You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশ ও সােভিয়েত ইউনিয়ন

সমস্ত জল্পনা-কল্পনা ও কুৎসার অবসান ঘটিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মি. নিকোলাই পদগাের্নি পাক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর কাছে পূর্ববাংলায় রক্তপাত বন্ধ করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানিয়েছেন। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী মি. কোসিগিন বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। বাংলার মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে সােভিয়েত যে চুপ করে থাকতে পারে না- এ কথা জেনেও বুর্জোয়ারা ও উগ্র বিপ্লববাদীরা সুযোেগ মতাে সােভিয়েতের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার করতে দ্বিধা বােধ করেনি। বিশ্বে এমন কোনাে দেশ নেই যেখানকার জনগণের স্বাধীকারের সংগ্রামকে সােভিয়েত সমর্থন করেনি। তা সত্ত্বেও সােভিয়েত বিরােধীদের কুৎসার বিরতি নেই।
বাংলার জনগণের স্বাধীকারের সংগ্রাম অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও নানা কারণে তা আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন হয়ে উঠেছে। বর্তমান যুগের ইতিহাস বার বার প্রমাণ করেছে, কোনাে দেশের মুক্তি সংগ্রাম বা স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের গুরুত্ব ও তাৎপর্য জাতীয় সীমানার মধ্যে আবদ্ধ থাকতে পারে না। এটা কেবল মানবিকতার প্রশ্ন নয়। বাংলার মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও প্রকৃতি সাম্রাজ্যবাদ ও সামরিক শাসনের অবাস্তব বাধা ও বন্ধনকে চুরমার করে দিচ্ছে বলেই ন্যায় যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। বাংলার জনগণের এই ন্যায়যুদ্ধ যে সাম্রাজ্যবাদ ও যুদ্ধ জোটকে সক্রিয় করে তুলবে এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে সিয়াটো ও সেনটো জোট তাদের অনুগত সদস্য পাকিস্তানের নিরাপত্তার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। নিজেদের স্বার্থেই এ দুটি জোট চায় পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তানের মুঠোয় রাখতে। এরা চায় বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করতে। সিয়াটো ও সেন্টোকে কাজে লাগিয়ে রাওয়ালপিণ্ডি বাংলায় সৈন্য পাঠাবার ব্যাপারে ভারত মহাসাগরে ব্রিটিশ অধিকৃত দ্বীপটিকে ব্যবহার করছে। সেন্টোর অপর সদস্য তুরস্ক ও ইরানের সেনাবাহিনীর প্রধানরা রাওয়ালপিন্ডিতে হাজির হয়েছেন। পাক-মার্কিন চুক্তি, সিয়াটো ও সেন্টো জোট যে ভারতসহ সমগ্র দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার শান্তি বিঘ্নকারী চুক্তি কেবল নয়, কেবল সামরিক চক্রান্তের ঘটি নয়, এক একটা দেশে বিপ্লব দমনেরও হাতিয়ার। এই সত্য আজ দিবালােকের মতাে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। একদিকে যেমন সিয়াটো ও সেন্টো জোট বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে দমনের জন্য ইয়াহিয়া খাঁর প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে, তেমনই মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র বলেছেন যে, পাকিস্তান সরকারকে যেসব মার্কিন সমরসম্ভার দেয়া হয়েছে পূর্ববঙ্গের বিপ্লব দমনের তা ব্যবহার করার জন্য অনুমতির প্রয়ােজন নেই।
রি মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষকে ঢালাওভাবে হত্যা করার এমন অনুমতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা ছাড়া আর কে দিতে পারে। ভিয়েতনামে মার্কিন সৈন্যরা যেমন নির্বিচারে হত্যা করছে, ঠিক তেমনই মার্কিন সাহায্য লাভ তাবেদার পাকিস্তানের সামরিক শাসনকর্তা ও বাংলার মানুষকে অনুরূপভাবে হত্যা করছে। আপাত দৃষ্টিতে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হলেও, বাংলার মুক্তিযুদ্ধ আসলে সাম্রাজ্যবাদ, সামরিক জোটের চক্রান্তের বিরুদ্ধে। এদেরই সাহায্যপুষ্ট হয়ে পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তারা বাংলার মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে এবং আধুনিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করছে।
এ বিরাট ষড়যন্ত্র ও আক্রমণের বিরুদ্ধে সাত কোটি মানুষের বাংলা স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। এই যুদ্ধ যে ন্যায়যুদ্ধ এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। বাংলার মানুষের স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার লড়াই যে ন্যায়সঙ্গত তাতে বিতর্কের কোনাে অবকাশ নেই। এই কারণে ভারত সরকার ও সদ্য নির্বাচিত লােকসভা বাংলার মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করেছে। বিশ্ব বিপ্লবের কেন্দ্র সােভিয়েত থেকেও সেই সমর্থন এসেছে। সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার লড়াইয়ের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ নতুন আলােকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে।

সূত্র: কালান্তর
৫.৪.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!