নিম্নে উল্লেখিত টেপরেকর্ডকৃত সাক্ষাৎকারগুলাে গ্রহণের সময় আমার মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আমার সাথে ছিলেন। তিনি নিজেও সাক্ষাৎকারগুলােতে মূল্যবান মতামত ও তথ্য দিয়েছেন। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী (১৯৭২-৭৩)
আব্দুস সামাদ আজাদের বাসভবনে ওনার সাক্ষাৎকার ।
কলাবাগান, ঢাকা
৫ জুলাই, ১৯৮৭ ট্রান্সক্রাইব : শারমিন আহমদ
শারমিন আহমদ : ১৯৭৫ সালের কোন সময় আপনি জেলে যান ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর আমাকে ইন্টার্ন করে রাখল। তার বােধ হয় ৭ দিন পর, যতদূর মনে হয় শবেবরাতের রাত ছিল- নামাজ পড়েছি সারারাত, রােজাও রেখেছি। সকাল বেলা সূর্য তখনাে উদয় হয়নি, হঠাৎ পিয়ন এসে বলল একজন অফিসার এসেছে। সাথে দেখি আরও অফিসার এসেছে। তারাও ঘুম থেকে উঠে এসেছে। তারাও ঘটনা উপলব্ধি করতে পারছে না। তারা বলল স্যার। আপনাকে আমাদের নিয়ে যেতে হবে। আমার সন্দেহ হলাে। এর আগেও ঘটনা হয়েছে দুই একটা। আমি বললাম আমি কাপড় চোপড় চেঞ্জ করে আসি’। তারা বলল যে আরও নেতাদের নেওয়া হবে তাে সেই ভাবেই আসেন। আমি তখন একটা ব্যাগে কাপড় চোপড় ভরে আসলাম। আমাদের বাড়ির কাছেই সােহরাওয়ারর্দি উদ্যানে তারা একটি কন্ট্রোল রুম করেছে। সেখানেই তারা নিয়ে গেল। সেখানে গিয়ে দেখি সৈয়দ নজরুল ইসলাম,
মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেব…ও আরও কিছু লােক অন্য রুমে আছে। আমাকে সেখানে নিয়ে গেল। মােট ২৬ জন লােক। ১০ মিনিট পর দেখি তাজউদ্দীন সাহেব আসলেন।
শারমিন আহমদ : দিনটি ২২ আগস্ট ছিল ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : হ্যা ২২ আগস্ট। তাে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে আমরা দুজন আলাপ করলাম। কেন এনেছে, কী ব্যাপার- উনি তাে ক্যাবিনেটেও ছিলেন না। দেল ও সরকার পরিচালনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সাথে মতবিরােধের কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ২৬ অক্টোবর, ১৯৭৪ অর্থমন্ত্রীর পদ হতে ইস্তফা দেন] একটু পরেই ডালিম (মেজর শরিফুল হক ডালিম।] আসল। কামরুজ্জামান সাহেবের সাথে কথা বলে গেল। তখন কামরুজ্জামানকে জিজ্ঞেস করলাম ‘এ কে ? বললেন এই ডালিম’। তখনাে জানি না কী করবে
করবে, মেরে ফেলার জন্য এনেছে না কী করবে? একটু পরে রশীদ [মেজর আব্দুর রশীদ] আসল। সে ইলেকট্রিক কানেকশন আছে কিনা লােক লাগিয়ে পরীক্ষা করল। এরপর সৈয়দ হােসেন সাহেব আসলেন। উনি আগেই এরেস্টেড ছিলেন।
শারমিন আহমদ : সৈয়দ হােসেন কে ?
