পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন অধ্যায়
স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ তেইশ বছর পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হতে চলেছে। বহু রক্তঝরা সংগ্রামের ফলে জনসাধারণের দাবি যথা সার্বজনীন ভােটাধিকার, সংবিধান রচনা ও অসামরিক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন আজ স্বীকৃত। সগ্রামের দীপ্ত ঐতিহ্য নিয়ে সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদেও প্রথম অধিবেশন আহূত হয়েছে ৩ মার্চ ঢাকা প্রাদেশিক আইনসভা ভবনে। শত শহীদের রক্ত সিক্ত বাংলাভাষা ও শ্রমিক আন্দোলনের পীঠস্থান ঢাকা মহানগরীতে সারা পাকিস্তানে নতুন ভবিষ্যৎ রচনা হবে। আর ৩ মার্চ হবে পাকিস্তানের জনজীবনে এক ঐতিহাসিক দিবস। ঐদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ অধীর আগ্রহে সংবিধান রচনার কার্যারম্ভ প্রত্যক্ষ করবে। পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়া উপনিবেশবাদ ও তার আজ্ঞাবহ সামরিক শাসকদের নির্মম শাসন ও কুটিল চক্রান্ত আজ জনদরবারের সম্মুখীন হয়েছে। কিন্তু নয়াউপনিবেশবাদী চক্রান্ত নির্মূল হয়নি, পরাজয়ের পর নতুন কৌশল অবলম্বন করেছে। তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামেরও বিরতি হয়নি, নতুন পরিস্থিতিতে রণকৌশলের পরিবর্তন হয়েছে মাত্র।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক যেমন একদিকে জনদরবারের কাছে মাথা নত করেছে, তেমনি তার বিরুদ্ধে পাল্টা আঘাত হানার জন্য নতুন রণকৌশল অবলম্বন করেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেছেন যে, ১২০ দিন অর্থাৎ ৩০ জুনের মধ্যে জাতীয় পরিষদ সংবিধান রচনা করতে ব্যর্থ হলে তিনি জাতীয় পরিষদই ভেঙে দেবেন। অর্থাৎ সার্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদকে তিনি এখনও সার্বভৌম ক্ষমতা দিতে নারাজ। কেবল তা নয়, তিনি আরও শর্ত আরােপ করেছেন। জাতীয় ঐক্যের স্বার্থ ও প্রজাতন্ত্রের ঐস্লামিক চরিত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত না হলে তিনি সেই সংবিধান গ্রহণ করবেন
অর্থাৎ ভারতে জনসংঘের মতােই ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বিরােধী। তাঁর এই চক্রান্তকে কার্যকর করার জন্য তিনি ইতােমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা জনাব ভুট্টোকেও তালিম দিয়ে রেখেছেন। জনাব ভুট্টো ধর্মীয় রাষ্ট্রের গোঁড়া সমর্থক। উপরন্তু ভারতের বিমান ছিনতাই ও ধ্বংসকে কেন্দ্র করে যে ষড়যন্ত্র হয়েছে তার সম্পর্কেও পূর্ব-পাকিস্তানের জননেতা ও সংবাদপত্রের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের জনাব ভুট্টোর দলের সঙ্গে তার মতবিরােধ সৃষ্টি হয়েছে। পূর্ব-পাকিস্তানের জননেতারা ও সংবাদপত্র এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে ও তদন্ত দাবি করেছেন। আর জনাব ভুট্টো ছিনতাইকারীদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর লাহােরে তাদের সমর্থনে মিছিল সংগঠিত হয়েছে। ভারতের উপর দিয়ে বিমান চলাচল নিষিদ্ধ করার জন্য পাকিস্তান সরকার ভারত সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন। এটা কেবল পাক-ভারত সম্পর্কের অবনতি ঘটায়নি, পাকিস্তানের দুই প্রান্তের মধ্যেও পুরনাে বিরােধের সঙ্গে নতুন উপাদান যােগ করেছে। জাতীয় পরিষদের দুই প্রান্তের বিরােধের মধ্যে তার প্রতিফলন লক্ষ করা যাবে। এটাই হলাে নতুন। পরিস্থিতির মধ্যে নয়া-উপনিবেশবাদীদের নতুন রণকৌশল।
আমরা বিশ্বাস করি পাকিস্তানের সংগ্রামী জনসাধারণ ও নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদের সদস্যরা সাম্রাজ্যবাদের এই নতুন কৌশল সম্পর্কে সজাগ আছেন। এই কারণেই আমরা বলছি যে, পাকিস্তানে জনগণের সংগ্রামের বিরতি হয়নি। নতুন পরিস্থিতিতে সংগ্রামে রণকৌশল পরিবর্তন হয়েছে।
আমরা ঘােষণা করছি যে, পাকিস্তান নয়া-উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সঙ্গে ভারতের জনগণ মৈত্রীর আহ্বান জানাবে। ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধান রচনার কাজে আমরা জাতীয় পরিষদের সাফল্য কামনা করি।
সূত্র: কালান্তর
১৫.২.১৯৭১