You dont have javascript enabled! Please enable it!

সরকারী কর্মচারীদের প্রতি বঙ্গবন্ধু

ভাষণের স্থান ও তারিখ – ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠে জনসভায় | ৫ এপ্রিল ১৯৭২

(ভাষণের অডিওটা এখানে টাইপ করে দেয়া হল)

ভাইয়েরা আমার, সরকারি কর্মচারী ভাইদের বলবো। পুরানা মত, পুরানা পদ ছেড়ে দেন। বিপ্লবের মাধ্যমে যেখানে স্বাধীনতা আছে, সেখানে অনেক দেশে চাকরির বরাত অনেকের থাকে না। আমি আপনাদের অনেকের চাকরি রেখে দিয়েছি। আমি চাই, যে আপনারা এই বাংলার মায়ের সন্তান হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সেবা করবেন। আপনারা সেবক, আপনারা শাসক নন। আমি আপনাদের আবেদন করবো- আমি আপনাদের নির্দেশ দিব, আমি আপনাদের অনুরোধ করবো এদেশের প্রত্যেকটা মানুষ আপনার ভাই, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার পাড়াপড়শি, জনগণের সেবা করতে হবে। সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে। আমি এত সোজা বুঝেন না। আমি লোক অত সোজা মানুষ নই। জানা আমার আছে। দরকার হলে, আপনারা জানেন যে মেশিনগানের সামনে আমি বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, যা আপনারা দেখেছেন, অনেকবার দেখেছেন। মৃত্যু ভয় আমি করি না। এই সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে ভালোবাসা আমাকে দিয়েছে, যে ভালোবাসা ওদের কাছ থেকে পেয়েছি দুনিয়ার কোনও দেশে, কোনও নেতা তা পায় নাই। প্ৰধানমন্ত্ৰিত্ব আমি চাই না, আমি চাই দেশের মানুষের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়ে আমি মরতে চাই। (জনতার করতালি)। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। দিনের আরাম রাতের বিশ্রাম হারাম করেন, দেশে একটা ধ্বংসস্তুপ। তারপরে দেশকে আমার গড়ে তুলতে হবে। আপনারা কাজ করতে হবে আপনাদের। রাত নাই, দিন নাই, দশটা-পাঁচটা ভুলে যান। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করি। আমি আমার জীবনের যৌবন দিয়ে দিয়েছি। ১১ বচ্ছরের মত আমি জেল খেটেছি। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করছি। আমার সহকর্মীরা কাছ করছে। আপনারাও কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনাদের যে পয়সা বেতন দেয় এই জনগণে দেয়। আমি যদি খবর পাই, আইন আমার হাতে আছে। আইন আমি ব্যবহার করতে চাই না। আমার লাগবে খালি একটা কলম। ইওর সার্ভিস নো লংগার রিকোয়ার্ড – আপনার চাকরি আর দরকার নাই। বাড়ি যেতে হবে। মেহেরবানি করে আপনারা কাজ করেন, জনগণকে বলবো – আপনাদের সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সহযোগিতায় দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি চেস্ট থেকে টাকা দিয়েছি এটা আদায় করতে – কোটি কোটি টাকা। এই টাকা গরিবের জন্য ব্যয় করা হবে। যদি কেউ এই টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে – সে আমার দলের লোক হোক – সে ছাত্র হোক যুবক হোক – অন্য দলের লোক হোক – তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। (জনতার করতালি)। আমি চাইনা, আর আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ করবেন। ঘুষ-দুনীতি আল্লাহর ওয়াস্তে মাক করেন আমাদের। মেহেরবানি করে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেন। এই জমি পবিত্র জমি, এই জমির এমন কোনও জায়গা নাই যেখানে আমার দেশের মা-বোনের রক্ত নাই, এই জমির এমন কোনও মহকুমা নাই যেখানে আমার দেশের মা-বোনের কবর নাই, এই জমির এমন কোন নদী নাই যেখানে আমার দেশের ছেলের লাশ ভাসে নাই। তাদের কথা মনে করে, তাদের আত্মার কথা মনে করে, তাদের রক্তের কথা মনে করে, আমি আমার জনগণকে, আমি সরকারি কর্মচারীকে, আমি ব্যবসায়ীকে, আমি শ্ৰমিককে, আমি কৃষককে, জাতির কাছে আবেদন জানাই – দেশের গড়ার কাজে ব্রত হন। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। দেশের মানুষ আজ দুঃখি, দেশের মানুষ আজ না খাওয়া, আজ ঘরে ঘরে গৃহহারা, সর্বহারার আর্তনাদ। আজ গ্রামে-গ্রামে আমি দেখি মানুষের ঘর-বাড়ি নাই। তিন মাস পরে বর্ষা আসবে। আমার মানুষ কোথায় থাকবে আমি চিন্তা করে ঘুমাতে পারি না। আমি আপনাদের কাছে চাই, যার ঘর আছে তার পাশের বাড়িতে ঘর দিয়ে সাহায্য করেন, যার খাবার আছে তারা অন্যকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন। এটা হলো মনুষ্যত্বের প্রধান লক্ষণ। আমার জয় বাংলা ভূলুণ্ঠিত হবে না। যেন বাংলার মানুষের জয় হয়। বাংলার মানুষ সুখী হয়। বাংলার মানুষ শোষণহীন সমাজ গড়তে পারে। সমাজতন্ত্র আমি করবো। সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে হবে। শোষণহীন সমাজ বাংলাদেশে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করেছি এবং আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি জানি বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমিও চাই বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমি চাই বাংলার মাটিকে আমি ভালোবাসি, বাংলা মাটিও আমাকে ভালবাসে। না হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে পারতাম না। আমার মনে হয় এই দেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া আর এই মাটির টানে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে যেখানে আমাকে কবর খোড়া হয়েছিল তার পাশ থেকে আমি এইখানে আসতে পারতাম না। এই মাটিকে আমি ভালোবাসি। (জনতার করতালি।) আমি চাই আমার বাংলার মানুষ বাঁচুক, আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক। আমার বাংলার মানুষেরা মিথ্যাবাদী না হোক, আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক, আমার বাংলার মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক। লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে আমার দেশে। চাকরির বন্দোবস্ত আমি করতে পারছি না। ভায়েরা আমার, চাকরির বন্দোবস্ত করতে হলে কল- কারখানা করতে হবে। সরকারি চাকরিতে এত চাকরি পায় না। আমি কুটির শিল্পের দিকে নজর দেবার চাই। আমি গ্রাম্য ভিত্তিতে আমি আমার অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চাই। শহরভিত্তিক অর্থনীতি গড়তে চাইনা। এবং এখানে নীচের থেকে আরম্ভ হবে বাংলার উন্নতি – শহর থেকে নীচের দিকে যাবেনা। এইটা করতে হলে সকলের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি আপনাদের কাছে, আপনারা জানেন- যে দেশে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে সে দেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি, আমার সহকর্মীরা যারা আমার আদেশ চালিয়েছেন তারা হত্যাকাণ্ড চালাবার দেন নাই। আমি তা চাই না। নির্দয়, নিরাপরাধ মানুষ মরুক আমি চাই না। তার মানে এই না যে আমাদের দুর্বলতা আছে। আমাদের দুর্বলতা নাই। কাজ করেন, মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেন। পয়সা খাওয়া ছেড়ে দেন। লোভ ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী ভাইরা, আবার বলে দিছি সাত দিন সময়, ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্সি, তেলের এজেন্সি, সাবান এজেন্সি, সিগারেটের এজেন্সি (অস্পষ্ট) আমি দশ দিন পরে ক্যানসেল করিয়া দিব। (জনতার করতালি।) যদি তাও না করেন, আপনারা তো জানেন, আমি মুজিবুর রহমান যেটা বলি সেটা করবার চেষ্টা করি।

Reference:
বঙ্গবন্ধুর অডিও ভাষণ, পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!