায়াগাসি গ্রামে সহজে আসা-যাওয়া করা যায়। এ গ্রামের পার্শ্ববর্তী অন্য গ্রামগুলাের মধ্যে তারাইল, রামচন্দ্রকুড়া, পানিহাটা, রঙ্গমপাড়া, তারানী উল্লেখযােগ্য।
পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান
মায়াগাসি গ্রাম এলাকাটি ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের অপারেশনাল এলাকার নিয়ন্ত্রণাধীন। রেজিমেন্টের সদর দপ্তর ছিল জামালপুর এবং অধিনায়ক ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল সুলতান মাহমুদ। প্রাথমিক অবস্থায় ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সৈন্য রামচন্দ্রকুড়া সীমান্ত ফাঁড়িতে অবস্থান করতাে। শক্তি বৃদ্ধির জন্য এ রেজিমেন্টাল ফোর্সের সাথে ১ প্লাটুন রেঞ্জার্স এবং স্থানীয়ভাবে নিয়ােগকৃত রাজাকার এ এলাকায় নিয়ােজিত ছিল। মে-জুন মাসে মুক্তিবাহিনীর ক্রমাগত হামলার মুখে এবং প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় রামচন্দ্রকুড়া সীমান্ত ফাড়ি থেকে সৈন্য সরিয়ে নালিতাবাড়ি থানা এবং এর পূর্ব দিকে হালুয়াঘাট থানায় অবস্থান নেয়। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে মুক্তিযােদ্ধাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ বন্ধ এবং ভােলাই নদী দিয়ে যাতায়াতের উপর খবরদারি করার জন্য এ নদীর পূর্ব তীরে তন্তুর গ্রামে একটি অস্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য এবং তাদের সহযােগী রাজাকার ও অন্য সদস্যরা তর থেকে পূর্ব দিকে কলাপাড়া, রামচন্দ্রকুড়া, মায়াগাসি গ্রামের উপর দিয়ে বর্ডার রােড ধরে মায়াগাসি বনবিভাগের অফিস পর্যন্ত নিয়মিত টহল দিত। মায়াগাসি বনবিভাগের অফিসেও পাকিস্তানি সেনাদের একটি অস্থায়ী ক্যাম্প ছিল। তাদের রসদ ও রেশন নিয়ে সেনা সদস্যরা নিয়মিত এ পথে যাতায়াত করতাে।
আক্রমণ পরিকল্পনা
১১ নম্বর সেক্টরের ডালু সাব-সেক্টর থেকে গ্রুপ অধিনায়ক ইপিআর সুবেদার মেজর জিয়াউল হকের উপর এ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর চলাচলের উপর বাধা সৃষ্টি করার নির্দেশ আসে। সীমান্ত সড়ক দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের টহল পর্যবেক্ষণের জন্য সুবেদার মেজর জিয়াউল হক ল্যান্স নায়েক মেসবাহ উদ্দিনকে ১৩ সদস্যের একটি টহল দলসহ মায়াগাসি গ্রামের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেন। একইসাথে তিনি এ দলকে মায়াগাসি বনবিভাগের অফিসে অবস্থানকারী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান, শক্তি, গতিবিধি সম্পর্কে সার্বিক তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেন। এ দলের পথপ্রদর্শক হিসেবে এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ইদ্রিস মিয়াকে দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
যুদ্ধের বিবরণ
১৯৭১ সালের ২৭ জুলাই সকাল ৯টা ৩০ মিনিটে ল্যান্স নায়েক মেসবাহ উদ্দিনের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের মুক্তিযােদ্ধা দলটি মায়াগাসি বনবিভাগ অফিসের উদ্দেশ্যে নাকুগাঁও মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প থেকে যাত্রা করে। ১৩ সদস্যের মধ্যে ৩জন ইপিআর সদস্য এবং ১০জন মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন। এ দলে ৩টি এলএমজি, ১টি এসএমজি এবং বাকি সদস্যের সাথে ৩০৩ রাইফেল ও গ্রেনেড দেয়া হয়। গাইড ইদ্রিস মিয়া দুর্গম পাহাড়ি পথ ঘুরে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে পানিহাটা গ্রামের জনৈক এরফান আলীর বাড়িতে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পুনরায় মায়াগাসির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধা দলটি বিকাল ৪টা ৩০ মিনিট নাগাদ মায়াগাসি গ্রামের উত্তর দিকে