ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠে জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
৫ এপ্রিল ১৯৭২
ময়মনসিংহ
ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার,
আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন, আমরা আজকে স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ আজ সর্বভৌম স্বাধীন দেশ। কিছু দুনিয়ার কোনও দেশ, দুনিয়ার কোনও জাতি কখনো দেয় নাই যা আমার বাঙালিরা দিয়েছে। ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে এ বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য। এমন একটা অসভ্য দেশের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব ছিলো যে পশ্চিম পাকিস্তান বা পাকিস্তান বলা হয়, তাদের সেনাবাহিনীর লোকেরা পশুর চেয়েও অধম। তারা লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে, তারা আমার ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেছে, তারা আমার সবাইকে হত্যা করেছে, তারা আমার রক্ষীবাহিনীকে হত্যা করেছে, তারা আমার সাবেক ইপিআরকে হত্যা করেছে, তারা আমার সামরিক বাহিনীর ভাইকে হত্যা করেছে, তারা কৃষকদের হত্যা করেছে, তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে, তারা দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে। হত্যা করেই শান্ত হয় নাই। তারা আমার রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করেছে। তারা আমার চালের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আমার সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তারা আমার পোর্ট ভেঙ্গে দিয়েছে। তারা আমার রেললাইনকে নষ্ট করেছে। তারা আমার পোস্ট অফিসকে ধ্বংস করেছে। তারা আমার বৈদেশিক মুদ্রা চুরি করেছে। তারা আমার স্বর্ণ লুট করে নিয়ে গেছে। তারা আমার টাকার নোট জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এমন একটা দেশ জেলের থেকে এসে আমি পেলাম, আমি আইসা দেখলাম, আমার সহকর্মীরা আমার কাছে দিলো, আমি দেখলাম একটা ধ্বংসস্তূপ। আমি জানি না, এদের কী করে বাঁচাবো? আমি জানি না এদের কী করে আমি ভাত দিবো? আমি জানি না কী করে এঁদের আমি কাপড় দিবো?
ভাইয়েরা আমার,
আপনারা জানেন আপনাদের দেশের অবস্থা। আপনারা জানেন, কী সর্বনাশ হয়েছে এ বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য কিন্তু কিছুই পাই নাই। আমি চিন্তা করে কুল পাই না, কেমন করে এ বাংলাদেশের লোককে বাঁচাবো? ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। মায়ের বুক খালি হয়েছে। বোন বিধবা হয়েছে। সংসার ছারখার হয়েছে। ২৫… আড়াই কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পশুর দল। মনে করেছে…আর আফসোস পশ্চিমারা করেছে করেছে, একদল বাঙ্গালি রাজাকার, আর বদর নামে পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগদান করে আমার বাংলার গরিব দুঃখিকে হত্যা করেছে। রাজাকাররা মনে করেছে যে তাদের ক্ষমা হবে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন, রাজাকার-বদর যারা খুন করেছে তাদের ক্ষমা হবে না। তাদের বিচার হবে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন আপনারা।
আপনারা আজ … ভুট্টো সাব বলছেন, “বিচার হবে না”। বিচার হবে, ভালো কইরে বিচার হবে। যে সমস্ত জেনারেল, ব্রিগেডিয়ার, কর্নেল আমার বাংলার মা-বোনকে হত্যা করেছে এই বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে। কেউ ঠেকাতে পারবেনা। (অস্পষ্ট) আমি মিথ্যা ওয়াদা করতে পারি না। আমি মিথ্যা ওয়াদা জীবনে কোনদিন করি নাই। আমি আপনাদের জন্য ভোট নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ই মার্চ তারিখে- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। (জনতার করতালি।)