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন- বঙ্গবন্ধুর…
আব্দুস সামাদ আজাদ : বঙ্গবন্ধুর ভগ্নীপতি। তাে ওনার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে রশীদ বলছিল “আপনাকে আমরা এনেছি আপনিতাে কারাগারেই আছেন” [টেপের এই অংশটি অস্পষ্ট] পরে আমরা জানতে পারলাম… রশীদের হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল আমাদের মেরে ফেলবে। এমন ভাবসাব। কারণ ইলেকট্রিক ওয়্যারিং টয়্যারিং করছে। একটু পর দেখি ফটোগ্রাফার আসল । একজন ফটোগ্রাফার আমার সাথে অ্যাটাচড ছিল বিঙ্গবন্ধু প্রশাসনে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে সে বলল স্যার আমাদেরকে ঘুম থেকে উঠিয়ে এনেছে। তারপর দেখি টেলিভিশনের ক্যামেরাম্যানও আছে। তারপর রশীদও চলে গেল। আমরা ভাবছি কিসের জন্য আনল না আনল-এর মধ্যেই আরেকজন এসে বলল আপনারা চলেন। বললাম কোথায় ?’ সে বলল, ‘ঢাকা স্ট্রোল। জেলে ?
শারমিন আহমদ: কে এসে বলল ? | আব্দুস সামাদ আজাদ : কোন এক অফিসার। মিলিটারি অফিসার। বলল সেন্ট্রাল জেলে চলেন। তারপর আমাদেরকে কারে নিল। এই পাঁচ জনকে কারে নিল। শারমিন আহমদ : আব্বুর সাথে কি আপনি ছিলেন ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : হ্যা, আমি, তাজউদ্দীন সাহেব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেব।
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : আহহা ! [দুঃখ প্রকাশ]।
আব্দুস সামাদ আজাদ : আমরাতাে সেন্ট্রাল জেলে ঢুকলাম ঐদিনই। এগারােটা সাড়ে এগারােটায়। দিনের বেলা।
শারমিন আহমদ : বেলা এগারােটা সাড়ে এগারােটা ? আব্দুস সামাদ আজাদ : মনে হয় ঐ রকমই সময়। শারমিন আহমদ : আব্দুকে ধরে নিয়েছিল ২২ আগস্ট বেলাসৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : ৮ টায়।
আব্দুস সামাদ আজাদ : মনে হয় তখন রােদ উঠে গিয়েছিল। সেন্ট্রাল জেলে গিয়ে ঢুকলাম। কী সিচুয়েশন ! সমস্ত জেলখানায় কয়েদিদের তালা বন্ধ করে রেখেছে। আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম এ অবস্থায় কী হবে না হবে। আমি, তাজউদ্দীন সাহেব তাে আগে থেকে জেল খাটা লােক। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। কয়েদিরা হইচই করছে জানালা দিয়ে। জাসদ আছে, নকশাল আছে, তারা নাম ধরে ধরে ডাকছে। এরপরে আমাদের এপ্রুভার সেলে রাখল।
শারমিন আহমদ : কী সেল ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : এপ্রুভার। ঐ যে রাজসাক্ষী হয়। খুব খারাপ সেল। ২০ নম্বর ওয়ার্ড। আমি প্রটেস্ট করলাম। এখানে থাকব না। আমরা তাে জেল খেটেছি। সব ওয়ার্ড জানা আছে। জেলার বলল “স্যার জায়গা তাে নাই। আপনাদের তাে আলাদা রাখতে হচ্ছে।জেনারেলি এইসব হই চইয়ের মধ্যে সৈয়দ সাহেব বের হতে চাননি। আমরা তাে জেল খেটেছি।
শারমিন আহমদ : সৈয়দ নজরুল কি এর আগে জেল খাটেননি?
