এবার জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এবং সেই সঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার পাকিস্তানি দোসর সামরিক চক্র এক নতুন চক্রান্ত করছে। বিশ্বের গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলাে যখন বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান- ঐ দেশের জনগণের ঘােষিত ইচ্ছানুযায়ী দাবি করছে তখন ইয়াহিয়া ও মার্কিন সরকার এই সমস্যাটি জিইয়ে রাখার কৌশল আবিষ্কার করার চেষ্টায় আছে।
দু’দিন আগে ইয়াহিয়া যখন ভারতের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছাড়ে সেই সময়ই প্রস্তাব দিয়েছিল যে, জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের পূর্ব-পাকিস্তানে আসার অনুমতিদানে তার আপত্তি নেই। বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে কোনাে সাহায্য করা ঐ দলের কাজ নয়— দলটি পূর্ব-পাকিস্তানের পরিস্থিতি সরজমিনে দেখে ভারতে আগত শরণার্থীদের বােঝাবেন যে, তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনে কোনাে আশঙ্কা নেই, অর্থাৎ ইয়াহিয়ার বকলমে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল শরণার্থীদের মধ্যে প্রচার করবে। আর এ কথা ইয়াহিয়ার ভালাে করেই জানা আছে যে, শুধু প্রচার করলেই শরণার্থীরা ফিরবে না; তখন শরণার্থীদের সম্পর্কে ইয়াহিয়া সব দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলবে আর ভারত সরকারকে এই বিপুল বােঝা দিয়ে চূড়ান্ত নাজেহাল করা যাবে।
এ পরিকল্পনা কেবল ইয়াহিয়ার নয়। মার্কিন সরকারও বাংলাদেশ সমস্যার মাঝে জাতিসংঘের কীলকটা ঢুকিয়ে দেয়ার চক্রান্ত করছে। বিশেষ করে নিক্সনের চীন সফর চূড়ান্তভাবে স্থির হওয়ার পর এই দিকে তৎপরতা বহুগুণ বেড়েছে। মার্কিন সরকারের পরিকল্পনা হলাে, পূর্ব-পাকিস্তান এবং ভারত সীমান্ত— দুই অংশেই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদল মােতায়েন করা। এদের কাজ হবে দৃশ্যত শরণার্থীদের পূর্ব-পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার জন্য আশ্বস্ত করা কিন্তু প্রকৃত কাজ হবে ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ ঠেকিয়ে রাখা। এই পরিকল্পনার মধ্যে কোথাও বাংলাদেশের জনতার দাবি, মুক্তিযুদ্ধ এবং রাজনৈতিক সমাধানের বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত নেই। ইয়াহিয়া যে শর্তে জাতিসংঘকে ব্যবহার করতে চায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও অনুরূপ উদ্দেশেই জাতিসংঘকে ব্যবহার করতে চায়। তবে ইয়াহিয়ার স্বার্থ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উপর অব্যাহত সামরিক একনায়কত্ব বজায় রাখা আর মার্কিন সাম্রাজ্যব হলাে ইয়াহিয়া সমেত পাক-ভারত উপমহাদেশে আগ্রাসী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা।
এ পর্যন্ত পৃথিবীর যে কয়টি ক্ষেত্রে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বসানাে হয়েছে তার একটি ক্ষেত্রেও কোনাে সমস্যার সমাধান হয়নি। বাংলাদেশে সেই জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকদলকে স্থান দেয়ার অর্থ হবে অনির্দিষ্টকালের জন্য সমস্যাকে ঝুলিয়ে রাখা। কারণ এই দলের প্রধান কাজ হবে সংঘর্ষ ঠেকানাে। প্রকাশ্য সেই ঘােষণা পাক-ভারত সংঘর্ষ ঠেকানাে হলেও অঘােষিত কর্তব্য হবে মুক্তিযুদ্ধে বাধা সৃষ্টি করা। মার্কিন সমরাস্ত্রে সজ্জিত এবং চীনের আশীর্বাদপুষ্ট হয়েও ইয়াহিয়া ভারত-পাক সীমান্তকে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে দুর্ভেদ্য করে। তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলকে ঘাঁটি করে মুক্তিযোেদ্ধারা যে প্রচণ্ড আঘাত হানছে এবং দিনের পর দিন তা যেভাবে শক্তি সঞ্চয় করছে তাতে ভৃত্য ইয়াহিয়া এবং প্রভু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ উভয়েই বেশ চিন্তিত। তাই এখন জাতিসংঘের ঢাল ব্যবহার করার জন্য ইসলামাবাদ আর ওয়াশিংটনের এত ব্যস্ততা।
তাছাড়া নিক্সন সরকার সােভিয়েত ইউনিয়নের অপ্রতিহত প্রভাবকে ঠেকা দেয়ার জন্য চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করার জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছে। এ সময় ভারত সমেত বাংলাদেশ- এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিস্তৃতি তার পক্ষে অসহ্য। চীনের সঙ্গে তার এই মিতালিতে যেমন চাই অখণ্ড পাকিস্তান তেমনি চাই এক দুর্বল ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মুখাপেক্ষী ভারত। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম যদি জয়লাভ করে তবে ভারতের সাম্রাজ্যবাদবিরােধী গণতান্ত্রিক শক্তিরাই শক্তিশালী হবে। ভারতেরও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নির্ভরতা দ্রুত অবলুপ্ত। বাংলাদেশের সমস্যার কোনাে রাজনৈতিক সাহায্য নিয়ে ঐ সমস্যাকে জিইয়ে রাখা ভারতের কাঁধে চাপিয়ে রেখে ভারত ধীরে ধীরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উপর সাম্প্রদায়িকতার বিশেষ ভারতের গণতন্ত্র করতে চায়। মার্কিন সরকারের পালন করেছে এবারেও যে করবে স্বয়ং।
এ দেশের মার্কিন সাম্রাজ্যবাদে তারা বিপন্ন প্রভুকে রক্ষার জন্য কথায় কথায় কুৎসা প্রচারকেই অন্য সােভিয়েত মার্কিন বসিয়ে এরা জনতার আক্রমণ চায়। এরাও বাংলাদেশের মুক্তি চায় এবং সেই সঙ্গে ভারতের গণতন্ত্রকে।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল না, এদের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। তাদের স্বদেশে সংঘর্ষ ঠেকানাে নয়, মুক্তিযােদ্ধাদের ভারত উপমহাদেশে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত ভারত বিচার করবে প্রত্যেকটি এই নতুন ষড়যন্ত্রকে ভারতের জনসাধারণ…।
সূত্র: কালান্তর
২২.৭.১৯৭১