আপনারা (অস্পষ্ট) আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যায়। আমি আপনাদের কাছে অন্ত্র দেবার পারি নাই। আমার যারা সেপাই ছিল তাদের কাছে থ্রি নট থ্রি গান ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। আর যারা জনসাধারণ ছিলো, লাঠি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না। তাই লাঠি আর খ্রি নট থ্রি দিয়ে এই সামরিক বাহিনীর মোকাবেলা করেছে আমার ছেলেরা, আমার বোনেরা। আইজ দুনিয়া দেখেছে বাঙ্গালি কাপুরুষ নয়, বাঙ্গালি যুদ্ধ করতে পারে, বাঙ্গালি যুদ্ধ করতে জানে। বাঙ্গালি মরতে জানে, বাঙ্গালি মারতেও জানে। (জনতার করতালি।)
আপনাদের কাছে আমি কী বলবো? আমি আড়াই মাস হল জেলের থেকে এসেছি, আড়াই মাস। আমাকে বাধ্য হয়ে প্ৰধানমন্ত্রিত্ব নিতে হয়েছে। কারণ আমি জানি, যে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো বাংলার স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করার জন্য চেষ্টা করছে। ৩০ লক্ষ লোক যদি স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য জান দিয়ে থাকে আমি বিশ্বাস করি এক কোটি লোক স্বাধীনতা রক্ষার করার জন্য জান দিবে বাংলার মানুষ। (জনতার করতালি।)
যদি কেউ বলে আপনাদের এই করবো, ঐ করবো ঐ করবো যা সর্বনাশ করে গেছে, জানেন আপনারা চট্টগ্রাম, আল্লাহর মর্জি আমি রাশিয়া গিয়েছিলাম, তাদের সঙ্গে কন্টাক্ট করেছি। সমস্ত জাহাজ ডুবোয়ে দিয়ে গেছে সমুদ্রের মধ্যে। জাহাজ ভালভাবে আসতে পারেনা। একটা চ্যানেলের প্রয়োজন যা দিয়ে জাহাজ আসে। জাহাজ যদি মাল পাস না করে আর মাল আনতে না পারে আপনাদের কোথেকে আমি দেবো? আমি কিচ্ছু তিন বৎসর দেবার পারবো না। রাজি আছেন? (জনগণ সমস্বরে- “আছি।”) ও হবে না- হাত তুলে দেখাতে হবে, রাজি আছেন কিনা। (জনগণ সমস্বরে- “আছি।”) হ্যাঁ দেয়া হবে।
কোনও মানুষ ইনশাল্লাহ বাংলায় না খেয়ে মরবে না, সে বন্দোবস্ত আমি করেছি। (জনতার করতালি।) আমার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতবর্ষ শ্রীমতি গান্ধী ৫ লক্ষ টন খাবার আগে দিবেন করে বলেছিলেন, পরে আবার আমাকে খবর দিয়েছেন আরও আড়াই লক্ষ টন খাবার দেবেন। আমি বার্মার থেকে চাল কিনেছি। রাশিয়া আমাকে চাল, খাবার দেবার জন্য বলেছে। জাপান থেকে কেনার বন্দোবস্ত করতেছি। জাতিসংঘ আমাকে চাল দেবে ওয়াদা করেছে। ইনশাল্লাহ যদি একবার আমার সমস্ত চলাচল ভালোভাবে শুরু হয়ে যায় আর অভাব হবে না। তবে চুরি করে যদি কেউ খায় তার নাড়ি কেটে ফেলে দিতে হবে।(জনতার করতালি।) একদল লোক জিনিসের দাম বাড়াইয়া দিয়েছে, তেলের দাম, কাপড়ের দাম, সাবান।
আইজকে আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমি আগে করি নাই। কারণ আমি আস্তে আস্তে আস্তে আস্তে আস্তে আস্তে আগাই।(জনতার করতালি।) এই বাংলাদেশে যতো ডিস্ট্রিবিউটর আছেন, যতো হোল সেলার আছেন, যতো এজেন্ট আছেন, তেলের, সাবানের, কাপড়ের যা কিছু হোক, যদি সাত দিনের মধ্যে জিনিসের দাম না কমে, সমস্ত… সমস্ত এজেন্ট যদি দাম না কমায়, সমস্ত ডিষ্ট্ৰিবিউটশন এজেন্টকে আমি ক্যানসেল কইরে দেবো (জনতার করতালি।) আর প্রত্যেক ইউনিয়নে ইউনিয়নে একটা করে কো-অপারেটিভ স্টোর করবো। তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষকে লুট করতে দেই নাই। (জনতার করতালি।) তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি, জিনিস যদি পাওয়া দাম কেন বেশি হবে? (জনতার করতালি।) ফ্যাশন হয়ে গেছে, কেরাসিন ত্যাল আছে, অন্য গোপনে চালায় দিয়ে দাম বাড়ায় দেয়, এদের এজেন্সি ক্যানসেল হয়ে যাবে। এই মুজিবর রহমান বলে দেবে এর এজেন্সি ক্যানসেল।(জনতার করতালি।)
