You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.22 | বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে আরও একটি অগ্রসর পদক্ষেপ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে আরও একটি অগ্রসর পদক্ষেপ

ভারত-যুগােস্লাভ যুক্ত বিবৃতিকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। সাম্রাজ্যবাদবিরােধী, উন্নয়নকামী ও শান্তিপ্রিয় জাতি মাত্রেই এই বিবৃতিকে অভিনন্দন জানাবেন।
কিন্তু জঙ্গী পাকিস্তানী শাসকচক্র নিতান্তই দু কান কাটার মতাে এই বিবৃতিতেও আপত্তির যথেষ্ট কারণ খুঁজে পেয়েছে। তারা বলেছে এই বিবৃতি হচ্ছে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ।”
যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে বাঙলাদেশের সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর দরুন ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী এসেছেন, প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থীর আগমন এখনও অব্যাহত আছে। ফলে ভারতবর্ষের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ পড়েছে। সেই সঙ্গে এই দেশে “গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনার ভাব” বিরাজ করছে।
এই অবস্থার অচিরে অবসান প্রয়ােজন। কিভাবে?
বাঙলাদেশের অবস্থা যদি স্বাভাবিক হয়, একমাত্র তা হলেই শরণার্থী আগমন বন্ধ হবে এবং ভারতবর্ষে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীরা মনে আস্থার ভাব ফিরে পাবেন, মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের সাহস সঞ্চয় করবেন।
সুতরাং প্রয়ােজন জনমনে এই আস্থার ভাবটি ফিরিয়ে আনা।
তার জন্য দরকার বাঙলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণীয়” একটি “রাজনৈতিক সমাধান।”
অর্থাৎ শুধু বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বার্থেই নয়, ভারতবর্ষেরও স্বার্থে ভারত যুগােস্লাভ যুক্ত বিবৃতিতে বাঙলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে : “সমস্যাটির সমাধানের ব্যাপারে বিলম্ব ঘটলে এক গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।”
পাকিস্তানের জঙ্গী শাসকচক্র “বাঙলাদেশ সমস্যার” ঐ “রাজনৈতিক সমাধান” প্রসঙ্গে বলেছেন- এ ব্যাপারটি পাকিস্তানের একেবারে নিজস্ব ব্যাপার। এ প্রসঙ্গে কোনাে বিদেশী রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবেনা ।
কোনটা অভ্যন্তরীণ সমস্যা? প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতবর্ষে আসতে বাধ হয়েছেন, আরও কয়েক কোটি পা বাড়িয়ে আছেন- এইটা? ভারতবর্ষের অর্থনীতি বিপর্যস্থ হচ্ছে এইটা?
ভারত যুগােস্লাভ যুক্ত বিবৃতিতে ইন্দোচীন, ইস্রায়েল প্রভৃতি বহু প্রশ্নেই সঠিক মতামত প্রকাশ করা হয়েছে। সেই প্রসঙ্গেও বাঙলাদেশের কথা এসেছে।
লক্ষণীয় যে যুগােস্লাভিয়া বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে তার পূর্ব-অবস্থান থেকে অনেকখানি সরে এসেছে।
চীন এবং আলবানিয়া বাদে পৃথিবীর সমস্ত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিই বাঙলাদেশ প্রসঙ্গে ধীর এবং অনিবার্য গতিতে সঠিক অবস্থান নিচ্ছেন- এ ঘটনা আজ দিবালােকের মতােই স্পষ্ট। ভারত-সােভিয়েত যুক্ত বিবৃতি এবং বাঙলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের ক্রমবর্ধমান সাফল্য এই রাজনৈতিক পরিণতির পক্ষে প্রভুত প্রেরণা যুগিয়েছে।
পাকিস্তানের সামরিকচক্র বলেছে : “বাঙলাদেশ সমস্যা বিষয়ে ভারতবর্ষের প্রতিক্রিয়া বােঝা যায়। কিন্তু মার্শাল টিটোর ব্যাপারটা খুবই বিস্ময়কর।”
একটা দেশের নিবাচিত ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী জেলে পচছেন- এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একটা দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল “বেআইনী”– এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একটা দেশে গণতন্ত্র ও জীবনের সমস্ত নিরাপত্তা খুব হয়ে গেছে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। একটা দেশে লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষকে পশুর মতাে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার রমণীকে ধর্ষণ করে উন্মাদ বানানাে হয়েছে; একটা দেশে স্বাভাবিক জীবন বলে আর কিছু রইল না- এতে বিস্ময়ের কিছু পাওয়া যায় নি। একটা দেশের এক প্রকাণ্ড জনসংখ্যা শরণার্থী হয়ে দুঃসহ জীবনযাপন করছে এতেও নাকি বিস্ময়ের কিছু থাকে নি।
শুধুই বিস্ময় টিটোর প্রতিক্রিয়ায়।
পাক জুন্টা নির্বোধ নয়। তারা ঠিকই বুঝেছে নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগােষ্ঠীর মধ্যে ভারত যুগােস্লাভ বিবৃতি নতুন আলােড়ন সৃষ্টি করবে।
বাঙলাদেশের জনগণ ও তাদের অপরাজেয় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নতুন করে তৃতীয় দুনিয়ার মানুষরা দাঁড়াবে।
এই বিবৃতি তারই পূর্বাভাস মাত্র।

সূত্র: কালান্তর, ২২.১০.১৯৭১