আব্দুস সামাদ আজাদ : সৈয়দ সাহেব তাে জেল খাটেননি। এই অবস্থায় আমাদেরকে নিল পরে। | (অন্য জায়গায়] আইজির অফিস ছিল একটা এরিয়ায়। সেটা তখন অফিস নাই। সেই বিল্ডিংটাকে (অফিস) খালি করে করে আমাদেরকে নিয়ে গেল বিকাল বেলায়। সেটার নাম নিউ জেল। সেই জেলে রাস্তাও ছিল না, বাগানও ছিল না। তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই বাগান করেছেন। | শারমিন আহমদ : যে সময় [ওখানে ছিলেন তখুনি আব্দু বাগান করেছিলেন ? | আব্দুস সামাদ আজাদ : হ্যা। দুই মাস পর্যন্ত বড় বাগান। কয়েদিদের নিয়ে নিজেই মাটি খুঁড়তেন। সুন্দর বাগান করেছিলেন। এরিয়াটাকে খুব সুন্দর করা আরকি। নিট অ্যান্ড ক্লিন করা। ওটা বাজে জায়গা ছিল। ড্রেন গুলি পচা
ছিল। সেগুলােকে সুন্দর করেন। এইভাবে জেল খানার জীবন চলছে। নানা রকমের রিউমার ডেইলি যায়। প্রথম দিকে ইন্টারভিউ দিচ্ছিল না পরে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু হলাে। আমাদের সকলেরই।
শারমিন আহমদ : কে ইন্টারভিউ দেওয়া শুরু করল ? | আব্দুস সামাদ আজাদ : আমাদের ফ্যামিলির সাথে ইন্টারভিউ । আমাদের সাথে ফ্যামিলি মেম্বাররা দেখা করা আরম্ভ করল।
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : আমাদেরকে প্রথম দিকে দেখা করতে দেয়নি। অন্যদের সাক্ষাতের অনুমতি আগে মিললেও একমাস পরে তাজউদ্দীন আহমদের পরিবারকে সাক্ষাতের অনুমতি দেওয়া হয়]
আব্দুস সামাদ আজাদ : হঁ্যা প্রথম দিকে দেয়নি। পরে ইন্টারভিউ দেয়। তারপরে ফ্যামিলি মেম্বারদের সাথে যতটুকু সময় কাটাই, ফ্যামিলির সমস্যা ছাড়াও, বাইরের খবর টবর কী অবস্থা এই সব জানি। ওরা তখনাে আছে। বঙ্গভবনে মােশতাক, রশীদ, ফারুক (তদানীন্তন মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান] এরা আছে এই খবর টবর পাই। তার কিছুদিন পরে, প্রায় দুই মাস (তখন) হয়ে গিয়েছে। কোন পরিবর্তন কি হবে ? আমরা কি ছাড়া পাব ? [এই চিন্তা ভাবনা শুরু হয়] . (অস্পষ্ট] … -ইনভেসটিগেশন শুরু করেছে স্পেশালি আমাদের এই কজনের। এখানে (ইনভেস্টিগেশনে] মিলিটারি অফিসারসহ চার-পাঁচজন বসেছে। তারা আমাদেরকে প্রশ্ন করে।
শারমিন আহমদ : তারা কী ধরনের প্রশ্ন করে ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : এই সমস্ত পার্সোনাল (বিষয়]- কার কোথায় কী আছে, না আছে। আমাদের বাড়ি-ঘর- প্রপার্টি ইত্যাদি সমন্ধে স্টেটমেন্ট দিতে। হয়। ইনভেস্টিগেশন আরকি। পুলিশের লােক দুইজন আছে। বাকি মিলিটারি। জেল গেটেই। | সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : রাজনৈতিক অবস্থার ওপর তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কী বলতেন? | আব্দুস সামাদ আজাদ : এটা পরে আলাপ করব। পলিটিকাল আলাপটি পরে করব। তােমার সঙ্গে (শারমিন আহমদকে লক্ষ্য করে আলাপ করব। আরেক সিটিংএ।
শারমিন আহমদ : আমি পুরাে ঘটনাটি টেপ করে রাখতে চাচ্ছি। সে সময় কী পরিস্থিতি ছিল ? হয়তাে একদিন আমি বেঁচে থাকি কি আপনি বেঁচে থাকেন। কিন্তু ইতিহাস বেঁচে থাকবে।