আইজ বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। বাংলাদেশে মানুষ দুইবার আমাকে ফাঁসির থেকে বাইর কইরে নিয়ে এসেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হই নাই প্ৰধানমন্ত্ৰিত্ব করবার জন্য। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি বাংলার মানুষকে হাসিমুখ ফোটাবার জন্য।(জনতার করতালি।) ভুলে যান, আমি ভুঁড়িওয়ালাদের পেট কাইটে দিছি। (জনতার করতালি।) ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, বড় বড় পাটের কল, সব পাটের কল, সব কাপড়ের কল, সব চিনির কল সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি, ভুড়িওয়ালাদের কাছে আর নাই। (অস্পষ্ট)।. আইন পাস করে দিয়েছি যাতে বাংলার মানুষ কাজ করে খেতে পারে। দশ কোটি টাকা (অস্পষ্ট) লোন নেওয়া হয়েছে, এ টাকাও আইসা পৌছবে। সাত কোটি টাকা স্কুল কলেজ সারতে দেওয়া হবে, টিচারদের বেতন দেওয়া হবে। যত বকেয়া খাজনা ছিল, সুদসহ সব মাফ করে দেয়া হয়েছে। (জনতার করতালি।)(অস্পষ্ট)
জমির মালিক আপনারা থাকবেন। ২৫ বিঘার খাজনা (অস্পষ্ট)। না দিলে হবে না। আর কেউ জমি রাখতে পারবে না। (জনতার করতালি।) এই সকলের জমি গরিবের মধ্যে বিলি করতে হবে। (জনতার করতালি।) তবে সব কিছুরই সময় লাগবে। একটা… আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে, আমার শতকরা ৬০ জন … ৬২ জনের মত উনারা রাইফেল- যাকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেল বলত, এখন আমরা বলি এদের বাংলাদেশ বিডিআর- তাদের শতকরা ৬২ জন লোককে হত্যা করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলে যা বাংলাদেশে ছিলো শতকরা ৬৫ জনকে হত্যা করেছে। আইন শৃঙ্গলা- একদম স্ত্রেটকাট আমি বলেছি যে তোমরা আমার কাছে অস্ত্র জমা দ্যাও। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক আমার কাছে অস্ত্র জমা দিয়াছে। চোর, ডাকাত, গুন্ডা কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছে, সামান্য সামান্য। তাদের আমি বলছি, সময় থাকতে বুদ্ধিমানের মতো ভালো মানুষের মতো গোপনে জমা দিয়ে দাও। না হলে উপায় থাকবে না। আর যদি গ্রামে-গ্রামে চোর ঢুকাইয়া দিয়ে রাত্রে ডাকাতি করো; বন্দুক নিয়া, আমি তাদের বলে দিয়েছি, পুলিশকেও বলে দিয়েছি, যারা বন্দুক নিয়ে গুলি চালায়, ডাকাতি করবার চেষ্টা করবে, সোজা গুলি চালাইয়া দিয়া ভুঁড়ি ফাঁড়ি করে দাও আমার আপত্তি নাই।
জনসাধারণ ভাইয়েরা, পুলিশ দিয়ে হবে না, বদর বাহিনী, ফদর বাহিনী যা পাবো জেলে ভইরে দিছি পঞ্চাশ হাজার আছে আর লাগলে আরও ৫০ হাজার যাবে। ওদের আমি বিচার করবো। তবে একটা কথা আছে, নিরাপরাধ মানুষ যেন নিজের সঙ্গে দুশমনি আছে বলে সাজা না পায়। আর যে অন্যায় করেছে তাকে আপনাদের সাজা দিতে হবে। আমি নিরাপরাধীদের গ্রেফতার করতে চাই না, তবে এখন মাঝে মাঝে আবার একটু কাছিম দেখেছেন? কাছিম? কাছিমের মতো মাথা বাইর করছে। ওরা আপদ-বিপদ দেখলে পেটের মধ্যে মাথাটা নিয়া যায়। আর যেই দেখে মানুষ …ঐ বদর বাহিনী… মাথা বাইর করতেছে। স্বাধীনতা পেলাম ৩০ লক্ষ লোক রক্ত দিয়ে আর যা চলছে ঐ কাছিম তল্লাটের থেকে কেমন করে দূর করতে হয় তা মানুষ জানে। আপনারা তা পারবেন না? (জনগণ সমস্বরে, “হ্যা”।) আপনারা যদি পারেন হাত তুলে আমাকে দেখান যে এসমস্ত লোকের বিরুদ্ধে আমি আছি। ছাত্র ভাইরা, একটু লেখাপড়া করেন এবার। বই নাই বই নাই আমার কাছে যা আছে তাই ব্যাবস্থা করে দেবো। আমি তোমাদের যারা যুদ্ধ করেছো তাদের ২০ টাকা স্কুলে, ৩০ টাকা কলেজে, ৪০ টাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে – যারা বৃত্তি পেয়েছে তাদের