মুজিবরের মুক্তি চাই
সামরিক বলের উপর একান্তভাবে নির্ভরশীল যারা, তারা তাদের জঙ্গি জেহাদে যতই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে থাকে ততই প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে ওঠে। রাতারাতি বাংলাদেশ জয়ের আশা তিরােহিত দেখে ইয়াহিয়া খানের এখন প্রতিহিংসার প্রবৃত্তি প্রবল হয়ে উঠেছে। তাই তিনি বিচারের প্রহসন করে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানকে দণ্ড দিতে উদ্যত। এমন কথাও তার মুখ থেকে বেরিয়েছে যে, বিচারে মুজিবের প্রাণদণ্ডও হতে পারে। লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত পান করেও তার রক্তের পিপাসা মেটেনি। বাংলাদেশের সর্বজনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের শােণিতপানের জন্য এখন ঘাতক ইয়াহিয়া খানের উগ্র লালসা হয়েছে।
জল্লাদের হাত থেকে মুজিবরের জীবন রক্ষার দায়িত্ব আজ শুধু বাংলাদেশের জনসাধারণেরই নয়বিশ্বের প্রতিটি গণতান্ত্রিক মানুষের সামনেই আজ সে দায়িত্ব উপস্থিত। জননায়ককে হত্যা করে যে জনশক্তিকে নিঃশেষ করা যায় না, বলদর্পী জঙ্গি নায়কদের সে জ্ঞান থাকে না। প্রতিহিংসায় উন্মত্ত হয়ে তারা এভাবে একেকটা মূল্যবান জীবনকে ধরাপৃষ্ঠ থেকে সরিয়ে দেয়। সাম্প্রতিক ইতিহাসেও তার বহু নজির আছে। এই সেদিন সুদানে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও জনপ্রিয় সুদানী নেতা আবদুল খালেদ মাহজুবকে হত্যা করে ঘাতক নুমেরী তার প্রতিহিংসাবৃত্তি চরিতার্থ করেছেন। মুজিবর রহমানকে প্রাণদণ্ড দিয়ে ইয়াহিয়া খান সেই নাটকেই আর একটি অঙ্ক যােগ করতে চান।
তার এই প্রতিহিংসাপরায়ণতার বিরুদ্ধে ও মুজিবরের মুক্তির দাবিতে নানাদিকে জনকণ্ঠ সােচ্চার হয়ে উঠেছে। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবি করে বাংলাদেশের জনগণ ও বিশ্বের প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে আবেদন করেছেন যাতে এই বিচার প্রহসন বন্ধ ও বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য সবাই সমস্বরে দাবি তােলেন।
ভারতের প্রতি প্রান্তে যে এ দাবি উত্থিত হবে, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ইতােমধ্যেই সংসদের প্রায় পাঁচশ’ সদস্য মুজিবরের মুক্তির দাবিতে এক স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছেন। সেটি প্রেরিত হবে জাতিসংঘের সচিব প্রধান উ থান্টের কাছে। একমাত্র মুসলিম লীগ ছাড়া সংসদের আর সব দলের সদস্যরা তাতে স্বাক্ষর করেছেন। স্মারকলিপিতে পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের উল্লেখ থাকায় মুসলিম লীগের নাকি আপত্তি। সেই অংশ বাদ দিলে শুধু মুজিবরের মুক্তির দাবিতে স্বাক্ষর করতে তাদের আপত্তি ছিল না।
মুসলিম লীগের এবম্বিধ আচরণে আমরা বিস্মিত। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যাকাণ্ড ও অকথ্য অত্যাচার তাে আর কল্পিত কাহিনী নয়, যে তা জলে ধুয়ে শ্লেট থেকে মুছে ফেলা যাবে। সেই বীভৎসতার প্রত্যক্ষদর্শী বহু বিদেশিও আছেন আর ভারতের বুকে সত্তর লক্ষাধিক শরণার্থীই তার অকাট্য প্রমাণ। এই সত্য ঘটনার উল্লেখ থাকায় মুসলিম লীগের আপত্তি কেন? তবে কি তারা বলতে চান, বাংলাদেশে পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনীর নৃশংসতা অলীক কাহিনী? ভারতের মুসলিম সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন মুসলিম লীগ। বাংলাদেশে নৃশংসতার বলি কি মুসলিম সম্প্রদায় হয়নি, আর আজ যে সেখানে মুক্তিযুদ্ধ চলেছে তার মুখ্য ভূমিকায়ও কি মুসলিম সমাজ নেই? এ অবস্থায় ভারতের মুসলিম লীগ মুজিবরের মুক্তির প্রশ্নে শর্তারােপ করে যেভাবে স্মারকপত্রে স্বাক্ষরদান থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তাতে ভারতের মুসলিম সমাজের মনােভাব সম্বন্ধে সন্দেহ সৃষ্টির সুযােগই করে দিয়েছেন তাঁরা। আমরা জানি, এটা ভারতের গােটা মুসলিম সমাজের মনােভাব নয়। তারা যেমন শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির সপক্ষে তেমনই বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংসতারও বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নৈতিক সমর্থন জানাতে যদি মুসলিম লীগের দ্বিধা থাকে, তবে কি আমরা ধরে নেব তারা পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর পক্ষে? এখানে কোনাে মধ্যপন্থার স্থান নেই। মুসলিম লীগকে এ বিষয়ে মনস্থির করতে হবে।
শুধু সংসদ সদস্যদের স্মারকলিপি প্রেরণই যথেষ্ট নয়। তারা তাদের কর্তব্য পালন করছেন। মুজিবরের মুক্তির জন্য ভারতব্যাপী গণদাবি তুলতে হবে আর সে জন্য চাই সমস্ত রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক সংস্থা এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ও মানবতাবাদী প্রতিটি মানুষের মিলিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন। পশ্চিমবঙ্গের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীরা এই দাবি নিয়ে ময়দানে নেমেছেন। বিভিন্ন সংস্থা মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবিতে মুখর হয়ে উঠবেন বলেই আমরা আশা করি। আর ভারত সরকারকে আমরা সতর্ক করে দিতে চাই, তারা যেন এ বিষয়ে নিশ্চেষ্ট না থাকেন। দূতস্থানগুলাের মারফত তারা মুজিবের মুক্তির জন্য বিদেশী রাষ্ট্রগুলােকে পাক জঙ্গিচক্রের উপর চাপ দিতে বলুন এবং স্পষ্টত জানিয়ে দিন, বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের জীবননাশ হলে তার পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর।
সূত্র: কালান্তর
৮.৮.১৯৭১