You dont have javascript enabled! Please enable it!

৩ নভেম্বর : কালরাতের রক্তশিখা

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেটে বসবাসরত মুক্তিযোেদ্ধা সাইদুর রহমান প্যাটেলের সাথে আমার প্রথম ফোনালাপ ও পরিচয় ঘটে ২৩ জুলাই, ২০১৫ ৮৬তম জন্মবার্ষিকীর দিনটিতে। মিশরের জাতীয় বিপ্লব দিবস উদযাপিত হয় ১ দিনে।
১৯৭৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের নিউ জেল বিল্ডিংএ জাতীয় চার নেতার সঙ্গে বন্দী ছিলেন। বেশ ক’বছর আগে জেল হত্যা দিবসের স্মরণসভায় সেই মর্মান্তিক দিনটির প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি বক্তব্য রেখেছিলেন। বক্তব্যটির একটি প্রতিবেদন নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ঠিকানা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেই সূত্রে ওনার নাম জানতে পারি এবং ক্যালিফোর্নিয়া আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা তওফিক খান তুহীনের মাধ্যমে ওনার ফোন নাম্বার যােগাড় করি। শুরু হয় পরিচয় ও জেল হত্যা সম্পর্কে আলাপ।

ঢাকার গেণ্ডারিয়া হাইস্কুলের ছাত্র প্যাটেল রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েন ১৯৬৬ সাল থেকে। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা নগর পূর্বাঞ্চল ছাত্রলীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ঐতিহাসিক বাংলাদেশ ক্রীড়া সমিতি (স্বাধীন বাংলা ফুটবল টিম নামেও ব্যাপক পরিচিত) প্রতিষ্ঠা করেন। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ওনাকে বন্দী করা হয়। ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের নিউ জেল বিল্ডিংয়ের ৩নং কক্ষে তিনি, মনসুর আলী, আবদুস সামাদ আজাদ, বঙ্গবন্ধুর বােনের জামাই সৈয়দ হােসেন ও অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে কারাবন্দি ছিলেন। পাশের ২নং কক্ষে ছিলেন কামরুজ্জামান ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ১নং ক তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আসহাবুল হক, কোরবান আলী, আব্দুল কুদ্স মাখন এম.পি, দেলওয়ার হােসেন প্রমুখসহ মােট আটজন ” থাকতেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষিতে ওনাদেরকে বন্দী করা হয়। ফোনালাপে ওনার কাছ থেকে জানতে পারি সেই ভয়াল রাতের ঘটনা।
৩ নভেম্বর রাত (সােমবার) ৩-১৭ মিনিটে প্যাটেল শুনতে পান পাগলাঘণ্টির আওয়াজ। কাঁসার ঘণ্টি গম্ভীর শব্দে ঢং ঢং করে বাজছিল। একই সাথে করুণ সুরে বিউগল ও ক্ষণে ক্ষণে হুইসেলের শব্দে নিশীথ রাতটা কেমন যেন আতঙ্কপূর্ণ হয়ে উঠছিল। সামাদ আজাদ সাহেব একজন পাহারারত সিপাইকে জিজ্ঞেস করলেন মিয়া সাব কী হয়েছে ? সিপাই জানাল যে সেও কিছু জানে না। তারপর ঝনঝন চাবির শব্দে ১নং রুমের দরজা খােলার শব্দ ওনারা পেলেন। প্রধান সুবেদার জব্বার খানের কাছে লক আপের চাবির গােছা। থাকত। এরপর ২নং রুমের লক আপ খােলার শব্দ পেলেন। প্রথম রুম থেকে ততক্ষণে কোরবান আলী, আব্দুস কুদুস মাখন এম.