গজারি বনে এসে পৌছায়। শত্রু এলাকার কাছাকাছি চলে আসায় মুক্তিযােদ্ধা দলটি অতি সতর্কতার সাথে সামনে এগােতে থাকে। গাইড ইদ্রিস মিয়ার কাছ থেকে এ রাস্তায় পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলের আগমনের সংবাদ আসে। উপস্থিত এ পরিস্থিতিতে অধিনায়ক মেসবাহ উদ্দিন ত্বরিত সিদ্ধান্ত নিয়ে তার দলকে ৩জন ইপিআর সদস্যের নেতৃত্বে তিন ভাগে বিভক্ত করে তিন জায়গায় পজিশন নিতে নির্দেশ প্রদান করেন। প্রথম ৪জনের দলটিকে ১টি এলএমজিসহ বর্ডার রােডের উত্তর পাশে পাহাড়ের আড়ালে অত্যন্ত সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিতে বলেন। দ্বিতীয় দলের দায়িত্ব নিয়ে মেজবাহ উদ্দিন ৬জন সদস্য ও ১টি এলএমজিসহ টিলার পিছনে অবস্থান গ্রহণ করেন। তৃতীয় দলে একটি এলএমজি দিয়ে ৩জনকে। পানিহাটা গ্রামের সন্নিকটে যেখানে বর্ডার সড়কটি একটু মােড় নিয়েছে, সে মােড়ে অবস্থানের নিদের্শ দেন। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় কম হলেও অবস্থানগত কারণে ৩টি দলের অবস্থান ছিল অত্যন্ত সুদৃঢ় ও সুবিধাজনক।
কিছুক্ষণের মধ্যে ১৪-১৫জনের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি টহল দল। বর্ডার রােডের দক্ষিণ পাশ ঘেঁষে রাস্তার নিচ দিয়ে পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকে। খুব কাছাকাছি অবস্থানে চলে আসার সাথে সাথে। অধিনায়ক মেজবাহ উদ্দিনের দল পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দলের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা সড়কের আড়াল নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায়। ফায়ারের শব্দ শুনে মুক্তিযােদ্ধার প্রথম দলটিও তাদের অবস্থান। থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর দিকে গুলি চালাতে শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধাদের তৃতীয় দলটি কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে দ্বিতীয় দলের কাছাকাছি এসে অবস্থান নিয়ে আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি সেনারা যখন কিছুতেই মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণকে দুর্বল করতে পারছিল না, তখন বেতারে বনবিভাগের অফিস ও তেলিখালী ক্যাম্পে অতিরিক্ত সাহায্যের জন্য বার্তা পাঠায়। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর ছোঁড়া মর্টার ও আর্টিলারি শেল মুক্তিযােদ্ধাদের আশপাশের এলাকায় পড়তে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে শেল নিক্ষেপের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় ল্যান্স নায়েক মেজবাহ উদ্দিন দলের সব সদস্যকে ঐ স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মুক্তিযােদ্ধারা সবাই। নিরাপদে মায়াগাসি গ্রামের গজারি বন দিয়ে নাকুগাঁও ক্যাম্পে ফিরে আসে। মায়াগাসি অ্যামবুশে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধা হলেন:
১. ল্যান্স নায়েক মেজবাহ উদ্দিন
২. আলমাস মিয়া
৩. ইদ্রিস মিয়া।
৪, আহম্মদ আলী
৫. শাহজাহান।
৬. সাইফুল
৭.. নাজিম উদ্দিন
৮. সােবহান।
৯. গােলাম জব্বার
১০. আজিজ উল্লাহ প্রমুখ।
সামগ্রিক মূল্যায়ন
অ্যামবুশ হঠাৎ হলেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ পরিকল্পনা ছিল যথাযথ। মায়াগাসি স্থানটি দুর্গম গজারি বন এলাকা হওয়ায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধা ছিল। মায়াগাসি অ্যামবুশ একটি ছােটো অভিযান হলেও এর সাফল্য ছিল সুদূরপ্রসারী। মুক্তিবাহিনীর অভিযান পরিচালনার ধরনে পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় কোণঠাসা হয়ে পড়ে, যা পরবর্তীতে যুদ্ধ জয়ের সফলতা নিয়ে আসে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – চতুর্থ খন্ড