You dont have javascript enabled! Please enable it!
আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সাথে বঙ্গবন্ধুর দাওয়াতবিহীন সাক্ষাৎ
তাজউদ্দীনের বাকশাল বিরোধিতা, পদত্যাগ ও দুর্নীতির সন্ধান (!! ??)
:::::::::::::::::::::::
একদিন তিনি অফিসে এলেন। দেখলাম মেজাজ খুব খারাপ। যে দিন দেখতাম তার মনমেজাজ ভাল নেই সে দিন তিনি নিজে না ডাকা পর্যন্ত আমরা সামনে যেতাম না। সে দিন কিছুক্ষণ পর তিনি নিজেই আমাকে ডেকে নিলেন। খুব গম্ভীর হয়ে আছেন। বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আজ সকালের কাগজগুলাে আপনি পড়েছেন ?’ আমি বললাম, ‘স্যার, কিছু কিছু পড়েছি। আর আজ তাে একটাই নিউজ আছে লাল বাহিনী সম্পর্কে। মাথায় লাল পট্টি দিয়ে ওরা অফিসার ফজলুর রহমানকে ধরেছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আপনার প্রতিক্রিয়া কী ? আমি বললাম, স্যার, আমার কথা তাে খুব সহজ, সরকারি কর্মকর্তাদের মরাল ভেঙে দিয়ে প্রশাসন চালাতে পারবেন না। তিনি বললেন, একদম ঠিক। এই কথাই আমি আপনার থেকে আশা করেছিলাম।’ তাজউদ্দীন সাহেব তখনই লাল টেলিফোনের রিসিভারটা তুলে বঙ্গবন্ধুকে ফোন করে বললেন, ‘মুজিব ভাই, কী হচ্ছে দেশে ? আপনার আশেপাশে যারাঘুরছে তারা তাে দেশটাকে শেষ করে ফেলার সব ব্যবস্থা করে ফেলছে। তারা আপনাকে ভুল চিত্র দিচ্ছে। দেশটা রসাতলে চলে যাচ্ছে। আপনাকে আমি এই বিষয়ে অনেকবার সাবধান করেছি, কিন্তু আপনি আমার কথা শুনলেন না। আমি এই মুহুর্তে আপনার কাছে আসছি, আমি আপনাকে সামনাসামনি কথাগুলাে বলতে চাই এবং এ বিষয়ে একটা বােঝাপড়া করতে চাই।’ ফোন রেখেই তিনি গাড়ি বের করতে বললেন।
 
বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ড. ফরাসউদ্দীনের সাথে আমার সম্পর্ক অত্যন্ত ভাল ছিল। তাজউদ্দীন সাহেব বের হয়ে যাবার বেশ কিছুক্ষণ পর ফরাসউদ্দীন আমাকে ফোন করে বললেন, সাইদ ভাই, আমার এখানে তাে কুরুক্ষেত্র ব্যাপার। আপনার বস তাে সাংঘাতিক রেগে এসেছেন দেখলাম। আমি তাঁকে লাল বাহিনীর ঘটনাটি বললাম। ফরাসউদ্দীন আমাকে বললেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর রুমে ঢুকে দেখেন লাল বাহিনীর মান্নান এবং শেখ মণি বসা। তিনি সাথে সাথে বলেছেন, এরা যতক্ষণ এখানে রয়েছে। ততক্ষণ আমি আপনার সাথে কোন কথা বলতে চাই না। ওদেরকে এখান থেকে চলে যেতে হবে। তারপর তারা পাশের রুমে চলে গেলে দু’জন কথা বলেছেন। খুব সম্ভবত তাজউদ্দীন সাহেব সরকারি কর্মকর্তাদের ডিফেণ্ড করে কথা বলেন। এই ঘটনার পরদিন দেখলাম লাল বাহিনীর কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে গেল। তাজউদ্দীন সাহেবের একটা ব্যাপার ছিল, তিনি বঙ্গবন্ধুর ভালোর জন্য, দেশের মঙ্গলের জন্য যে কোন কিছু বলতে বা করতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু এমন কিছু লােকজন ছিল যারা সব সময় তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর কাছে মিথ্যা কথা বলত। এসবের ফলেই হয়ত দু’নেতার মধ্যে ক্রমশ দ্বিমত দেখা দিল। একটা সময় এল যখন তাজউদ্দীন সাহেবকে দেখে খুব বিষন্ন মনে হত। আমি মাঝে মাঝেই আমার সহকর্মী মাযহারকে (সহকারী একান্ত সচিব) বলতাম, ‘স্যারকে এরকম বিষন্ন মনে হয় কেন ? তিনি তাে সব সময় হেসে হেসে কথা বলতেন, আর আজকাল মনে হয় তাঁর হাসিটাও যেন বিষন্নতায় ভরা।’ মনে হত খুব বেশি রকম চিন্তিত তিনি।
 
