পশ্চিমবাংলার গর্ব
লেবানীজ জাহাজ আইভরি নেপচুন দু’দিন ধরে বজবজে দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের মালিক পশ্চিম জার্মানির বাসিন্দা। তার গন্তব্যস্থল ছিল পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার। কিন্তু পশ্চিমবাংলা থেকে চট্টগ্রাম পাকহানাদারদের জন্য রসদ বা জ্বালানি নিয়ে যাবে এমন জাহাজী শ্রমিক কে আছেন? মালিক দু’দিন ধরে চেষ্টা করছেনকিন্তু একজন খালাসিও তিনি পাননি, যে বাংলাদেশের শ্রমিক ও জনসাধারণের রক্ত ঝরানাের কাজে পাকহানাদারদের সাহায্য করবে।
জাহাজটি দাঁড়িয়ে আছে এবং থাকবে যতদিন মালিক বন্দর শ্রমিকদের ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের জাহাজের মাল কী আছে তা দেখতে না দিচ্ছেন। মালিক এখন বলছেন, জাহাজ নিয়ে তিনি সিঙ্গাপুর যাবেন। আর জাহাজে পাকিস্তানের জন্য কোনাে মাল নেই।
পূর্ববাংলার জাহাজী শ্রমিকরা জাহাজের মালিকদের চেনেন। তারা কার সেবা করে তাও জানেন। তাছাড়া ঐ জাহাজেরই ২৬ জন খালাসি চাকরি ছেড়ে তাদের কাছেই আশ্রয় নিয়ে সবকিছু ফাস করে দিয়েছেন। জাহাজটি পাকিস্তানের ভাড়া খাটে দু’বছর ধরে। এবার ঐ জাহাজ কয়লা নিয়ে চট্টগ্রাম গিয়েছিল কিন্তু মাল খালাস করতে পারেনি। তাই ওখান থেকে ফিরে এসে আবার নতুন লােক নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করছে। জাহাজের চাকরি করলে কী হবে ওঁরাও তাে বাংলাদেশের অধিবাসী। চট্টগ্রামের জলে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ওঁদের কেউ কেউ লুকিয়ে শহরে নেমে নিজেদের ঘরবাড়ির ধুলিসাৎ চেহারা দেখে এসেছেন। জাহাজ থেকেই কর্ণফুলির জলে ভাসমান মৃতদেহগুলাে দেখেছেন আর তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন হানাদারদের বিরুদ্ধে কীভাবে আঘাত করবেন। এঁরা কলকাতায় নেমে এপারের জাহাজী শ্রমিকদের বলেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা। আর তখন থেকেই শুরু হয়েছে সব শ্রমিকের এক লড়াই।
কলকাতার রাজপথে প্রতিদিন বাংলাদেশের সমর্থনে মিছিল হচ্ছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষক, ছাত্র, যুবক, কেরানী, কর্মচারী সংগ্রামী বাংলাদেশের প্রতীক বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের দরজায় গিয়ে অন্তরের অভিনন্দন আর উষ্ণ সমর্থন জানিয়ে আসছেন। রক্ত, অর্থ, শ্ৰমদানের ঘটনাও প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা ভরে দিচ্ছে। কিন্তু শ্রমিকশ্রেণীর এই একটি মেজাজের পরিচয় বহন করছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারা হানাদার পাক-ফৌজের সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করার দিকে লক্ষ দিয়েছে প্রথম থেকেই। সরবরাহ ব্যবস্থা অটুট থাকলে শত্রুকে পরাজিত করা সময়সাপেক্ষ। তাই রাস্তা কেটে, সেতু উড়িয়ে, বিমান ক্ষেত্র ভেঙে মুক্তিফৌজ হানাদারদের অস্ত্রে এবং অন্নে বুভুক্ষু করতে চাইছে। কলকাতার জাহাজী শ্রমিকরা বাংলাদেশের সীমানার বাইরে দাঁড়িয়ে সেই এক লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। আইভরি নেপচুনের কয়লা চট্টগ্রাম বন্দরে ততদিন পৌছাবে না যতদিন হানাদারের অস্ত্রে বাঙালি জোয়ানের রক্ত ঝরবে। নেপচুনকে বজবজের জলেই ভাসতে হবে যতদিন না শ্রমিকরা নিজের চোখে দেখছেন ঐ জাহাজে কী আছে।
প্রত্যেকটি দেশের মুক্তি সংগ্রামের হানাদারদের বিরুদ্ধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শ্রমিকশ্রেণী বারে বারে এভাবে তাঁদের সৌভ্রাতৃত্ব প্রকাশ করেছেন। কলকাতার জাহাজী শ্রমিকরা ব্যক্তিগতভাবে বিশিষ্ট না হয়েও দল বেঁধে যে বিশিষ্টত্য অর্জন করেছেন পশ্চিমবাংলা সে জন্য গর্বিত।
সূত্র: কালান্তর
২২.৪.১৯৭১