You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ববাংলা ও চীন
অরুণ রায় বিশ্বাস

আপনাদের দর্পণের তিরিশে এপ্রিলের সংখ্যা ‘মতামত’ পাতাটিতে প্রকাশিত অমূল্যরতন সেন, শ্যামল ঘােষ এবং মৈত্রেয় ভাস্কর মহাশয় লিখিত মতামতগুলাে মন দিয়ে পড়লাম। প্রথমেই বলে রাখি, আমেরিকা, রাশিয়া বা ভারত সরকারের চরিত্র নিয়ে উপরােক্ত তিন ভদ্রলােক যে বক্তব্য রেখেছেন, আমি সেই বক্তব্য পুরােপুরি সঠিক বলেই মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে থাকি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনজনের লেখাতেই দেখতে পেলাম একটা প্রশ্ন তারা সুন্দরভাবেই এড়িয়ে গিয়েছেন। সেটা হলাে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আলােকে মহান চীন সরকারের ভূমিকা কী?
রাত্রির অন্ধকারে অসীম সমুদ্রে জাহাজকে যেমন বন্দরের নিশানা দেখায় বাতিঘর তেমনি সারা দুনিয়া জুড়ে শ্রমিক, কৃষক ও সংগ্রামী জনতার ওপর আজ যে অত্যাচারের কালাে রাত্রি নেমে এসেছে, সেই কালাে রাত্রির মধ্যে শ্রমিক, কৃষক ও সংগ্রামী জনতার কাছে আজকের দিনে একমাত্র বন্দরের বাতিঘর’ হলাে মহান চীন। সুতরাং আমরা যদি আমাদের দেশের শ্রমিক, কৃষক এবং সংগ্রামী জনগণকে আরাে বেশি রাজনৈতিক শিক্ষা দিতে চাই, আরাে বেশি শ্ৰেণীসচেতন করতে চাই তবে আজ আমাদের ঘরের পাশে যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে সেই যুদ্ধের আলােকে মহান চীনের সঠিক ভূমিকা কী তা নিয়ে অতি অবশ্যই খােলাখুলিভাবে আলােচনা করতে হবে।
সুতরাং আজকের দিনে আমাদের অতি অবশ্যই আলােচনা করতে হবে কেন রাজপুত্র সিহানুক মাও সে তুং-এর সঙ্গে একই পাতে বসে ভাত খাবার অধিকার পেয়েছে, কেন পাক সামরিক শাসক সেন্টো-সিয়াটোর সভ্য ইয়াহিয়া খানের (যেখানে মার্কসবাদ আমাদের শিক্ষা দিয়েছে হিটলার থেকে ইয়াহিয়া খান সব ডিক্টেরই ইতিহাসের আবর্জনা) হাতে চীন লক্ষ লক্ষ আধুনিক অস্ত্র তুলে দিয়েছে, কেন বাংলাদেশের কয়েক কোটি শ্রমিক, কৃষক মুক্তিযােদ্ধা প্রাণ দিলেও মহান চীনের এতটুকু নৈতিক সমর্থন পাবারও যােগ্য হতে পারে না। আলােচনা করতে হবে আমেরিকার দালাল (১) মুজিবরকে কোনাে রকম সমর্থন করার চেয়ে খােদ আমেরিকার সঙ্গে চীনের পিংপং খেলা অথবা আমেরিকাতে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযােগিতায় চীনের সুন্দরী যুবতী পাঠানাে কেন অনেক অনেক বেশি প্রয়ােজনীয়। মুজিবরের সংগ্রাম যদি শুধুমাত্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট হয়ে থাকে তবে হাঙ্গেরি বা চেকোশ্লোভাকিয়ার সঙ্কটও তাে ছিল সেইসব দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। সেইসব দেশের বেলায় মহান চীন কোন ভূমিকা গ্রহণ করেছিল? দক্ষিণ ভিয়েতনামের সাধারণ মানুষ বছরের পর বছর যুদ্ধ করে চলেছে দক্ষিণ ভিয়েতনামেরই মুক্তির জন্য, তবু সেটা কেন জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ নয়? আর বাংলাদেশের সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ যখন সর্বশক্তি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছে তখন সেই যুদ্ধকে ঘৃণ্য জাতীয়তাবাদের উস্কানি বলে আমাদের মতন আন্তর্জাতিকতাবাদীদের সেই যুদ্ধ থেকে সাত হাত দূরে থাকার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দিয়েছে কেন? কোনাে কোনাে মহল থেকে বলার চেষ্টা হচ্ছে, কমরেড মাও সে তুং-এর নীতিতে পুরােপুরি আস্থাশীল বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধা কমরেড তােহার নেতৃত্বে বাংলাদেশের গেরিলা যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছে। যদি প্রকৃতপক্ষে ব্যাপারটা এইরকম হয়ে থাকে তবে একজন কমিউনিস্ট হিসাবে আমি নিশ্চয়ই খুশি হতে পারি। সেই সঙ্গে আরাে একটা প্রশ্ন আমাকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে, সেটা হলাে কমরেড তােহার নেতৃত্বে গেরিলা যুদ্ধ শুরু হবার পরও কেন মহান চীন ইয়াহিয়া খানের মাথায় ছাতা ধরে আছে? তাহলে মহান চীনের কি উচিত নয় এখনই কমরেড তােহার পাশে এসে দাঁড়ানাে অথবা ইয়াহিয়ার পেছন থকে মহান চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়া? শুধুমাত্র ‘মনােবল’ সম্বল করে কোনাে জাতি বছরের পর বছর মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেনি বা পারবে না। দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ কবে শেষ হয়ে যেত যদি না চীন, রাশিয়া বা উত্তর ভিয়েতনামের লক্ষ লক্ষ আধুনিক অস্ত্র সময়মতাে এবং প্রয়ােজনমতাে দক্ষিণ-ভিয়েতনামের সংগ্রামী মানুষগুলাের হাতে না আসতাে। সুতরাং বাইরের সমর্থন না পেলে, অস্ত্র না পেলে কমরেড তােহার নেতৃত্বে শুরু হওয়া গেরিলা যুদ্ধও অচিরেই স্তব্ধ হয়ে যেতে বাধ্য।
এসব প্রশ্নের অবশ্যই জবাব দিতে হবে এবং সেই জবাব নিয়েই আমাদের যেতে হবে শ্রমিকের বস্তিতে, কৃষকের ক্ষেতে খামারে আর তা যদি না করে তাদের কাছে শুধুমাত্র হিন্দুদের স্লোগানের মতাে বিশ্বাসে মিলায় হরি তর্কে বহুদূর মার্কা চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান- এই শ্লোগান নিয়ে এবং আমেরিকা, রাশিয়া বা ভারত সরকারের শ্রেণীচরিত্রের বিশ্লেষণ নিয়ে হাজির হই তবে তা হবে একটা মারাত্মক ভুল এবং এর ফলে শ্রমিক কৃষক ও সাধারণ মানুষ কোনােদিনই পুরােপুরি শ্ৰেণীসচেতন হবে না এবং প্রত্যক্ষ সংগ্রামের দিনে এসব সংগ্রামী মানুষগুলােই বুর্জোয়াদের সামান্য প্রচারেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে।

সূত্র: দর্পণ
১৮.০৬.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!