তাজউদ্দীন সাহেবের একটি অভ্যাস ছিল, তার দুটো হাতেরই বুড়াে আঙুল তর্জনীর অগ্রভাগ দিয়ে ছুঁয়ে রাখতেন। যখন তিনি খুব চিন্তিত, অথবা কোনবিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করছেন তখন এই দুই আঙুল খুব দ্রুত স্পর্শ করতেন, মনে হত আঙুল খুঁটছেন। এক দিন আমাকে তার রুমে ডেকে নিতেই দেখলাম উদ্বিগ্ন চেহারায় বসে আছেন এবং দ্রুত আঙুল খুঁটছেন। আমি বুঝে ফেললাম তিনি বিশেষ কোন ব্যাপারে হয়ত চিন্তিত আছেন। এমন অবস্থায় আমি সাধারণত কোন কথা বলতাম না, তাই চুপ করে রইলাম। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আত্মগতভাবে তিনি বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আর পারা গেল না, আর থাকা যাবে না। এই মানুষটির সাথে আর থাকা যাবে না। আওয়ামী লীগের বেশির ভাগ মানুষই অমানুষ হয়ে গেছে। এরা যে সমস্ত পলিসি নিচ্ছে, যে সমস্ত কাজ করছে, তাতে আর থাকা যায়।’ আমি একটু আপত্তি করার চেষ্টা করলাম। তিনি বললেন, আপনি ভেতরের খবর জানেন না। অসম্ভব, এদের সাথে থাকা অসম্ভব।
 
এদিকে কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের এবং বিশ্বব্যাংকের মিটিং ছিল সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে। এ ছাড়াও তৎকালীন সোভিয়েট ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরােপীয় কয়েকটি দেশ থেকে রাষ্ট্রীয় দাওয়াত ছিল তাঁকেসহ মােট চারজনের। আমি এই দাওয়াতটির কথা উল্লেখ করে বললাম, ‘স্যার, আপনি বাকি তিনজন কাকে কাকে সিলেক্ট করবেন ? তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আমাকে একটা দিন সময় দিন।’ এক দিন পর আমি আমার টেবিলের উপর রাখা একটি নােট দেখলাম। তিনি লিখেছেন: অনুগ্রহ করে ওই সমস্ত দেশের সরকারকে জানিয়ে দিন, বাংলাদেশ থেকে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার একান্ত সচিব আবু সাইদ চৌধুরী প্রতিনিধিত্ব করবেন। এই বিষয়ে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিন। আমি এই নােট পড়ে সঙ্গে সঙ্গে অর্থমন্ত্রীর রুমে গেলাম। তাকে বললাম, স্যার, এটা আপনি কী করলেন ? আপনি তাে শত্রু হওয়ার ব্যবস্থা করলেন। দল থেকে কাউকে নেবেন না, এতে আপনি শত্রু হয়ে যাবেন।’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, এর কারণ আছে। আমি যদি দল থেকে দু’জনকে সাথে নেই তাহলে আরও শত্রুতা তৈরি করব। আমি তবুও তাঁকে বললাম, স্যার, তবুও আর একটা দিন ভেবে দেখেন।’ পরদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘আমার সিদ্ধান্ত একই আছে।’সেই পুরাে ট্রিপটা আমরা দুজনে পাশাপাশি আসনে ছিলাম। দেশ নিয়ে, দল নিয়ে তিনি দীর্ঘ সময় কথা বললেন। তিনি নিজেই এক একটা ইস্যু তুলতেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন। আমি কখনও পক্ষে বলতাম, আবার কখনও বিপক্ষে যুক্তি দিতাম। বিভিন্ন ইস্যুতে তিনি কথা বলছেন। তিনি যেন নিজের কাছে নিজের মনের কথাগুলােকে আরাে স্পষ্ট, আরাে পরিষ্কার করে নিতে কথাগুলাে বলছেন। ভারি আস্তে করে চৌধুরী সাহেব’ বলে এক একটা ইস্যু তুলতেন।
 
