You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.25 | যুদ্ধের বিপদ | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

যুদ্ধের বিপদ

বিদেশ যাত্রার প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দেশের জনগণকে যে কোনাে পরিস্থিতির মােকাবেলা করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। দেশ ও জাতির সামনে সমূহ বিপদ উপস্থিত হলে এ রকম আহ্বান আসাই স্বাভাবিক। নাম উল্লেখ না করলেও এ বিপদ এসেছে পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকচক্র থেকে।
পাক জঙ্গি শাসকচক্রের নায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধের হুমকি দিয়ে চলেছেন। ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে রীতিমতাে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছেন। পাক-ভারত সীমান্তে নির্মম অত্যাচার চালিয়ে জরুরি অঞ্চলগুলােকে জনশূন্য করা হচ্ছে যাতে সৈন্য চলাচল, বাঙ্কার তৈরির কাজ নির্বিঘ্নে চলতে পারে। প্রতিনিয়তই সীমান্তে গােলাগুলি বর্ষণ করে এ পারের জনসাধারণকে হত্যা করা হচ্ছে। আর অন্যদিকে বেতার ভাষণে ইয়াহিয়ার অর্ধেক সময় ব্যয়িত হচ্ছে ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারে। করাচির পত্র-পত্রিকায় ভারত কর্তৃক পাকিস্তানকে আক্রমণের সম্ভাবনা সম্পর্কে মিথ্যা হুঁশিয়ারি দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জনতাকে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস চলেছে। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টি করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনতাকে বােঝানাে হচ্ছে যে, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের চক্রান্তেরই ফল। অতএব পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য ভারতের আক্রমণের মােকাবেলা করতেই হবে। ভারত বিদ্বেষী প্রচারে পাকিস্তানের মানুষকে উত্তেজিত করা এবং কার্যক্ষেত্রে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে পাক-ভারত উপমহাদেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে পাক শাসকচক্রই। সেই উত্তাপ যে কোনাে মুহূর্তেই যুদ্ধের বহ্নিতে পরিণত হতে পারে। পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে সংকীর্ণ ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্কিন প্রদত্ত সমরসম্ভার। উভয়ের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যেমন ভারতের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে বিপদ সৃষ্টি করেছে, ঠিক তেমনই বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে তীব্রভাবে আক্রমণ করছে। বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার’-এই তত্ত্ব সংকীর্ণ ও জঙ্গি জাতীয়তাবাদেরই অঙ্গীভূত। এই তত্ত্বের সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য যে যুদ্ধ- এ কথা আজ দিবালােকের মতাে পরিষ্কার। আমরা আজ সেই যুদ্ধের বিপদের সম্মুখীন।
পাক-ভারত উপমহাদেশে আমরা যে যুদ্ধের বিপদের সম্মুখীন হয়েছি তা দুই দেশের মধ্যে একটা নিছক ঘটনা মাত্র নয়। এই যুদ্ধ বিশ্বশান্তি ও স্থায়িত্ব বিপন্ন করতে পারে, কারণ এই যুদ্ধের উস্কানি এবং জঙ্গিশাহীকে সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত করা হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বরণকৌশলের অঙ্গ- বিশেষত এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় মার্কিন রণকৌশলেই অঙ্গীভূত। অতএব যুদ্ধের বিপদ বিগত পাক-ভারত যুদ্ধ অপেক্ষা ভিন্ন প্রকৃতির। অতএব আমরা কেবল যুদ্ধের বিপদের সম্মুখীন নই, সাম্রাজবাদের চক্রান্তেরও সম্মুখীন।
প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণকে যে কোনাে পরিস্থিতি মােকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে যারা অর্থনীতিকে তছনছ করে দিচ্ছে তারা বিপদকালে কী করবে? প্রধানমন্ত্রীর বিপদের সময় মুনাফার জন্য পণ্যের দর বৃদ্ধি না করার জন্য ব্যবসায়ীদের প্রতি আবেদন করেছেন। যারা মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করে তাদের কাছে দেশ অপেক্ষা মুনাফা বড়। বরং এরাই বিপদের সুযােগ নিয়ে মাল মজুদ করে চোরাকারবারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করেছে। সেই কালাে টাকার দাপটের কাছেই অর্থমন্ত্রী নতজানু। দেশ-বিদেশি একচেটিয়া পুঁজিপতিরা যে কোনাে মুহূর্তে উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। মার্কিন ও বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী যখন পাক শাসক চক্রের সমর্থনে দাঁড়িয়েছে তখন সেই সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি আমাদের বিপদকালে অন্তর্ঘাতমূলক কাজে লিপ্ত হবে না তার কি গ্যারান্টি আছে? শিল্প ও দেশের স্বার্থে কয়লাখনি পরিচালনা জাতীয়করণ করার পরে দেখা গেল যে, মালিকরা সমস্ত যন্ত্রপাতি লােপাট করে পােড়ামটির নীতি অনুসরণ করেছে। পণ্যমূল্যবৃদ্ধির দাপটে পুঁজিপতিরা সাধারণ মানুষের জীবনে চূড়ান্ত বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। প্রধানমন্ত্রীর আবেদনে এরা যে সাড়া দেবে এ কথা মনে করার কোনাে কারণ নেই। চোরে না শােনে ধর্মের কাহিনী।
এসব দেশি-বিদেশি একচেটিয়া ও কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে যুদ্ধের বিপদকে মােকাবিলা করার আহ্বানের কী অর্থ আছে? দেশের মানুষরা দেশপ্রেমের দ্বারা উদ্দীপিত হয়ে বিদেশি আক্রমণের মােকাবিলা করবে। কিন্তু যুদ্ধের বিপদের সুযােগে যারা শ্রমিক ও কৃষকের উপর নির্যাতন চালাবে, যারা অন্তর্ঘাতমূলক পথ অনুসরণ বা পােড়ামাটি নীতি অনুসরণ করবে, তাদের মােকাবিলা করার কাজ জনসাধারণ পরিত্যাগ করতে পারে না। দেশের সংহতি, স্বার্থ এবং প্রতিরক্ষার জন্য এ কাজ অপরিহার্য। এই সংগ্রামকে বাদ দিলে দেশের প্রতিরক্ষা দুর্বল থাকতে বাধ্য। আমরা চাই সরকার এই বিষয়ে তাদের কর্তব্য পালনে তৎপর হােন।

সূত্র: কালান্তর
২৫.১০.১৯৭১