You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের পক্ষে সমাজতান্ত্রিক জার্মানি

বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে প্রতিটি সমাজতান্ত্রিক দেশ যে কত সজাগ ও সচেতন সমাজতান্ত্রিক জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রীর উক্তি তার আরও একটি প্রমাণ। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের নীতি বিধৃত করার জন্য ইউরােপের যে কটি দেশ সফর করছেন তার মধ্যে ধনবাদী রাষ্ট্র পশ্চিম জার্মানির নাম থাকলেও পূর্ব জার্মানি নেই। কিন্তু যেহেতু ভারত সরকার আজও পূর্ব জার্মানিকে কূটনীতিক স্বীকৃতি দেয়নি সে জন্য ঐ সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের প্রতি কর্তব্য পালনে কিংবা সেই কর্মকাণ্ডে সাহায্য করার জন্য ভারত সরকারের নীতিকে সােৎসাহ সমর্থন জানাতে ইতস্তত করেনি।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মস্কো থেকে বন রওনা হওয়ার সময় যে সন্তুষ্টি নিয়ে যাত্রা করেছিলেন বন ছাড়ার সময় তার মেজাজ সেরকম প্রফুল্ল ছিল না। কারণ পশ্চিম জার্মানির শরণার্থীদের সাহায্যকে এ দেশের তথাকথিত জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলাে যত ফলাও করে সংবাদ পরিবেশন করুক ঐ সরকার ইয়াহিয়াকে ছাড়তে নারাজ। একদিকে বাংলাদেশে শরণার্থীদের জন্য ওরা ৫০ লক্ষ মার্ক সাহায্য পাঠালেও পাকিস্তানের জঙ্গিশাহীকে ১৪ কোটি মার্ক সাহায্য দিতে রাজি হয়েছে। এমনকি ভারত সরকারের অনুরােধ সত্ত্বেও পাকিস্তান সহায়ক সংস্থা, পশ্চিম জার্মানি যার অন্যতম অংশীদার, পাক সরকারকে সাহায্য দেয়া বন্ধ করতে রাজি হয়নি। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক জার্মানি শরণার্থীদের জন্য কেবল সাহায্যই পাঠায়নি সেই সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনীতিক সমাধানের দাবি করেছে।
এ দেশের অনেকেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে সম্পর্কে এই ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে যে, নিজেদের জাতীয় স্বার্থ বিপন্ন করে ওরা বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। অর্থাৎ যেমনভাবে সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলাে এই সমস্যাকে পাকিস্তানের ঘরােয়া সমস্যা বলে চুপ করে বসে থাকার চেষ্টা করছে এবং নেহাতই চক্ষু লজ্জার ও দেশের গণতান্ত্রিক জনমতের চাপে পড়ে মানবতার দোহাই পেড়ে কিছু সাহায্য পাঠিয়ে কর্তব্য পালনের চেষ্টা করছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের ভূমিকা তার থেকে কিছু মাত্র ভিন্ন নয়।
এই প্রচারের দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য, মুক্তি আন্দোলনকারীদের কাছে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলােকে হেয় করা এবং এভাবে তাদের সংগ্রামী চেতনাকে দুর্বল করা। পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রী তার মুখের মতাে জবাব দিয়েছেন। শরণার্থীদের জন্য তাঁরা এক বিমান বােঝাই ওষুধপত্র, তবু ও অন্যান্য জিনিস পাঠিয়েছেন এবং আরও পাঠাবেন। ঐ দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাে পূর্ণোদ্যমে দেশের মধ্যে অর্থ সংগ্রহ করছেন আরও সাহায্য পাঠানাের উদ্দেশে। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাে কেবল সাহায্য পাঠিয়ে বা সেবা করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হবে বলে বিশ্বাস করে না। পূর্ব জার্মান সরকার সােভিয়েত ইউনিয়নের মতাে সেই কথাটা স্পষ্ট করে জোরের সঙ্গে ঘােষণা করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের আন্দোলনের ন্যায্যতা সম্পর্কে ঐ সরকারের মনে কোনাে সন্দেহ নেই এবং এর সমাধান যে শরণার্থীদের দেশে ফেরার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা সে বিষয়ে সরকার নিঃসন্দেহ। আর সেই পরিবেশ সৃষ্টিতে ইয়াহিয়াকে যে বাধ্য করতে হবে পূর্ব জার্মানির সরকার এই ঘােষণা করতেও সংকোচ করেনি।
কেবল পূর্ব জার্মানি বা সােভিয়েত ইউনিয়নই নয়, হাঙ্গেরী, পােল্যান্ড ও অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশের সরকার, শ্রমিক শ্রেণী এবং জনসাধারণ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য যেমন সাহায্য পাঠাচ্ছেন অন্যদিকে তেমনি মুক্তি আন্দোলনের পক্ষে বাংলাদেশের সমস্যার রাজনীতিক সমাধানের জন্য তাদের মত ঘঘাষণা করছে।
ইয়াহিয়া সরকারের সমস্ত যুক্তি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার কাছে আজ অচল। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পুঁজিবাদী দুনিয়ার কর্ণধারদের কুম্ভীরাশ্রু এবং কিছু অর্থের হয়তাে অভাব হবে না কিন্তু সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সুদৃঢ় সমর্থন ছাড়া এই শরণার্থীরা কোনাে দিনই মাথা উঁচু করে তাদের স্বদেশের মাটিতে ফিরে যেতে পারবেন না। এ দেশের সাম্রাজ্যবাদী স্তাবকেরা সে কথা জানে তাই সুকৌশলে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের ভূমিকাকে হেয় করার জন্য মরিয়া প্রয়াস করছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণার পর পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রীর এই ঘােষণা ওদের এই অপপ্রয়াসকে নিঃসন্দেহে ধুলিস্যাৎ করবে।

সূত্র: কালান্তর
জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!