তারপর তাে আমরা এক এক করে বিভিন্ন দেশে গেলাম। প্রতিটি দেশেই আমাদের রাষ্ট্রদূতেরা বললেন, স্যার, আর টিকতে পারছি না। দেশের যা অবস্থা তাতে এখানে খবরের কাগজে সরকার সম্পর্কে কিছু না কিছু কথা থাকছে, বিভিন্নভাবে কথাবার্তা হচ্ছে এবং রাষ্ট্রদূত বা রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে এগুলাে খণ্ডন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্ত কথাবার্তা শােনার পর তাজউদ্দীন সাহেবের মনমেজাজ খুব খারাপ হয়ে গেল। তিনি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন, এমনকি আমার সাথেও কথা বলা প্রায় বন্ধ করে দিলেন। এই সময়টাতে তিনি বার কয়েক বললেন, আর থাকা যায় না। এই সফরের এক পর্যায়ে আমরা যখন মস্কো গেলাম তখন সেখানে রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুর রহমান খান (আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী)। তার বাড়িতে এক রাতে খেতে বসেছি—তাজউদ্দীন সাহেব, রাষ্ট্রদূত, তাঁর স্ত্রী এবং আমি—এমন সময় বাংলাদেশ থেকে ফোন এল। বঙ্গবন্ধু অর্থমন্ত্রীর সাথে কথা বলবেন। তাজউদ্দীন সাহেব ফোন ধরলেন, বললেন, ‘মুজিব ভাই, আপনাকে আমি আমার যা বলার ছিল বলে দিয়েছি। আর আমি এই ব্যাপারে কোন কথা বলব না। সিদ্ধান্ত আপনার।’ আমি ওই পাশের কথা তাে শুনতে পাচ্ছি না। শুধু তাজউদ্দীন সাহেবেরটা শুনছি। তিনি আবার বললেন, ‘আমি আপনাকে এভাবে আমেরিকা যেতে নিষেধ করেছিলাম। আপনার জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যাবার ব্যবস্থা হলে তখন আপনি রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সেখানে যাবেন। আপনি জাতিসংঘে যাচ্ছেন, সেখান থেকে দেশে ফিরে আসুন। কিন্তু আপনি যদি ওভাবে ওয়াশিংটন যেতে চান তবে যান, আমার আর করার কিছু নেই।
 
ভীষণ মন খারাপ করে তাজউদ্দিন সাহেব ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রেখে বললেন, ‘একসাথে আর থাকা গেল না। আমাদের সফরের শেষ পর্যায়ে ওয়াশিংটনে আমরা বিশ্বব্যাংকের সভার জন্য পৌছে দেখি, বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কে পৌঁছে গেছেন এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের সাথে তাঁর জন্য ১৫ মিনিটের সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাজউদ্দীন সাহেব এই জায়গাতেই দ্বিমত পােষণ করেছিলেন যে, কেন বঙ্গবন্ধু দাওয়াত ছাড়া এভাবে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করবেন। বঙ্গবন্ধুর মর্যাদায় কোন রকম আঁচড় পড়বে এটা তাজউদ্দীন সাহেবের পক্ষে মেনে নেয়াটা খুব কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি আগেও বলেছি, তিনি যা কিছু করতেন সবচাইতে আগে বঙ্গবন্ধুর মঙ্গল চিন্তা করতেন। তাজউদ্দীন সাহেব স্বভাবতই সত্যবাদী মানুষ ছিলেন এবং তার খুব ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তিনি সমস্ত কিছু খােলাখুলি বলতেন। অর্থাৎ দেশের মঙ্গলের জন্য যা বলা দরকার, তিনি সে কথাই বলতেন। পাশাপাশি তাঁর সাংঘাতিক গুণ ছিল, যখন দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতেন তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর সম্মান, মর্যাদাকে তুলে ধরেছেন সবচাইতে আগে। বঙ্গবন্ধুর ওয়াশিংটন সফরের সময় তাঁর সাথে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা দেখা করবেন, এই জন্য তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুর আলােচনার মূল বিষয়গুলাে আলাদা করে তৈরি করলেন। বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে অন্যান্য কর্মকাণ্ডে তার সুচিন্তিত মতামত এবং সহযােগিতা প্রদান করেন। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুকে রিসিভ করতে যাই। বঙ্গবন্ধুর সাথে ফোর্ডের মিটিং ফলপ্রসূ হয়নি। তাজউদ্দীন সাহেব খুব মর্মাহত ছিলেন, কারণ তিনি এমনভাবে দেখা করতে দিতে চাননি। এরপর তিনি দেশে ফিরে এসে বিমানবন্দরে একটু শক্ত বক্তৃতা দিলেন। বললেন, উটপাখির মত ঝড়ে বালিতে মাথা গুঁজে থাকলে চলবে না।
 
এই ৩৭ দিনের বিদেশ সফর থেকে ফিরে আসার দিন কয়েক পর একদিন সকালে তাজউদ্দীন সাহেব অফিসে এসে বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আপনাকে সাক্ষি রেখে একটা কথা বলব। আমি সাথে সাথে বললাম, ‘স্যার, আমাকে সাক্ষি রেখে কী লাভ হবে আপনার ? আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা, কাল আপনি ছেড়ে দিলে আমি অন্য জায়গায় চলে যাব। তাই আমাকে সাক্ষি রেখে আপনার কী লাভ? আপনি বরং আপনার বিশ্বস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিতু কাউকে সাক্ষি রেখে কথা বলেন। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, না, আপনি শুনবেন।’ এই কথা বলেই তিনি বঙ্গবন্ধুকে লাল ফোনে টেলিফোন করলেন। বললেন, ‘আপনার সাথে আমার কতকগুলাে খুবই জরুরী বিষয়ে আলােচনা করাদরকার বলে আমি মনে করি। আপনার ওখানে আপনি লােকজন দিয়ে এত পরিবৃত থাকেন যে সেখানে বসে আপনার সাথে কথা বলার সুযােগ হবে না বা সে রকম পরিবেশও নেই। সুতরাং আপনার সাথে কথা বলার জন্য আমি লাল টেলিফোনটাই বেছে নিলাম। আপনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা, আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সাথে একমত নই। আপনি আমাকে বলুন, কেন আপনাকে এই পথে যেতে হবে ?’ এটুকু বলে তাজউদ্দীন সাহেব থামলেন, তখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু কিছু বললেন। এরপর তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘এক নম্বর কথা, আমি আপনার যুক্তিতে কনভিন্সড় না। দুই নম্বর কথা—এটা প্রশ্ন না, এটা আমার স্টেটমেন্ট বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোন পরিবর্তনের প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। আপনার হাতেই তাে সমস্ত ক্ষমতা আছে, কাজেই একদলীয় ব্যবস্থার পক্ষে আপনি যা বলছেন আমার কাছে এর কোন যৌক্তিকতা নেই। তৃতীয় কথা, আমি আর আপনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগের ২৪-২৫টা বছর একসাথে বাংলাদেশের এমন কোন মাঠ-ময়দান নেই যেখানে যাইনি। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধিশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি অত্যন্ত জোরের সাথে দ্বিমত পােষণ করছি।’ এরপর আরাে দু-চারটি এমনই কথাবার্তা হল। সবশেষে তিনি যে কথাটি বললেন সেটি ছিল প্রফেটিক কথা। তিনি ইংরেজিতে বললেন, ‘বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দা ডােরস্ টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশান। এই কথাটি আমি আমার সমস্ত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মানুষের কিন্তু গত্যন্তর থাকবে না। ভবিষ্যতে আপনাকে কেউ ক্ষমতা থেকে সরাতে চাইলে সেই সরাবার জন্য গণতান্ত্রিক কোন পথ আপনি খােলা রাখছেন না। তখন একটাই পথ খােলা থাকবে আপনাকে সরাবার—আর সেটা হচ্ছে বন্দুক।’
 
মনে হল বঙ্গবন্ধু ফোনের ওই প্রান্তে রেগে গেছেন, তার চিৎকারের শব্দ টেলিফোনের বাইরেও ভেসে আসছিল। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, কিন্তু মুজিব ভাই, সবচাইতে দুভার্গ্যজনক ঘটনা কী ঘটবে জানেন, আপনাকে এত নিষেধের পরেও আপনার সাথে ওই বন্দুকের গুলিতে আমরাও মারা যাব। আপনি তাে শুধু মারা যাবেন না। দেশটারও ভয়ানক ক্ষতি হয়ে যাবে।’ এর কিছুদিন পরে তাজউদ্দীন সাহেবকে আমি বলেই ফেললাম, “স্যার, এই অবস্থায় আপনি তাে বলছেন আর আপনি থাকতে পারছেন না বা থাকতে চাইছেন না, তবে আপনি কেন বঙ্গবন্ধুকে বলছেন না যে আপনি থাকবেন না ?’ তিনি বললেন, ‘চৌধুরী সাহেব, এই ব্যাপারে এইভাবে মুজিব ভাইকে বলায় আমার একটা অসুবিধা আছে, আপনারা সেটা জানেন না। আমি বললাম, ‘স্যার, কী অসুবিধা আমাকে বলেন। তিনি বললেন, ‘স্বাধীনতার আগের দীর্ঘ সময়ে হয়ত আমি তার পাশে গেছি, নয়ত তিনি আমার পাশে এসেছেন। শুধুমাত্র যখন কারাগারে বন্দি থাকতাম তখন আমরা দুজন বিচ্ছিন্ন থাকতাম। এই যে একটা গভীর সম্পর্ক এ থেকে তাঁর প্রতি আমার একটা বিশ্বস্ততা গড়ে উঠেছে। এখন তিনি যদি আমাকে চলে যেতে বলেন আমি বেরিয়ে যাব, কিন্তু তাকে আমি সরাসরি বলব এই বিষয়টি আমার যেন কেমন মনে হয়, যদিও আমি মনেপ্রাণে চাচ্ছি আমি থাকব না।’ এর পরের কয়েকটা দিন দেখতেই পাচ্ছিলাম খুব অনিশ্চিত একটা অবস্থা। অক্টোবরের ২৬ তারিখ সকালবেলা তাজউদ্দীন সাহেব যখন সচিবালয়ে এলেন দেখলাম তিনি খুব উফুল্ল মেজাজে আছেন। পরে বুঝেছিলাম তিনি জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে। যাই হােক আমাকে ডেকে বললেন, “আজ আমি কারাে সাথে দেখা করব। যে সমস্ত প্রােগ্রাম আছে সেগুলাে বাতিল করে সবাইকে জানিয়ে দিন। আমি নূরুল ইসলামের (ডেপুটি চেয়ারম্যান, পরিকল্পনা কমিশন) রুমে যাচ্ছি। আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা থেকে ফোন আসবে, তখন আমাকে একটু খবর দেয়ার ব্যবস্থা করবেন।’
 