পি., দেলওয়ার হােসেনসহ মােট ৬ জনকে সবচাইতে বড় প্যাটেল সাহেবদের ৩নং রুমে ঢােকানাে হয়েছে। মনসুর আলী ওজু করে পাঞ্জাবি পরলেন। দাড়িওয়ালা এক পাহারাদার নায়েব আলী মনসুর আলীর কোমরে ধাক্কা দিয়ে তাগাদা দিল ১নং রুমে যেতে। মনসুর আলী চলে যাবার সময় প্যাটেল ওনাকে ভরসা। বললেন, ‘চাচা, আপনি যান। ওরা বােধহয় সিগনেচার নিতে এসে, ” আলী সাহেব তখন প্যাটেলের দিকে এমন এক করুণ দৃষ্টিতে তা বর্ণনার অতীত। উনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐটাই তার শেষ যাওয়া। পাক ভাষায় মনসুর আলীকে ১নং রুমে নেওয়ার ১/২ মিনিটের মধ্যেই চারটা স্টেনগানের ম্যাগাজিন ছুটল। ৫টা সিঙ্গেল রাউন্ড গুলির আওয়াজও পেলাম। পরে শুনেছি যে জেলখানার ঐ পাহারাদার নায়েব আলী দৌড়ে গিয়ে হত্যাকারী আর্মিদের বলেছে ‘একটা কিন্তু বাইচা আছে।’ মনসুর আলী নাকি তখনও বেঁচে ছিলেন ও পানি পানি বলে কাতরাচ্ছিলেন। আর্মিরা গাড়ির কাছ থেকে আবার ভেতরে এসে বেয়নেট চার্জ করে মনসুর আলীকে। চোখের পানি সামলাতে সামলাতেই সাক্ষাৎকার নিতে থাকি। ফোনের ওধার থেকে শুনতে পাই প্যাটেল সাহেবের বেদনাসিক্ত গলার স্মৃতিচারণ।
১৫ আগস্ট বিকেল ৫টার দিকে প্যাটেল সাহেব ফোন করলেন। জানালেন যে জেলহত্যাকাণ্ডের কিছুদিন আগে আব্বার সাথে বিশেষ কিছু কথােপকথন, যা ওনার স্পষ্ট মনে পড়ে, আমার সাথে শেয়ার করতে চান। আমি সেই মুহর্তে বাধাছাদায় ব্যস্ত। সুদীর্ঘ ২৭ বছর উত্তর আমেরিকার মেরিল্যান্ড স্টেটে প্রবাস জীবনযাপনের পর পাড়ি জমাচ্ছি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সামরিক বাহিনীবিহীন কোস্তারিকা রাষ্ট্রে। আমার স্বামী জীবনসাথি আমর খাইরি আবদাল্লা ভাইস রেক্টর ও প্রফেসার হিসেবে কর্মরত কোস্তারিকায় স্থাপিত জাতিসংঘ ম্যান্ডেটেড ইউনিভার্সিটি ফর পিসে। আমি মুভ করছি শুনে প্যাটেল সাহেব বললেন যে মুভ কার পর উনি আব্দুর সাথে কথােপকথনের বিষয়টি বলবেন। ততক্ষণে আমি বাধাহঁাদার কাজ ফেলে কাগজ-কলম হাতে নিয়ে বসেছি। অমূল্য স্মৃতিকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কাছে ফেলে না রাখাই শ্রেয়। আবার এক ঐতিহাসিক দিনে লিপিবদ্ধ করলাম কালের হিরণ্যগর্ভ হতে উত্তোলিত ইতিহাসকে। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস; কোস্তারিকায় মাতৃভাষা দিবস এবং ক্যাথলিক চার্চের মাতা মেরীর স্বর্গারােহণ দিবস; ম্রাট নেপােলিয়ন বােনাপার্ট ও কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের জন্মদিন ; বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিন ও জাতীয় শােকদিবস। ২৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২, আমার জন্মদিনে তরুণ রাজনৈতিক নেতা আ.স.ম আবদুর রব ওনার উপহার দেওয়া রবি ঠাকুরের গল্পগুচ্ছর পাতায় লিখেছিলেন, রিপি, আজ তােমার জন্মদিন। কারাে মৃত্যুদিন। বড় হয়ে মনে রেখাে।’ 

আব্বুর ইঙ্গিতবাহী স্বপ্ন

প্যাটেল সাহেবের ভাষায় নিম্নোক্ত বিবরণটি ধারণ করা হলাে :