আব্দুস সামাদ আজাদ : তারপরে আমাদেরকে প্রথমে ডিভিশন দেয়নি। | প্রথম রাতে আমরা সাধারণ ঘরে…
শারমিন আহমদ : প্রথম কতদিন ডিভিশন দেয়নি ? | আব্দুস সামাদ আজাদ : প্রথম দিন ও রাতটা ডিভিশন দেয়নি। পরদিন | বােধহয় একদিন পরেই আমাদেরকে ডিভিশন দিয়ে দিল। ক্লাস ওয়ান। প্রথম রুমটা ছিল ছােট। সবাই এই রুমে প্রথমে উঠেছিল। এরপরেই ঐ বিল্ডিঙে আরেকটা রুম। তারপরে বড় রুমটা। ঐ রুমটায় আমি চলে গেলাম। আমার সাথে মনসুর আলী সাহেব ছিলেন। [নিউ জেল বিল্ডিং
শারমিন আহমদ : আপনি কত নং রুমে ছিলেন ? আব্দুস সামাদ আজাদ : তিন নাম্বার রুমে। শারমিন আহমদ : তিন নাম্বার রাজবন্দিদের ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : এই বিল্ডিংটা আইজির অফিস ছিল। জেলের ভিতরেই। পরে নিউ জেল নাম দেয়। এটা, ফাঁসি দেয় যে এরিয়ায়, সেটা পার হয়ে আরেকটা ওয়াল আছে, তারপরে এটা। সেটাতেই আমাদের জন্য জেল বানায়।
শারমিন আহমদ : আইজির অফিসের তিন নাম্বার রুমে ছিলেন?
আব্দুস সামাদ আজাদ : না। একটা বিল্ডিং আছে আইজি অফিসের। সেই | বিল্ডিঙের তিনটা রুম। প্রথম রুম হলাে আমরা নিজেরাই নািম্বার] বলতাম
আরকি। প্রথম রুমটায় গিয়ে বসলাম। সবাই ঐ রুমে গিয়ে বসলাম। সন্ধ্যার দিকে দেখলাম ঐ রুমে তাে থাকা যাবে না। মাঝের রুমে গেলেন কামরুজ্জামান ও আরও কিছু লােক। লাস্ট রুমটায় আমি গেলাম মনসুর আলী বললেন ‘আমি সেখানে থাকব।
শারমিন আহমদ : আব্ব কোন রুমে থাকতেন? আব্দুস সামাদ আজাদ : এই প্রথম রুমটায়। এই রুমটা ইতিহাস!
বিড় মর্মান্তিক ইতিহাস। এই এক নম্বর রুমটিতে অন্যান্যদের সাথে। থাকতেন তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বঙ্গভবন থেকে মােশতাক-রশীদের নির্দেশ প্রাপ্ত হত্যাকারীদের আদেশে দুই নম্বর অর্থাৎ মধ্যের রুম থেকে কামরুজ্জামান সাহেব এবং তিন নাম্বার বা শেষ রুম থেকে মনসুর আলী সাহেবকে প্রথম রুমে নিয়ে যায় জেল কর্তৃপক্ষ। বাকি নেতৃবৃন্দকে ঐ রুম থেকে সরিয়ে রাতের গভীরে মুক্তিযুদ্ধের চার নেতাকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। শারমিন আহমদ : আলুর সাথে কেউ ছিলেন?
কে ছিলেন? | ৩ নভেম্বর জেল হত্যার পূর্বাপর ।
আব্দুস সামাদ আজাদ : হ্যা কিছু গেলেন এখানে প্রথম কুমে] আর সবাই রইলেন তিন নম্বর রুমে । বিল্ডিংটা এভাবে লম্বা। এই রুমটা পয়লা পাওয়া যায়। এরপর দুই নম্বর সেখানে কামরুজ্জামান ও সাথে আরও কিছু লােকসঙ্গে যারা ছিল- মায়া শ্রেমিক লীগের নেতা মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী) ও আরও কয়জন। আর লাস্ট রুমে এটা বড় রুম-তিন নম্বর- আমরা বলি আরকি। জেলের নম্বর কী আছে আমরা জানি না। তারপর সেই রুমে প্রথমে আমি আর মনসুর আলী পরে আরও বহু লােক (গেলেন)। | শারমিন আহমদ : আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব কোথায় থাকতেন?