কিছুক্ষণের মধ্যে দেখি মন্ত্রিপরিষদ সচিব তওফিক ইমাম এবং যুগ্মসচিব হাবিবুল হক এসেছেন। দু’জনেরই চেহারা খুব মলিন, হাতে দুটো খাম। তওফিক ইমাম সাহেব বললেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব কোথায় ? আমি বললাম, তিনি নিচে নূরুল ইসলাম সাহেবের রুমে আছেন। খুব জরুরী বিষয় নাকি ?তিনি বললেন, ‘ভীষণ জরুরী। আমি আবার বললাম, ‘কী এত জরুরী ? তিনি বললেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই জানতে পারবেন। আপনি আমাদের মুখ থেকে নাই বা শুনলেন।’ তাঁরা দু’জনে নূরুল ইসলাম সাহেবের রুমে চলে গেলেন। ১০ মিনিটের মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব তার অফিসরুমে চলে এলেন। আমাকে ডেকে বললেন সচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ সাহেবকে ডাকতে। কফিলউদ্দিন মাহমুদ সাহেব এলে তাঁর দিকে তিনি একটি চিঠি এগিয়ে দিলেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে এসেছে অর্থমন্ত্রীর জন্য ছােট একটি চিঠি। লেখাটা ছিল অনেকটা এমন শুভেচ্ছা নেবেন। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে আপনার মন্ত্রী পদে থাকা ঠিক হবে না। তাই আপনাকে ইস্তফা দেবার জন্য বলা হচ্ছে—বা এই রকম কিছু আর এইসাথে পদত্যাগপত্র পাঠানাে হল স্বাক্ষরের জন্য। ইতি—শেখ মুজিবুর রহমান। কফিল উদ্দিন মাহমুদ সাহেব পড়লেন এবং পড়া শেষ করে চিঠিটি আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে একদম কেঁদে ফেললেন। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। তিনি দু-তিনবার শুধু বললেন, ইয়া আল্লাহ্, ইয়া আল্লাহ্। এরপর তাজউদ্দীন সাহেব টাইপ করে পাঠানাে পদত্যাগপত্রে সই করে দিলেন। পদত্যাগপত্রটা হাতে নিয়ে সচিব এবং যুগ্মসচিব বললেন, স্যার, কিছু মনে করবেন না, আমাদেরকে এরকম একটি অপ্রিয় কাজ করতে হল। বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক সম্মেলন করবেন। সমস্ত মন্ত্রীরা বসা এবং প্রেস বসা। গুরুত্বপূর্ণ অফিশিয়ালদেরও তিনি ডেকেছেন। পদত্যাগপত্র নিয়ে এই দু’জন চলে গেলেন। তারপর তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন, তিনি খবর পেয়েছেন আর্মি এবং পুলিশকে সতর্ক করে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, তাজউদ্দীনের গতিবিধির ওপর কড়া দৃষ্টি রাখুন। এমনকি আর্মিরা সচিবালয়ের চারপাশ ঘিরে রেখেছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, আমি এখন একবার মন্ত্রণালয়ে সবার সাথে দেখা করে বাসায় ফিরে যাব।’ মাযহারকে বললেন, “আরহাম সিদ্দিকীকে (তার বন্ধু) ফোন করে বলুন তাঁর গাড়িটা পাঠাতে। আমি আর সরকারি গাড়ি ব্যবহার করব না।’সচিবালয় ছেড়ে চলে যাবার মুহূর্তে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার আপনি এখন কী করবেন? আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তিনি পরিষ্কার জবাব দিলেন, আমার প্রিন্সিপল কখনও বদল হয় না। আর যেখানে আমার বিন্দুমাত্র কোন পদক্ষেপে, কোন কথাতে মুজিব ভাইয়ের ক্ষতি হতে পারে তেমন কোন অ্যাকশান আমি নেব না।’
 
