জরুরি অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে
উপরাজ্যপালের বেতার ভাষণ
গত ৬ ডিসেম্বর প্রাতে আকাশবাণী আগরতলা কেন্দ্র মারফতে ত্রিপুরার উপরাজ্যপাল শ্ৰী বালেশ্বর প্রসাদ ত্রিপুরাবাসীর অবগতির নিমিত্ত জরুরি অবস্থার উপর বেতার ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণে প্রথমেই বলা হয়, পাকিস্ত নি আমাদের উপর যুদ্ধ চাপাইয়া দিয়াছে। অতএব গত ৩ ডিসেম্বর ভারতের রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘােষণা করিয়াছেন। বর্তমান বাংলাদেশ ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনান্তর প্রায় এক কোটি শরণার্থীর ভারতে আশ্রয় গ্রহণকে শ্রী প্রসাদ পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণ বলিয়া অভিহিত করিয়া বলেন যে, এই ধরনের চাপ সৃষ্টির (পরােক্ষ আক্রমণের) নজির পৃথিবীর ইতিহাসে খুঁজিয়া পাওয়া যায়। না। শরণার্থীদের চাপে ভারত যে তীব্র ও দুর্বিসহ অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছে, উহা বিশ্ববাসীকে বুঝাইবার জন্য এবং সসম্মানে শরণার্থীদের দেশে ফিরিবার এবং নিরাপদে স্বদেশে বসবাস করিবার মতাে পরিবেশ সৃষ্টি করিয়া ভারতকে চাপমুক্ত করিবার জন্য বিশ্বের দেশগুলাের নিকট অনুরােধ করা হইয়াছে। উহার জবাবে পাকিস্তান সমগ্র ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে, যুদ্ধের হুমকি দেয় এবং আগ্রাসী ক্রিয়াকলাপ শুরু করে। গত ৩ ডিসেম্বর তাহারা যুদ্ধ ঘােষণা করে। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী বলিয়াছেন, পাকিস্তানের এই যুদ্ধ ঘােষণা ও আক্রমণ কেবলমাত্র আমাদের আঞ্চলিক অখণ্ডতার বিরুদ্ধেই নহে, এই আক্রমণ আমাদের আদর্শ ও জীবনযাত্রার বিরুদ্ধেও ঘটে।
শ্রী প্রসাদ বিশ্বের গণতন্ত্র বিলাসী তথাকথিত মানবতাবােধে বিশ্বাসী রাষ্ট্রসমূহের নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তাকে কটাক্ষ করিয়া বলেন, অত্যাচার-অবিচার ও শােষণ হইতে মুক্তির জন্য মানুষের সংকল্পকে অবদমিত করিয়া রাখা যায় না। আমরা এই বিষয়ে সুনিশ্চিত যে, জঙ্গিশাহীর বর্বরতায় যাহারা ভারতে আশ্রয় নিয়াছেন তাহারা অচিরেই দেশে ফিরিয়া যাইবেন এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে স্বাধীন জীবন-যাপন করিবেন।
পাকিস্তানের এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সর্বপ্রকারে প্রস্তুত থাকিবার জন্য শ্রী প্রসাদ তাঁহার ভাষণে সবিশেষ গুরুত্ব প্রদান করিয়া বলেন, কৃষি-শিল্প উৎপাদন ক্ষেত্রে এবং জিনিসপত্রের যােগান যাহাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সকলের সতর্ক ও তীক্ষ দৃষ্টি দিতে হইবে। আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সহায়তার জন্য একটি পরিষদ গঠিত হইয়াছে। সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তা দান এবং জনগণকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় প্রেরণা যােগানােই এই পরিষদের কাজ। তিনি আরও বলেন, পাক বাহিনী আগরতলা শহরের উপর আক্রমণ চালাইবার পরিকল্পনা করিয়াছিল; আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী তাহাদের অস্ত্রশস্ত্র দখল ক্রমে তাহাদিগকে বিতাড়িত করিয়া আমাদের উপর আক্রমণের ভয় দূর করিয়াছে। এ জন্য আমি আপনাদের সকলের সাথে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। এই কয়দিন পাক আক্রমণের মােকাবিলায় আগরতলাবাসীর শৃঙ্খলা রক্ষা ও ধৈর্যের উল্লেখ করিয়া তিনি ধন্যবাদ জানান। তারপরই বলেন যে, যদিও আগরতলা পাক গােলাবর্ষণ এবং সরাসরি আক্রমণ হইতে নিরাপদ হইয়াছে, তবু অন্যান্য সীমান্ত অঞ্চলে হুমকির মােকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকিতে হইবে। বিমান আক্রমণের সম্ভাবনা এখনও কাটে নাই। অতএব নিপ্রদীপ ব্যবস্থা চালু থাকিবে।
ভারত প্রতিরক্ষা আইন জারি সম্পর্কে শ্রী প্রসাদ বলিয়াছেন, পাক আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য প্রয়ােজনীয় সকল ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হইয়াছে। এই আইন দ্বারা সমাজ বিরােধী, দেশদ্রোহী, অবাঞ্ছিত কাজে লিপ্ত সুযােগ সন্ধানীদের শায়েস্তা করা হইবে। মুনাফাবাজী, মজুদদারি ও ভেজাল মেশানাে প্রতিহত করিবার জন্য ইতিমধ্যেই ফৌজদারি আইন অনুযায়ী কিছু কিছু ব্যবস্থা নেওয়া হইয়াছে এবং ভবিষ্যতেও নেওয়া হইবে। খাদ্য শস্য, লবণ, চিনি, তেল, ডাল প্রভৃতি দ্রব্য আনা হইতেছে, চিন্তার কোনাে কারণ নাই।
ত্রিপুরার জনগণ সর্বদাই অটুট মনােভাবের পরিচয় দিয়েছেন এবং আমি নিশ্চিত যে, যে কোনাে পরিস্থিতির মােকাবেলায় তারা তাই করবেন। আমি এ বিষয়েও নিঃসন্দেহ যে, তারা যে কোনাে চ্যালেঞ্জ বা অসুবিধার সম্মুখীন হতে নিজেদেরকে সব সময় প্রস্তুত রাখবেন। দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা এবং আমাদের আদর্শ ও জীবন দর্শন রক্ষার জন্য ত্রিপুরাবাসীরা পক্ষে কোনাে রকম ত্যাগ স্বীকারই অস্বাভাবিক কিছু নয়।
সূত্র: ত্রিপুরা
৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
২১ আশ্বিন, ১৩৭৮