You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ আজ পাক হানাদার মুক্ত: এ ক্ষণে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে
স্বাধীনতা ও স্বাধিকার অর্জনের জন্য মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা তা কোনাে দিনই অবদমিত করা যায় না

গত ১৭ ডিসেম্বর রাত ৮ ঘটিকার সময় আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র হইতে ত্রিপুরার লে, গভর্নর শ্রী বালেশ্বর প্রসাদ ত্রিপুরাবাসীর উদ্দেশে এক বেতার ভাষণ বলেন-
আজ আমি আমার এ বক্তব্য শুধুমাত্র ত্রিপুরার জনসাধারণের উদ্দেশেই নয় বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত বন্ধু এবং স্ত্রী, পুরুষ ও শিশু সামরিক আশ্রয়ে আমাদের মধ্যে আছেন তাদের উদ্দেশ্য করেও বলছি। এক পক্ষকালের মধ্যে আমি ত্রিপুরাবাসীদের উদ্দেশে যখন বক্তব্য রেখেছিলাম সে সময় পাকিস্তান আমাদের সাথে যুদ্ধ চালিয়েছিল। আজ আমি এক আনন্দময় মুহূর্তে আপনাদের উদ্দেশে এই ভাষণ দিচ্ছি। বাংলাদেশ আজ মুক্ত। সেখানকার পাক বাহিনী আমাদের জওয়ান ও মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে পাক বাহিনীর ভয়ঙ্কর অত্যাচারের, নিপীড়নের এবং বর্বরােচিত আক্রমণের দিন শেষ হয়ে গেছে। বাংলাদেশের জনসাধারণ বাঁচার অধিকার চেয়েছিলেন, সে অধিকার অর্জিত হয়েছে। এ ক্ষণে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে; যে গণতন্ত্রের অধিকারে বাংলাদেশের মানুষ স্বাধীনভাবে মর্যাদার সঙ্গে সুবিচার ও সাম্যের মধ্যে বসবাস করবেন।
আমি এই সুযােগে মুক্তিবাহিনীকে তাদের বীরােচিত সংগ্রামের জন্য ধন্যবাদ জানাই। তারা খুব ভালােভাবেই জানেন যে, বিশ্বাসীর মৃত্যু নেই এবং স্বাধীনতা ও স্বাধীকার অর্জনের জন্য মানুষের যে আকাক্ষা তা কোনােদিনই অবদমিত করা যায় না। দৃঢ়চিত্ত এবং আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তারা গত প্রায় আট মাস ধরে পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর মােকাবিলা করে চলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে মুক্তিবাহিনীর ভূমিকা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তাঁরা স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন বলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাঁচতে চেয়েছিলেন বলে একটি সমগ্র জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার স্থির সংকল্পে আবদ্ধ সুসজ্জিত এক সেনাদল মানব ইতিহাসের জঘন্যতম বলি হিসেবে এক কোটি শরণার্থীকে ভারতে ঠেলে দিয়েছিল। পাক বাহিনীর লােকেরা আমাদের সীমান্তের গ্রামগুলােতে গুলিগােলা বর্ষণ করে ফলে এ দেশের নাগরিকরা এবং যারা শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন তাঁরাও অনেকে হতাহত হয়েছেন। এই মর্মান্তিক গণহত্যা এবং আমাদের উপর অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে চাপ পড়েছে সে সম্পর্কে বিশ্ব জনমতকে জাগ্রত করার জন্য ভারত প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি- যাদের উপর জন্ম লগ্নেই আমাদের পূর্ণ আস্থা ছিল। তাদের সঙ্গে আলােচনা ক্রমে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার কথা বলেছিল ভারত। ইতিমধ্যে নয় মাস সময় অতিক্রান্ত হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের দুর্দশা দূরীকরণের জন্য বিশ্ব শক্তিগুলাে থেকে কোনাে ফলপ্রসু ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। দুর্দশাগ্রস্ত এই লক্ষ লক্ষ লােকের প্রতি আমাদের আন্তরিকতার জন্যই আমাদিগকে যুদ্ধের হুমকি দেওয়া হয়েছিল এবং সবশেষে এক সর্বাত্মক যুদ্ধও আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলাে। পাকিস্তান ৩ ডিসেম্বর (১৯৭১) তারিখে আমাদের দেশ আক্রমণ করল। যুগ যুগ সঞ্চিত সহ্যশক্তি ও শান্তির প্রতি আনুগত্যের জন্য আমরা গর্বিত; কিন্তু যখন আমাদের উপর এক চ্যালেঞ্জ এসে পড়ল তখন আমাদের দেশ তার এক মােগ্য জবাব দিতে দ্বিধা করেনি। একপক্ষ কালের থেকেও কম সময়ে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, সাহসি ও সুশৃঙ্খল সদস্যরা এবং মুক্তিবাহিনী এই আক্রমণের এক বিরােচিত জবাব দিয়েছেন এবং বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে।
বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের ও বাংলাদেশের নাগরিক, সৈন্য বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর বহু মূল্যবান জীবন বিনষ্ট হয়েছে। এক মহান উদ্দেশে ভঁরা শহীদ হয়েছেন; তাঁদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই! গণতন্ত্রের মূল্য বৃহৎ; আর এ মূল্য সকল সময়ই ফল দায়ক। বাংলাদেশে যা ঘটেছে তা প্রকৃতই মর্মান্তিক, এক দানবীয় শক্তির হাতে লক্ষ লক্ষ জীবনকে বলি হতে হয়েছে। কিন্তু এই নৃশংস বাহিনীকে যুদ্ধে পরাজিত করার জন্য ঐক্যবদ্ধ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের অজেয় আকাক্ষাই শেষ পর্যন্ত এই ঐতিহাসিক সাফল্য বহন করে আনল।

সূত্র: ত্রিপুরা
২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
৬ পৌষ, ১৩৭৮

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!