সেই সময় সংবাদ সংস্থা বিএসএস-এর চীফ ছিলেন জাওয়াদুল করিম সাহেব। তিনি আমার আত্মীয় হন। তিনি আমাকে পরে বলেছিলেন, সাইদ, একটা ব্যাপার দেখলাম তাজউদ্দীন সাহেবের পদত্যাগের দিন, বঙ্গবন্ধু একটা সাংবাদিক সম্মেলন ডেকেছিলেন, সেখানে দেখলাম তিনি অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত। তাঁর চেহারায় একটা দুঃখের ভাব ফুটে উঠেছে। কিন্তু একমাত্র খন্দকার মােশতাককে দেখলাম যার মুখে একটা ক্রুর হাসি। এমন একটা ভাব যে, হয়ে গেছে ব্যাপার, যা চেয়েছিলাম আমি করে ফেলেছি। এই জিনিসটা খুব লক্ষণীয় ছিল। খন্দকার মােশতাকের চেহারাটা এমন যে, সম্ভব হলে আনন্দে তিনি সবার সাথে কোলাকুলি করেন। মুখে ক্রুর একটা হাসি নিয়ে তিনি খুশি হয়ে ছুটোছুটি করছিলেন। আমাদেরকে প্রায় জড়িয়ে ধরছিলেন। জাওয়াদুল করিম আমাকে বলেছিলেন, তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে বঙ্গবন্ধুর যে দ্বন্দ্ব, এটা তৈরি করেছে খন্দকার মােশতাক। এই লোেকটা কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে ধ্বংস করবে।
 
‘৭৫-এর ১৫ অগাস্ট সকালে আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে ফোন করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘চৌধুরী সাহেব, আমার জন্য সবচাইতে দুঃখের ব্যাপার কি জানেন, মুজিব ভাই হয়ত মনে করে গেলেন আমিই এই ঘটনা ঘটিয়েছি। তিনি জেনেও গেলেন না তার কত ঘনিষ্ঠ লােক এই কাজটি করল। আমি তাে জানি তাজউদ্দীন সাহেব বঙ্গবন্ধুকে কী পরিমাণে ভালবাসতেন। মনে হল কেমন যেন একটা বিষন্নতা কাজ করছে তার মধ্যে। এরপর অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে আমি আমার অফিসে কাজ করছি। (আমি তখন উপসচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়, বিশ্বব্যাংক ডেস্ক), এমন সময় দাড়িওয়ালা একজন ভদ্রলােক হাতে একটা ফাইলসহ এসে বললেন তিনি বঙ্গভবন থেকে এসেছেন। বঙ্গভবন শুনে আমি একটু সতর্ক হলাম। ভদ্রলােকবললেন, তিনি গােয়েন্দা সংস্থার ইন্সপেক্টর, আমার কাছে এসেছেন তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে কিছু তথ্যের জন্য। আমি বললাম, তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে আপনি কী জানতে চান ? তিনি বললেন নি তাজউদ্দীন সাহেবের একান্ত সচিব ছিলেন, আপনি নিশ্চয়ই জানবেন তিনি কোন দুর্নীতি করেছেন কিনা বা অন্যায় কোন নির্দেশ দিয়েছেন কিনা।’ লােকটি বঙ্গভবনের কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে বললেন, তারা আজকে আমাকে বলে দিয়েছে আমি যদি তাজউদ্দীন সাহেবের বিরুদ্ধে কোন কিছু না নিয়ে আসতে পারি তাহলে আমাকে একদম গুলি করে দেবে। আমি রােজই খোঁজ করছি তার বিরুদ্ধে কিছু পাই কিনা, কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না।’ লােকটি কেঁদে ফেলবেন এমন তার অবস্থা। আমি তাকে বললাম, আপনি আল্লাহভক্ত একজন মানুষ, আমিও আল্লাহূকে ভয় পাই। সুতরাং একজন আল্লাহভক্ত লােক আর একজনের সাথে কথা বলছেন। শুনে রাখুন, তাজউদ্দীন সাহেব কোন দুর্নীতি করেননি। তিনি এর অনেক ঊর্ধ্বে ছিলেন। আর তিনি যদি দুর্নীতি করতেনও আমি আপনাকে বলতাম না।’ লােকটি বললেন, ‘স্যার, আমি তাে বুঝতে পারছি, কিন্তু ওরা আমাকে মেরে ফেলবে। এরপর তিনি একটা ফাইল বের করলেন। একটি চিঠি দেখিয়ে বললেন, ‘স্যার, দেখুন তাে এই চিঠিটি আপনার কিনা?’ আমি দেখলাম তৎকালীন ঢাকা পৌরসভার চেয়ারম্যানকে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব হিসেবে লেখা আমার চিঠি। সেই চিঠিতে আমি পৌরসভার আইনের একটি ধারা উল্লেখ করে লিখেছিলাম যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে ৭৫১ সাত মসজিদ রােড, ধানমন্ডির বাড়িতে তাজউদ্দীন আহমদ বসবাস করেননি এবং কোন ভাড়াও ছিল না, যা ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত। তাই এই বাড়ির ট্যাক্স কিছু কম হবে। এমন একটা চিঠির নিচে আমার সই আছে। সেই চিঠিটা সংগ্রহ করে নিয়ে এসেছেন দেখে আমি হেসে ফেললাম। বললাম, এর মধ্যে আপনি দুর্নীতির কী গন্ধ পেলেন?’ লােকটি বললেন, না, না, স্যার, আমি তা বলছি না, এটা আপনার লেখা কিনা, এই সম্বন্ধে আপনার বক্তব্য কী ?’ আমি বললাম, আমার বক্তব্য তাে পরিষ্কার করে এই চিঠিতে লেখাই আছে। আর তাে নতুন কোন বক্তব্য নেই। আমি এক সময় পৌরসভার প্রশাসক ছিলাম, তাই আমার সমস্ত আইনজানা ছিল। আমি সেই আইনের ধারা উল্লেখ করে চিঠি দিয়েছিলাম। তাজউদ্দীন সাহেব এই বিষয়ে আমাকে কিছু বলেননি। আমিই তাঁকে বলেছিলাম, আইন যখন আছে, আর আপনি যখন এতদিন সেই বাড়িতে ছিলেন না, তখন বেশি ট্যাক্স কেন দেবেন? এরপর বই পড়ে আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে সেই ধারা শশানালাম। তখন তিনি বললেন, প্রমাণ তাে দিতে হবে। আমি সেইজন্যই লিখলাম ঐতিহাসিক কারণে তিনি অনুপস্থিত ছিলেন। অর্থাৎ ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত ১৯৭১। আমি এই চিঠির একটি কপি করে রাখলাম। লােকটি চলে গেলেন। আমি তাজউদ্দীন সাহেবকে অসম্ভব বেশি রকমের মিস্ করি। আমি মনে করি তিনি জীবিত থাকলে নিঃসন্দেহে এই বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এ কারণেই খন্দকার মােশতাক তাকে হত্যা করিয়েছিল। আমি তাজউদ্দীন সাহেবের বঙ্গবন্ধুর সাথে কথােপকথনের সেই প্রফেটিক উচ্চারণের কথা স্মরণ করেছি ১৫ অগাস্ট তারিখে এবং আবার জেল হত্যাকাণ্ডের পর।
 
 
 
Reference:
সাক্ষাৎকার, (৫.১০.১৯৯৬/৭.১০.১৯৯৬) আবু সাইদ চৌধুরী : সরকারি কর্মকর্তা, তাজউদ্দীন আহমদ-এর একান্ত সচিব ১৯৭২-৭৪।
তাজউদ্দীন আহমদ আলোকের অনন্তধারা, সিমিন হোসেন রিমি, পৃষ্ঠা ১৩৩-১৬৮
Unicoded by সংগ্রামের নোটবুক
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!