মার্কিন দালালের যুদ্ধের পাঁয়তারা
পাক জঙ্গি শাসকচক্রের নায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছেন। ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে রীতিমতাে যুদ্ধের মহড়া দিচ্ছেন। আর বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খানের অর্ধেক সময় ব্যয়িত হয় ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারে। তার মতে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামও ভারতের পাকিস্তান বিরােধী চক্রান্তেরই ফল। অতএব ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেই হবে নতুবা খণ্ডিত পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা অসম্ভব। ভারত বিদ্বেষী প্রচারে পাকিস্তানের মানুষকে উত্তেজিত করা এবং কার্যক্ষেত্রে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করে পাক-ভারত মহাদেশকে উত্তপ্ত করে তুলেছে পাক শাসকচক্র।
ইয়াহিয়া খান বিগত পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণাম বিস্মৃত হয়েছেন। কাশ্মীর সমস্যা সমাধানকল্পে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েও কাশ্মীরের প্রশ্ন সমাধান করতে পারেনি। এবার বাংলাদেশের প্রশ্ন সমাধান করার জন্য ইয়াহিয়া খান একই পথ অনুসরণ করতে ব্রতী হয়েছেন। ইয়াহিয়া খান এক অতি ভয়ঙ্কর পথে পা বাড়াচ্ছেন। কাশ্মীর প্রশ্নকে কেন্দ্র করে বিগত পাক-ভারত যুদ্ধ এই দুই দেশের মধ্যে সীমিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ইয়াহিয়া খান যে যুদ্ধের বিপদ সৃষ্টি করতে চলেছেন তাতে সমগ্র উপমহাদেশে, এমনকি তার বাইরেও শান্তি ও স্থায়িত্ব বিপন্ন হতে পারে। কাশ্মীরের প্রশ্ন বিশ্বশান্তিকে বিপন্ন করতে পারেনি কিন্তু বাংলাদেশের প্রশ্নকে কেন্দ্র করে ইয়াহিয়া খান যে পদক্ষেপ গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছেন তা বিশ্বশান্তিকে বিপন্ন করার ক্ষেত্রকে উর্বর করে তুলছে।
ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের যুদ্ধের হুমকি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এটা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-রণকৌশল এবং বিশেষত এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন রণকৌশলেই অঙ্গীভূত। ভিয়েতনামে আসন্ন পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নতুন রণক্ষেত্র তৈরি করতে বদ্ধপরিকর। চীনের নেতারাও এই বিরাট অঞ্চলে নিজেদের প্রভাবকে সংগঠিত করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অঞ্চল ভাগাভাগির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছেন। এই বিরাট চক্রান্তের কেন্দ্রস্থান হয়েছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের দুর্বার গতি, বিশ্ব-জনমত থেকে পাকিস্তানের শাসকচক্রের ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা ঘােষণা এবং বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা ইয়াহিয়ার শাসনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের অভিপ্রায় অনুসারে রাজনৈতিক সমাধান অথবা মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করার জন্য ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা— এছাড়া ইয়াহিয়া খানের কাছে অন্য কোনাে। বিকল্প পথ নেই। বাংলাদেশ প্রশ্নের প্রকৃত রাজনৈতিক সমাধান ইয়াহিয়া খান চান না, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং চীনেরও অভিপ্রেত নয়। রাজনৈতিক সমাধানই যদি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অভিপ্রেত হতাে তাহলে বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে ধ্বংস করার জন্য তারা পাকিস্তানের জঙ্গি শাসকচক্রকে সামরিক সাহায্যদানে বিরত থাকত। ভারত সরকার ও বিশ্বের জনগণের প্রতিবাদ সত্ত্বেও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রকাশ্যভাবে পাকিস্তানের শাসকচক্রকে সামরিক অস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে।
অতএব এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের রণকৌশল এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা পরস্পর থেকে কেবল অবিচ্ছেদ্য তা নয়, বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশ সম্পর্কে নয়া উপনিবেশিক চক্রান্ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বৃহত্তর পরিকল্পনারই অংশ। ভারতের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার যুদ্ধের হুমকি এই বৃহত্তর পরিকল্পনা থেকেই উদ্ভূত। এই কারণেই আমরা বলছি যে, ইয়াহিয়ার বিপজ্জনক পদক্ষেপ সমগ্র উপমহাদেশে, এমনকি তার বাইরেও শান্তি ও স্থায়িত্ব বিপন্ন করার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে।
যুদ্ধ আমরা চাই না, ভারত সরকারও যুদ্ধ চান না। কারণ যুদ্ধের মাধ্যমে কোনাে বিতর্কিত প্রশ্নের সমাধান হতে পারে না। ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাময়িকভাবে ব্যাহত করার চেষ্টা করেও যে ব্যর্থ হবে এ বিষয়ে কোনাে সন্দেহ নেই। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানের সামরিকচক্র যদি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করার হঠকারী পথই গ্রহণ করে তাহলে তার সমুচিত জবাব পাবে। পাকিস্তানের আক্রমণের স্পর্ধাকে ভারতের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে মােকাবেলা করবে। এই বিষয়ে আমরা পাকিস্তানের সামরিকচক্রকে সতর্ক করে দিতে চাই।
সূত্র: কালান্তর
১৯.১০.১৯৭১