বীরাঙ্গনা চানুভান এর বয়ান
আমি দরিদ্র পিতৃহীন অবিবাহিতা নারী। বিধবা মাতা একমাত্র সংসারে আপন পরিজন। আমার কোন ভাইবোন নাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন আরম্ভ হইলে পাক বাহিনী পত্তন ইউনিয়নে শিবির স্থাপন করে। জুন মাসের শেষের দিকে পাক সৈন্য ও রাজাকারদের অত্যাচার ও নৃশংসতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় রাজাকাররা গ্রামের ও ইউনিয়নের বহু ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন করে।
জুলাই মাসের ১৭ তারিখ বানু মিঞা, সোনা মিঞা ও চাঁন মিঞা গভীর রাত্রে আমার নিজ বাড়ী হইতে ধরিয়া লইয়া পাক বাহিনীর শিবিরে লইয়া যায়। আমাকে দেখিয়া পাক বাহিনীরা আনন্দে নাচিয়া ওঠে, আমার ক্রন্দন তাহাদের প্রাণে একটুও মায়ার সঞ্চার করে নাই। রাজাকাররা ধরিয়া নিবার সময় তাহাদের নিকট বহু আকুতি-মিনতি ও পায়ে জড়াইয়া পড়িয়াছি। উক্ত রাজাকারদের নিকট আমি যতই ক্রন্দন করিয়াছি, রাজাকার গুলি আমার সহিত ততবেশি অমানুষিক ব্যবহা করিয়াছে।
পাঁচদিন পাক নরপিশাচরা আমাকে তাহাদের শিবিরে ও বাঙ্কারে আটকাইয়া রাখে ও আমার দুর্বল দেহের উপর অমানুষিক অত্যাচার করে ও মুক্তিবাহিনীর সংবাদ জানি কিনা জিজ্ঞাসা করে। আমি মুক্তিবাহিনীর সম্বন্ধে জানিনা বলিলে আমার উপর ক্রুদ্ধ হইয়া প্রহার করে। এই পাঁচদিন তাহারা আমাকে গোসল করিতে পর্যন্ত দেয় নাই।
আমাকে ধরিয়া দিবার পরিবর্তে রাজাকারগণ পাক-নরপিশাচদের হইতে প্রচুর মদ ও গ্রামে গ্রামে লুণ্ঠন করিবার অনুমতি পাইয়াছিল। সৈন্যদের অত্যাচারে আমি জ্ঞান হারাইয়া ফেলিয়াছি। জ্ঞান ফিরিয়া পাইলেও দেখি ও অনুভব করি আমার দুর্বল শরীরে অত্যাচার করিতেছে। এই কথা ভাবিতে আজও ভয় হয়।
আমাকে ১৭ জুলাই গভীর রাত্রে রাজাকাররা ধরিয়া নিবার পর ১৮ জুলাই আমার মা কেশবপুর গ্রামের মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার নজীর আহমদ সাহেবের নিকট আমাকে পাক শিবিরে ধরিয়া নিবার করুণ সংবাদ বলিলে উক্ত মুক্তিবাহিনীর কমাণ্ডার ২১ শে জুলাই গভীর রাত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা নিয়া ফুলবাড়িয়া পাক সৈন্যদের শিবির ও বাঙ্কার আক্রমণ করেন। হঠাৎ আক্রমনে পাক বাহিনী ও রাজাকাররা আত্মসমর্পন করে। আক্রমনের সময় তাহারা সকলেই আমার উপর অত্যাচার করিতেছিল। মুক্তিযোদ্ধা ভাইয়েরা আমাকে সহ ১৪ জন পাক সৈন্য ও তিন জন রাজাকারকে গ্রেফতার করিয়া ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে নিয়া যান। তাহারা আমার সম্মুখে রাজাকার ও পাক নরপিশাচদের জীবন্ত মাটি চাপা দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমি ত্রিপুরা রাজ্য হইতে নিজ জন্মভুমি ফুলবাড়িয়া ফিরিয়া আসি।
স্বাক্ষর/-
মোছাঃ চানুভান
গ্রাম- ফুলবাড়িয়া
থানা- ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া
জেলা- কুমিল্লা।