গণতন্ত্রের হত্যায় আমরা কি নীরব দর্শক মাত্র?
ছয় সপ্তাহ হইতে চলিল পশ্চিম পাকিস্তানের ফ্যাসিষ্ট-চক্র বাংলা দেশের নিরস্ত্র ও নির্দোষ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করিয়াছে এবং এই দেড়মাসকাল ধরিয়া সেখানে ইয়াহিয়া খানের ঘাতক-বাহিনী হত্যা, লুণ্ঠন, ধ্বংস, ধর্ষণ ও ত্রাস সৃষ্টির যে রেকর্ড সৃষ্টি করিয়াছে, আধুনিককালের ইতিহাসে তার তুলনা নাই। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে এই একতরফা বর্বর আক্রমণ ও পাইকারি নরহত্যা সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশ নতি স্বীকার করে নাই। তার বীর সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধ চালাইয়া যাইতেছেন। কিন্তু বাইরের সামরিক ও বৈষয়িক সাহায্য ছাড়া এভাবে প্রায়নিরস্ত্র একটি জাতির পক্ষে আধুনিক ভয়ঙ্কর মারণাস্ত্র সজ্জিত কোন দখলদার সৈন্যবাহিনীকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিতাড়িত করা অত্যন্ত দুঃসাধ্য। এজন্য গােড়াতেই দরকার স্বাধীন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সরকারের অবিলম্বে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদান। গত কয়েক সপ্তাহ ধরিয়া এই স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে সারা ভারতের রাজনৈতিক মহল আলােড়িত হইতেছে। কংগ্রেস, অ-কংগ্রেস এবং বাম, দক্ষিণ ও মধ্যপন্থীসহ সমস্ত মতাদর্শের (একমাত্র মুমিলীগপন্থী সাম্প্রদায়িকতাবাদী, প্রচ্ছন্ন পাকিস্তানি এবং বাঙালী-অবাঙালী প্রশ্নে একদল সঙ্কীর্ণ বুদ্ধি মূখ ছাড়া) লােকেরাই নব-গঠিত স্বাধীন গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের জন্য প্রকাশ্যে দাবী জানাইতেছেন শাসক কংগ্রেসের সমর্থকগণ থেকে শুরু করিয়া সি পি আই, সি পি এম, এস এস পি, পি এস পি, জনসঙ্, স্বতন্ত্র, ডি এম কে, ফরােয়ার্ড ব্লক, এস ইউ সি, আর এস পি প্রভৃতি যাবতীয় ছােটবড় রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠী সমস্বরে দাবী তুলিয়াছেন বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে। এই একটি মাত্র প্রশ্নে মার্কসবাদী থেকে হিন্দুসাম্প্রদায়িকতাবাদী পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক মতের ও পথের পার্টিগুলি একমত হইয়াছেন। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক জীবনে এমন দৃশ্য কদাচিৎ দেখা গিয়াছে। কিন্তু এটা কোন অস্বাভাবিক কান্ড নয়। কারণ, গােড়াকার মৌলিক প্রশ্ন হইতেছে একটি নির্যাতিত জাতির (এবং এই ক্ষেত্রে বাঙালী জাতির) পরাধীনতা থেকে পূণ রাষ্ট্রিক স্বাধীনতা লাভের প্রশ্ন। এই রাষ্ট্রিক বা জাতীয় স্বাধীনতা ছাড়া কোন দেশ বা জাতি বিকাশ লাভ করতে পারে না। কিন্তু এই বিকাশ কোন পথে বা কোন মতবাদের উপর ভিত্তি করিয়া অনুষ্ঠিত হইবে, সেই প্রশ্ন আসিতেছে পরে। গৃহসজ্জা বা গৃহের সম্পদের ব্যবস্থা সম্পর্কে তখনই চিন্তা করা যাইতে পারে, যখন গৃহের বন্ধ দ্বার খুলিবার জন্য চাবিকাঠি হাতের মুঠোয় আসিবে। সেই চাবি হইতেছে জাতীয় স্বাধীনতা এবং এই জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে সাধারণতঃ একমাত্র মতাদর্শের লড়াই-ই বড় হইয় উঠে না। ইন্দোচীনের (ভিয়েৎনামের) স্বাধীনতা সংগ্রামে বিভিন্ন মতবাদের পার্টি একত্র হইয়া লড়িয়াছেন এবং আজও লড়িতেছেন। বৃটিশ সাম্রজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনের সংগ্রামে কংগ্রেসের পতাকাতলে নরমগরম-বাম-দক্ষিণ প্রভৃতি নানা মতবাদের পার্টি এক ফ্রন্টভুক্ত হইয়া লড়িয়াছেন। সুতরাং আজ বাংলাদেশে স্বাধীনতার প্রশ্নে যদি ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল একমত হইয়া কূটনৈতিক স্বীকৃতির জন্য দাবী তুলিয়া থাকেন তবে, বিস্মিত হওয়ার কিছু নাই। কারণ, স্বাধীনতার ভিত্তি ছাড়া কোন জাতির সামাজিক ও রাজনৈতিক চরিত্র বিকাশের সম্ভাবনা নাই।
ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের এই দাবী প্রায় জাতীয় দাবীতে পরিণত হইয়াছে এবং এই জাতীয় দাবীর অর্থ হইতেছে জনতার দাবী। এক কথায় এটা ভারতীয় গণতন্ত্রের দাবী এবং এই দাবী কার নিকট করা হইতেছে?—গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত ভারতবর্ষের বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট, সরকারের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং তার পার্টি গত সাধারণ নির্বাচনে পার্লামেন্টে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী মেজরিটি পাইয়া বিস্ময়কর জয়লাভ করিয়াছেন। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের দেশে, এমন কি সােভিয়েট রাশিয়ায় পর্যাপ্ত গণতন্ত্রের এই জয়লাভ অভিনন্দিত হইয়াছে। কিন্তু ভারতবর্ষের সমস্ত রাজনৈতিক দল ও জনতার বৃহত্তম অংশ যখন স্বাধীন বাংলা দেশের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের জন্য দাবী জানাইতেছেন। তখন কিন্তু গণতন্ত্রের দাবীর প্রতি আর মর্যাদা দেখানাে হইতেছে না। যে প্রধানমন্ত্রী এবং তার ক্যাবিনেট গণতন্ত্রের জয়ে গৌরবান্বিত সেই মন্ত্রিসভাই কিন্তু জনগণের এই দাবীর প্রতি আজও বিমুখ হইয়া রহিয়াছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার স্মরণ সিং হয়তাে ভাবিতেছেন পূর্ববঙ্গে যখন পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে অভিযান (কারণ, মূলতঃ পূর্ব পাকিস্তানে পাঞ্জাবী শাসন ও শােষণই ভয়ঙ্কর হইয়া উঠিয়াছিল) তখন তিনি নিজে এবং তাঁর পাঞ্জাবী অফিসারদের কিভাবে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দিবেন? যদিও পাকিস্তানি পাঞ্জাব ও ভারতীয় পাঞ্জাব আর এক দেশ নয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীজগজীবন রাম হয়তাে ভাবিতেছেন ব্যাপারটা তাে বাংলা মুলুকের এবং সম্ভবতঃ দুই বাংলার ভিতরে ভিতরে কোন ভারত-বিরােধী কারসাজিও আছে। অতএব বিপন্ন বাংলা দেশের ত্রাণে ভারতীয় সমর বিভাগের মাথাব্যথা কি? আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজী হয়তাে ভাবিতেছেন—এতবড় সােভিয়েট রাশিয়া যখন দু-এক-খানা চিঠি-চাপাটি পাঠাইয়া চুপচাপ, আর দুনিয়ার সেরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নট নড়নচড়ন, তখন বাবা আমি আগ বাড়াইয়া মাথা গলাই কেন?—ওদিকে মাও সে-তুং তাে লাঠি উচাইয়া বসিয়াই আছেন।
সুতরাং বাংলা দেশ গােল্লায় যাক। কিন্তু নয়াদিল্লীর কান্ডজ্ঞানহীন মন্ত্রী ও অফিসারেরা কি একবারও ভাবিয়া দেখিয়াছেন যে, পূর্ব বাংলায় যেভাবে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হইয়াছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গে ও ভারতবর্ষের জনমানসে গভীর প্রতিক্রিয়া দেখা দিবে? ইতিমধ্যেই চরমবাদী বিপ্লবীরা পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত করিয়া বলিতেছেন—ওটা শিক্ষিত বুর্জোয়াদের কৌশল ও কারসাজি মাত্র, জনগণের হাতে আসল ক্ষমতা কখনও নির্বাচনের মারফৎ দেওয়া হইবে না। এজন্যই ভারতবর্ষে কমিউনিষ্টনা নির্বাচনে জয়লাভ করিয়া ক্ষমতায় আসিলেও তাদের কিছুতেই সহ্য করা যায় না। তাদের উচ্ছেদ করা হইবেই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৭ মে ১৯৭১