অজেয় পূর্ববঙ্গ
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যা সংবিধান রচনার অপেক্ষায় না থেকে আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পরিচালিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর দ্বারা কার্যত ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনকে অস্বীকার করা হয়েছে। প্রায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জীবন-মরণের দায়িত্ব নিয়েছেন আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবর রহমান। ছ’দফা দাবির প্রথমটিই ছিল পূর্ববঙ্গের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। একমাত্র প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক ও মুদ্রা দফতর থাকবে কেন্দ্রের হাতে। আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ছ’দফার প্রথম দাবিটিকেই কাজে পরিণত করার জন্য পূর্ববঙ্গের বেসামরিক শাসনকাজ পরিচালনার দায়িত্বভার নিয়েছে।
বলা বাহুল্য, একটিও অস্ত্র প্রয়ােগ না করে সামরিক দাপটকে ভ্রুক্ষেপ না করে, এরূপ একটি গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে অকম্পিত পদক্ষেপ ইতিহাসে বিরল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব মাথা ঠাণ্ডা রেখে এবং কোনােরূপ প্ররােচনার শিকার না হয়ে এই গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে যেভাবে চরম লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাতে করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার জন্য তারা সারা দুনিয়ার গণতান্ত্রিক সমাজের কাছেই অকুণ্ঠ প্রশংসার অধিকারী হয়ে উঠছেন। পূর্ববঙ্গের কোনাে কোনাে অতি বামপন্থী মহল পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে ঘােষণা করার জন্য শেখ মুজিবর রহমানের উপর চাপ দিচ্ছে। কিন্তু সেই ফাঁদে পা দিয়ে তিনি বাঙালি জাতির উপর বেপরােয়া সামরিক অভিযান চালাবার সুযােগ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে দেননি। তিনি তাঁর ৩৫ দফা ফতােয়ার কোথাও পূর্ববঙ্গকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলেননি। শুধু সামরিক আইনের কবল থেকে মুক্ত করে পূর্ববঙ্গের জনজীবনকে কীভাবে সচল রাখতে হবে তারই কতকগুলাে প্রশাসনিক নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু যেসব স্থানে সামরিক বাহিনীর শিবির রয়েছে সেগুলােকে এই নির্দেশনামার আওতা থেকে বাদ দিয়েছেন তিনি। প্রতিটি পদক্ষেপেই বিচক্ষণতার পরিচয় দিচ্ছেন বাংলার এই মানুষ।
বেকায়দায় পড়েছেন জেনারেল ইয়াহিয়া খান। পূর্ববঙ্গের এই গণতান্ত্রিক দুর্গের দুর্লঙ্ প্রাচীর দেখে তিনি খানিকটা বিচলিত হয়েছেন বলেই ছুটে এসেছেন ঢাকায় জনাব রহমানের সঙ্গে আপােসের আশায়। উদ্যত অস্ত্রের পাহারায় বিমানঘাঁটি থেকে আসতে হয়েছে তাকে নিরাপদ বাসভবনে; কিন্তু কোথায় আছেন তিনি, তাঁর একমাত্র বিশ্বস্ত অনুচরবৃন্দ ছাড়া আর কেউ তা জানে না। জনতার ভয়ে এতবড়াে জাঁদরেল জঙ্গি রাষ্ট্রপতির আজ অজ্ঞাতবাস। গণতন্ত্রকে হত্যা করতে গিয়ে তার চেয়ে পৃথিবীর আরাে অনেক বড়াে সেনাপতির শুধু আত্মগােপনই নয়, দেশত্যাগও কপালে জুটেছে। তার ভাগ্যেও শেষ পর্যন্ত কী আছে বলা যায় না।
পূর্ববঙ্গের এই গণঅভ্যুত্থানে পশ্চিম পাকিস্তানও কেঁপে উঠেছে। সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল আজ দুশ্চিন্তার অবধি নেই। পূর্ববঙ্গ যদি শেষ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন হয়েই যায় তবে শুধু পাকিস্তানের মর্যাদাই যে ক্ষুন্ন হবে এমন নয়, গােটা পাকিস্তানই দুর্বল হয়ে পড়বে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ক্ষতিও যথেষ্ট হবে। তাই সেখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে ইয়াহিয়া খানের উপর চাপ পড়ছে যাতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে তিনি বিরােধ মিটিয়ে ফেলেন। মধ্যপন্থায় এ বিরােধ মেটা সম্ভব নয় জেনেই পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সুরও এরই মধ্যে অনেকখানি ঘুরে গেছে। প্রথম সুর খানিকটা নরম করে তিনি বলেছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ও পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে নির্বাচিত সংখ্যাগুরু দলগুলাের হাতে শাসনভার অর্পণ করে কেন্দ্রীয় শাসন সামরিক কর্তৃপক্ষের হাতে রাখা হােক। কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা যেতে না যেতেই মত পরিবর্তন করে তিনি বলেছেন, কেন্দ্রের শাসনভার ও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতেই দেয়া হােক। সামরিক আইন শিকেয় তুলে শেখ মুজিবর রহমান পূর্ববঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব নিজ দলের হাতে তুলে নিয়েছেন দেখেই বােধহয় ভুট্টো সাহেবের টনক নড়েছে।
পূর্ববঙ্গের প্রতিটি নরনারীর ধমনীতে ধমনীতে আজ শােণিতের প্রবল চাঞ্চল্য। কিন্তু সে চাঞ্চল্য তাদের বিপথগামী না করে বুকের বল আরাে বাড়িয়ে দিচ্ছে। শক্তির দম্ভ বা অপচয় নেই কোথাও। সংযত সংহত শক্তি চীনা প্রাচীর তৈরি করেছে। মুজিবর রহমানের ভাষায় বাংলাদেশের জনগণের মুক্তির জন্য এই সংগ্রাম। তাই তিনি সর্বপ্রকার ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান দিয়েছেন তাঁর দেশবাসীকে। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যদের একটি গুলিবর্ষণে সারা পূর্ববঙ্গে আগুন জ্বলতে পারে। ইয়াহিয়া খান যদি রক্তগঙ্গা বইয়ে দেবার পথই ধরেন তবে রক্ততিলক ললাটে ধারণ করেই পূর্ববঙ্গের মানুষ তার গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য শেষ সংগ্রাম করে যাবে। এই প্রতিজ্ঞা আজ পূর্ববঙ্গবাসী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির।
সূত্র: কালান্তর
১৭.৩.১৯৭১