১৯৭৫ সালের নভেম্বর মাসের ১ তারিখ । বিকেল বেলা । তাজউদ্দীন সাহেব ঢাকার সেন্ট্রাল জেলের নিউ জেল বিল্ডিং-র ১ নম্বর রুমের দরজার সামনে লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে দাঁড়ানাে। আমরা তখন বাইরে হাঁটছিলাম। ওনাকে দেখে আমরা সালাম দিয়ে দাঁড়ালাম। মনে হলাে যে উনি যেন কিছু বলতে চাচ্ছেন। তাই আমরা দাঁড়িয়ে রইলাম। আমার সাথে মাখন ভাই ও বােধহয় ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক হাসিমুদ্দীন পাহাড়ীও ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব কথা বলার সময় এক হাত মুখের কাছে এনে কথা বলতেন। ‘৭১-এ মুজিবনগরে যখন দেখা হয় তখনও ওনার এই অভ্যাসটি লক্ষ করেছিলাম। উনি এক হাতের আঙুল মুখের সামনে ধরে ও অন্য হাত পেটের ওপর নাভির কাছে রেখে আমাদের বললেন, আমার মনটা বেশ খারাপ। পরপর দুইবার বঙ্গবন্ধুকে স্বপ্নে দেখলাম। প্রথম স্বপ্নে দেখি বঙ্গবন্ধু আমাকে ডাকছেন। (আম্মার সাথে ঐ একই দিন, ১ নভেম্বর জেলে খুব অল্প সময়ের সাক্ষাৎকারে আব্বু প্রথম স্বপ্নটির উল্লেখ করেছিলেন।) আর গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম যে আমি ৩২নং রােডে ওনার বাড়িতে গিয়েছি। বঙ্গবন্ধু আমাকে হাত ধরে ওনার কালাে মার্সিডিজের মধ্যে বসিয়ে বললেন, চলাে টুঙ্গিপাড়ায় যাই। দ্বিতীয় স্বপ্নটি দেখে উনি খুব বিচলিত বােধ করেন। উনি বলেন, এই স্বপ্ন খুব একটা ভালাে ইঙ্গিত করে না। তাজউদ্দীন সাহেব খুব প্র্যাক্টিকাল মানুষ ছিলেন। স্বপ্ন বা অলৌকিক কাহিনি তিনি সহজে বিশ্বাস করতেন না। অথচ দেখলাম যে ঐ স্বপ্নগুলাে তিনি খুব সিরিয়াসলি নিয়েছেন। একটা কথা তিনি শুধু আমাকে বলেছিলেন। বােধহয় তখন অক্টোবরের শেষের দিক। আমরা সেলের চতুর্দিকে হাঁটার পাকা রাস্তায় হাঁটছিলাম। আমরা বন্দী অবস্থায় এক্সারসাইজ করতাম, আসন করতাম, ব্যাডমিন্টন খেলতাম ও হাঁটতাম। এভাবে সময় কাটাবার চেষ্টা করতাম। সেদিনও তাজউদ্দীন সাহেব ও আমি হাঁটছিলাম। উনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সেদিনও খুব আদর করে বললেন, কি খুব মন খারাপ ? আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু চলে গিয়েছেন। কিন্তু আপনারা লিডাররা তাে আছেন। আমাদের মনােবল এখনও রয়েছে। আমি ওনাকে কখনাে লিডার বা নেতা সম্বােধন করতাম। আব্দুস সামাদ আজাদকে সামাদ ভাই ডাকতাম। আমার উত্তরের পর উনি বললেন, আশা ক ডিসেম্বরের মধ্যে বের হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের একটা ভয়ংকর পরিস্থিতি পারে। আমাদের সাবধান থাকতে হবে। তাজউদ্দীন সাহেব চলে গেলেন, হলাে। কিন্তু ওনার সাথের অমূল্য স্মৃতি ও কথাগুলাে এখনাে মনে স্পষ্ট।

টেলিফোন সাক্ষাৎকার : ম্যারিল্যান্ড-ক্যালিফোর্নিয়া

২৩ জুলাই ও ১৫ আগস্ট, ২০১১ | প্রকাশিত, ঠিকানা : নিউইয়র্ক

৪ নভেম্বর, ২০১১

Ref: ৩ নভেম্বর-জেল হত্যার পূর্বাপর – শারমিন আহমদ, pp 36-40

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!