আব্দুস সামাদ আজাদ : ঐ এক নম্বর রুমে। সৈয়দ সাহেব, তাজউদ্দীন সাহেব, শেখ আব্দুল আজীজ, মাখন (ছাত্র নেতা আব্দুল কুদুস মাখন), কোরবান আলী, শেষ পর্যন্ত যারা ছিল আরকি। মােট ৮ জন ছিল। [১নং কামরায় থাকতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ আব্দুল আজীজ, দেলওয়ার হােসেন, আনওয়ার জং, ডা: আসহাবুল হক, কোরবান আলী ও আব্দুল কুদুস মাখন]।
শারমিন আহমদ : দ্বিতীয় রুমে কামরুজ্জামান …
আব্দুস সামাদ আজাদ : কামরুজ্জামান ও আদার্স, প্রায় ১২ জন। তৃতীয়টায় যারা আসত (জেলে) তারা ওখানে যেত। কারণ বড় রুম তাে। যেমন জোহা সাহেব…
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : জোহা সাহেব তাে অনেক পরে গেলেন।
আব্দুস সামাদ আজাদ : হ্যা পরে গেলেন। তিন নম্বর রুমে জায়গা বেশি ছিল। তারপর ১ তারিখে আমাদের ইন্টারভিউ হচ্ছে বিভিন্ন খবরাখবর পাই
শারমিন আহমদ : ১ তারিখ কোন মাসের ? আব্দুস সামাদ আজাদ : নভেম্বর মাসের। পয়লা নভেম্বর। জেলার… শারমিন আহমদ : জেলারের নাম কী ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : মনে হয় মােখলেসুর রহমান। গােপালগঞ্জ বাড়ি। (সঠিক নাম আমিনুর রহমান যা পরে জানতে পারি। এখনাে আছে।
শারমিন আহমদ : এখন উনি কোথায় আছেন?
আব্দুস সামাদ আজাদ : … (অস্পষ্ট) সুপারিটেনডেন্ট ছিল। এখন কোথায় আছে জানি না।
শারমিন আহমদ : আর ডিআইজি প্রিজনের নাম জানেন?
আব্দুস সামাদ আজাদ : আউয়াল সাহেব (আব্দুল আউয়াল), আর আইজি (প্রিজন্স) ছিলেন নুরুজ্জামান।
শারমিন আহমদ : তারপর কী হলাে? পয়লা নভেম্বর ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : পয়লা নভেম্বর তাজউদ্দীন সাহেবের ইন্টারভিs ছিল (বেগম জোহরা তাজউদ্দীনের সাথে)। উনি ডায়েরি লিখতেন। তেন বিকাল বেলায় আমি ও ইনি একটু বেড়াতাম। সকালেও বেড়াতাম, বিকালে ঐ এরিয়ার ভেতরে। বেড়াবার সময় যা কথাবার্তা হতাে। মাঝে মাঝে মিলাদ পড়তাম, খতম পড়তাম। এই সব সময় বসতাম। পার্সোনাল আলাপ-টালাপ হতে বেড়াবার সময়। তাে ঐ দিন বিকাল বেলা (১ নভেম্বর] তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে প্রথম বললেন যে “জেলটা আমার যেন মনে হচ্ছে যে। রেডক্রসে নিলে ভালাে হয়। রেডক্রসের হাতে না নিলে জেলটা মনে হচ্ছে ডেঞ্জারাস…”।
শারমিন আহমদ : মাই গড ! আব্ব এটা বললেন যে জেলটা…
আব্দুস সামাদ আজাদ : এটা পুরা একটা ইম্প্রেশন। ওনার ইপ্রেশনটা। বললেন। তারপর আমাকে বললেন “আপনি দেখেন একটা কিছু করা যায় কিনা। আমিও চেষ্টায় আছি। আপনিও চেষ্টা করেন।”