জন্য কিছু দেবার চেষ্টা করবো। পয়সা নাই, আমি নাকে ক্ষত দিয়া পয়সা আনতে পারবোনা ব্যাটারা, কষ্ট করতে হবে। যা আছে তাই তোমরা পাবা – মনে করবা এ টাকা তোমাদের। (অস্পষ্ট)। তাই আমি আপনাদের কাছে অনুরোধ করছি যে আপনারা গ্রামে-গ্রামে, আমার ভাইয়েরা পুলিশ ইনকোয়ারি করে আমি শান্তি রক্ষা করতে চাই না। আমি জনগণের সাহায্য চাই। জনগণকে নিয়ে আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। আজ জনগণকে নিয়েই আমি সংগ্রাম করতে চাই। দেশ গড়ার সংগ্রাম। এবং যাতে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আপনারা রাজি আছেন কিনা? আপনারা রাজি আছেন? গ্রামে-গ্রামে চোর-ডাকাত ধরবেন? (জনতা সমস্বরে, “ধরবো”।) ধরে ধরে পুলিশে দিয়ে দিবেন। আর একটা কথা রয়ে গেলো, আপন বুঝ পাগলেও বোঝে। বোঝেনা? তা আমার দলের ভিতরে কিছু কিছু লোক আছে যারা রাতে একটু ঐ চোরাকারবারি করে। (জনগণের করতালি)। আমি বলে দিয়েছি যে আপনারা বর্ডারে বর্ডারে আপনারা গণ কমিটি গঠন করেন, দল-মত-জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে। এবং ভলান্টিয়ার বাহিনী থাকবে আমি বাংলাদেশ রাইফেলের লোককে পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা সাহায্য সহযোগিতা করবে। মনে রাখবেন এদিনই সিপাহীরা নয়, এরাও এদেশের মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বন্দুক না নিয়ে দুশমনদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক ভাই আমার শহীদ হয়েছে। আমিও তাদেরও বলবো যে রক্ত দিয়ে এত স্বাধীনতা, ঐ স্বাধীনতা তোমরা রক্ষা করার… জনগণের পুলিশ হয়ে যাও …তোমাদের কাছে এটিই আমার আবেদন এবং আবদার।
ভাইয়েরা আমার, সরকারি কর্মচারী ভাইদের বলবো। পুরানা মত, পুরানা পদ ছেড়ে দেন। বিপ্লবের মাধ্যমে যেখানে স্বাধীনতা আছে, সেখানে অনেক দেশে চাকরির বরাত অনেকের থাকে না। আমি আপনাদের অনেকের চাকরি রেখে দিয়েছি। আমি চাই, যে আপনারা এই বাংলার মায়ের সন্তান হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের সেবা করবেন। আপনারা সেবক, আপনারা শাসক নন। আমি আপনাদের আবেদন করবো- আমি আপনাদের নির্দেশ দিব, আমি আপনাদের অনুরোধ করবো এদেশের প্রত্যেকটা মানুষ আপনার ভাই, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার পাড়াপড়শি, জনগণের সেবা করতে হবে। সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে। আমি এত সোজা বুঝেন না। আমি লোক অত সোজা মানুষ নই। জানা আমার আছে। দরকার হলে, আপনারা জানেন যে মেশিনগানের সামনে আমি বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, যা আপনারা দেখেছেন, অনেকবার দেখেছেন। মৃত্যু ভয় আমি করি না। এই সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে ভালোবাসা আমাকে দিয়েছে, যে ভালোবাসা ওদের কাছ থেকে পেয়েছি দুনিয়ার কোনও দেশে, কোনও নেতা তা পায় নাই। প্ৰধানমন্ত্ৰিত্ব আমি চাই না, আমি চাই দেশের মানুষের ভালোবাসা। এই ভালোবাসা নিয়ে আমি মরতে চাই। (জনতার করতালি)। আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। দিনের আরাম রাতের বিশ্রাম হারাম করেন, দেশে একটা ধ্বংসস্তুপ। তারপরে দেশকে আমার গড়ে তুলতে হবে। আপনারা কাজ করতে হবে আপনাদের। রাত নাই, দিন নাই, দশটা-পাঁচটা ভুলে যান। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করি। আমি আমার জীবনের যৌবন দিয়ে দিয়েছি। ১১ বচ্ছরের মত আমি জেল খেটেছি। