You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.01 | আর একটি মারাত্মক প্ররােচনা | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

আর একটি মারাত্মক প্ররােচনা

পাকিস্তানের জঙ্গিশাহী ভারতের সঙ্গে পায়ে পা বাধিয়ে রক্তাক্ত সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার নেশায় মরিয়া হয়ে উঠছে। ভারতের তিন সীমান্তে পূর্বে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা ও মেঘালয় অঞ্চলে, পশ্চিমে পাঞ্জাব ও রাজস্থানে এবং জম্মুকাশ্মীরের অস্ত্রবিরতি সীমারেখা বরাবর বিপুল সৈন্য সমাবেশ করে দিনের পর দিন প্ররােচনা দিয়ে চলেছে। অক্টোবর মাসের পয়লা থেকে উনত্রিশ তারিখ পর্যন্ত পাক-প্ররােচনার যে দিনপঞ্জী ভারত সরকারের বৈদেশিক ও দেশরক্ষা দপ্তরের যুক্ত বিবৃতিতে প্রচার করা হয়েছে তা পাক-জঙ্গিশাহীর অভিসন্ধি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে পাক সৈন্যরা ভারতীয় এলাকা দখলেরও চেষ্টা করে কিন্তু ভারতীয় জওয়ানদের বাধার ফলে তা ব্যর্থ হয়। পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় এলাকায় পাক সৈন্যদের কামানের গােলা নিক্ষেপের ঘটনা তাে প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক। পশ্চিমে পয়লা থেকে ছাব্বিশে অক্টোবরের মধ্যে কমপক্ষে একশ আটত্রিশ বা অস্ত্র বিরতি সীমারেখা লঙ্নের ঘটনার উল্লেখ সরকারি দপ্তরেরও বিবৃতিতে আছে। অর্থাৎ ভারত-পাকিস্তানের সুদীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে পাক-জঙ্গি চক্র যুদ্ধের আগুন জ্বালানাের সমস্ত ব্যবস্থা প্রায় পাকাপাকি করে ফেলেছে।
এই প্ররােচনার মারাত্মক এবং আপাত শেষ নজির হলাে সােভিয়েত বিমান বাহিনীর অধিনায়ক কুটকিভের বিমানটিকে পাকিস্তানের উপর দিয়ে ভারতে আসতে না দেয়া। ভারত পাকিস্তানের শত্রু, অতএব ভারতের বন্ধু পাকিস্তানের শত্রু, জঙ্গিশাহী এই মুখের তত্ত্বে নির্ভর করে সােভিয়েত বিমান বাহিনীর প্রধানের প্রতি কেবল অসৌজন্য প্রকাশ করেনি, আন্তর্জাতিক রীতি নীতিও লঙ্ঘন করেছে।
সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের বন্ধু। সম্প্রতি স্বাক্ষরিত ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি বন্ধুত্বের এই বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু এর অর্থ সােভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের শত্রু নয়। বস্তুত সােভিয়েত বা পাকিস্তান কেউই এ কথা ঘােষণা করে নি। তবে সােভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপতি বিশ্বের রাষ্ট্র প্রধানদের মধ্যে সর্বপ্রথম পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যার নিন্দা করেছেন। তিনি ঐ গণহত্যা বন্ধ করার এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পরামর্শ করে রাজনৈতিক সমাধানে পৌছানাের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। এর কোনটিই ইয়াহিয়া বা তার রক্ত লােলুপ সঙ্গীদের পছন্দ নয়। তাই ঐ উন্মাদের দল স্বৈরাচারের দম্ভে অন্ধ হয়ে আজ সমগ্র পাকিস্তানের জনজীবনকে বাজি ধরেছে। ভারত সীমান্ত ঝােপে যুদ্ধ সজ্জা আর সােভিয়েত বিমান বহরের অধিনায়কের প্রতি অসৌজন্য প্রকাশ তারই সুচিন্তিত ধাপ মাত্র।
এয়ার মার্শাল কুটকিভ ভারতে পৌঁছেছেন, পাক জঙ্গিশাহীর অবিমূল্যকারিতা তার সফরসূচি কয়েক ঘণ্টা বিলম্বিত করেছে মাত্র। এই প্ররােচনা যে ভারতকে আরও প্রতিজ্ঞ-কঠোর করে তুলবে, ভারতের সামরিক প্রয়ােজনের চাহিদা পূরণের জন্য বন্ধু সােভিয়েত ইউনিয়নকে আরও বেশি তৎপর করে তুলবে আর আন্তর্জাতিক কূটনীতির জগতে পাকিস্তানের এই যুদ্ধোন্মাদদের বিচ্ছিন্নতাকে বাড়িয়ে তুলবে এ কথা উপলব্ধি করার বােধশক্তিও আজ পাক জঙ্গি চক্র হারিয়ে ফেলেছে। দীর্ঘ আট মাস ধরে বাংলাদেশের নিরস্ত্র নর-নারী, শিশুর রক্তে স্নান করে পাক জঙ্গিশাহী ভারতের মাটিতে রক্ত হােলি খেলার স্বপ্ন দেখছে। সেই স্বপ্নই তাকে এই স্পর্ধা জুগিয়েছে রেতখানি দুঃসাহসী করে তুলেছে। তার এই স্বপ্নে সুড়সুড়ি দেয়ার জন্য হয়তাে বিশ্বের কোনাে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্র এমনকি কোনাে অন্ধ সংকীর্ণতাবাদী রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থন থাকতে পারে। কিন্তু পাকিস্তানের অতীতেরই অঙ্গরাজ্য বর্তমানের বাংলাদেশের সাত কোটি আর ভারতের পঞ্চান্ন কোটি জনতার সঙ্গে ভারত সােভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক শক্তি এবং বিশ্বের সমগ্র গণতন্ত্র প্রিয় ও স্বাধীনতা প্রেমী জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধ সেই স্বপ্নকে ধুলিসাৎ করবেই। তবে স্বপ্ন যাদের মাথায় চড়ে নিজের খুন না দেখা পর্যন্ত তাদের নিরস্ত্র করা যায় না। পাকজঙ্গিশাহীর সর্বশেষ মারাত্মক প্ররােচনা সেই পরিণতিকেই অনিবার্য করে তুলছে।

সূত্র: কালান্তর
১.১১.১৯৭১