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : ইশশ ! কী আতঙ্ক ঢুকে গিয়েছিল ! বুঝে গিয়েছিলেন…
শারমিন আহমদ : ওহ! তখুনি আব্ব বুঝতে পেরেছিলেন…
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন : উনি বুঝে গিয়েছিলেন যে জেলে সিকিউরিটি নেই…
আব্দুস সামাদ আজাদ : তখন তাে উলটা আমাদেরকে খবর দেওয়া হয়েছে যে চার পাঁচ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে। তাজউদ্দীন সাহেব তাে সেদিন কথায় কথায় ওনার ইম্প্রেশন বললেন যে “আপনিও চেষ্টা করেন আমিও চেষ্টা করি যে কোনাে ভাবে রেডক্রসে খবর পৌছান যায় কিনা। তারপর সন্ধ্যার পর মনসুর আলী সাহেব আমার পাশের সিটে ছিলেন [৩ নম্বর রুমে পাশাপাশি বিছানায়) উনিও একটু আনমনা। আমাকে বললেন “সামাদ সাহেব, কী যে এরা খবর টবর বলে। এমনি কথায় কথায় শােনা যায় যে মনে হয় ছেড়ে দেবে- কোনাে কেইস তাে [দোষী সাবাস্ত করে কেইস] দাঁড় করাতে পারছে না। কিছুটা প্রাইভেটলি ঐ জেলের ভেতর থেকে খবর যায়।
শারমিন আহমদ : মনসুর আলী সাহেবের সাথে কথা হয় সেদিন সন্ধ্যায় ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : হঁ্যা। সে তাে আমরা এক রুমে থাকি। মনসুর। আলী সাহেব ও আমি পাশাপাশি। মনসুর আলী সাহেব বললেন “সামাদ সাহেব আমাদের জেলখানাটা… মিলিটারির লােকরা আসে যায়। একদিন। রাতে আমাদের সবাইকে [জেল কর্তৃপক্ষ এসে জানিয়ে গেল যে কিছু
মিলিটারির লোকরা যাবে তাে- এখানে গান বাজনা বাচ্চারা তাে গান-টান গায়- ছেলেরা (তরুণ রাজবন্দিরা সময় কাটানাের জন্য কখনাে একত্রে গান গাইতেন] একটু হইচই কম হলে ভালাে হয়-এইসব বলছিল। দুইদিন আগে দেখেছিলাম যে রাতে কিছু মিলিটারির লােক ঐসব (নিউ জেল] এরিয়া দেখেছিল।
শারমিন আহমদ : ঐসব এরিয়া টহল দেয় ?
আব্দুস সামাদ আজাদ : না, না দেখতে গিয়েছিল। তখন তাে কোন গভর্নমেন্ট নাই। জেল কর্তৃপক্ষ জানে না তারা কী করছে। তারা এসে জানাল “আজ রাতে মিলিটারির লােক এসে এরিয়াটা প্রদর্শন করবে। আমরা তাে তখন মিলিটারির রাজত্বে। খুব কড়া রাজত্ব। মােশতাকের গভর্নমেন্ট নামে মাত্র সিভিলিয়ান গভর্নমেন্ট] … তারপর আনফরচুনেটলি মােশতাক ছিল আওয়ামী লীগের। মােশতাকের ক্যাবিনেটও আওয়ামী লীগেরই। তার মানে আগে যারা মেম্বার [ছিল] তারাই মেম্বার ছিল ক্যাবিনেটে। তারপর মনসুর আলী সাহেব আমাকে বললেন রেডক্রসে খবর দিতে। আমি বললাম “হ্যা তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে বলেছেন। দেখি আমি পারি কিনা।”
Ref: ৩ নভেম্বর-জেল হত্যার পূর্বাপর – শারমিন আহমদ, pp 42-49