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করছি। আমার সহকর্মীরা কাছ করছে। আপনারাও কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনাদের যে পয়সা বেতন দেয় এই জনগণে দেয়। আমি যদি খবর পাই, আইন আমার হাতে আছে। আইন আমি ব্যবহার করতে চাই না। আমার লাগবে খালি একটা কলম। ইওর সার্ভিস নো লংগার রিকোয়ার্ড – আপনার চাকরি আর দরকার নাই। বাড়ি যেতে হবে। মেহেরবানি করে আপনারা কাজ করেন, জনগণকে বলবো – আপনাদের সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গে সহযোগিতায় দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি চেস্ট থেকে টাকা দিয়েছি এটা আদায় করতে – কোটি কোটি টাকা। এই টাকা গরিবের জন্য ব্যয় করা হবে। যদি কেউ এই টাকা আত্মসাৎ করার চেষ্টা করে – সে আমার দলের লোক হোক – সে ছাত্র হোক যুবক হোক – অন্য দলের লোক হোক – তাদের শাস্তি দেওয়া হবে। (জনতার করতালি)। আমি চাইনা, আর আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ করবেন। ঘুষ-দুনীতি আল্লাহর ওয়াস্তে মাক করেন আমাদের। মেহেরবানি করে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেন। এই জমি পবিত্র জমি, এই জমির এমন কোনও জায়গা নাই যেখানে আমার দেশের মা-বোনের রক্ত নাই, এই জমির এমন কোনও মহকুমা নাই যেখানে আমার দেশের মা-বোনের কবর নাই, এই জমির এমন কোন নদী নাই যেখানে আমার দেশের ছেলের লাশ ভাসে নাই। তাদের কথা মনে করে, তাদের আত্মার কথা মনে করে, তাদের রক্তের কথা মনে করে, আমি আমার জনগণকে, আমি সরকারি কর্মচারীকে, আমি ব্যবসায়ীকে, আমি শ্ৰমিককে, আমি কৃষককে, জাতির কাছে আবেদন জানাই – দেশের গড়ার কাজে ব্রত হন। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। দেশের মানুষ আজ দুঃখি, দেশের মানুষ আজ না খাওয়া, আজ ঘরে ঘরে গৃহহারা, সর্বহারার আর্তনাদ। আজ গ্রামে-গ্রামে আমি দেখি মানুষের ঘর-বাড়ি নাই। তিন মাস পরে বর্ষা আসবে। আমার মানুষ কোথায় থাকবে আমি চিন্তা করে ঘুমাতে পারি না। আমি আপনাদের কাছে চাই, যার ঘর আছে তার পাশের বাড়িতে ঘর দিয়ে সাহায্য করেন, যার খাবার আছে তারা অন্যকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন। এটা হলো মনুষ্যত্বের প্রধান লক্ষণ। আমার জয় বাংলা ভূলুণ্ঠিত হবে না। যেন বাংলার মানুষের জয় হয়। বাংলার মানুষ সুখী হয়। বাংলার মানুষ শোষণহীন সমাজ গড়তে পারে। সমাজতন্ত্র আমি করবো। সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে হবে। শোষণহীন সমাজ বাংলাদেশে হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করেছি এবং আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি জানি বাংলার মানুষ আমাকে ভালোবাসে, আমিও চাই বাংলার মানুষকে ভালোবাসি। আমি চাই বাংলার মাটিকে আমি ভালোবাসি, বাংলা মাটিও আমাকে ভালবাসে। না হলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে পারতাম না। আমার মনে হয় এই দেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া আর এই মাটির টানে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে যেখানে আমাকে কবর খোড়া হয়েছিল তার পাশ থেকে আমি এইখানে আসতে পারতাম না। এই মাটিকে আমি ভালোবাসি। (জনতার করতালি।) আমি চাই আমার বাংলার মানুষ বাঁচুক, আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক, আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক। আমার বাংলার মানুষেরা মিথ্যাবাদী না হোক, আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক, আমার বাংলার মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করুক। লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে আমার দেশে। চাকরির বন্দোবস্ত আমি করতে পারছি না। ভায়েরা আমার, চাকরির বন্দোবস্ত করতে হলে কল- কারখানা করতে হবে। সরকারি চাকরিতে এত চাকরি পায় না। আমি কুটির শিল্পের দিকে নজর দেবার চাই। আমি গ্রাম্য ভিত্তিতে আমি আমার অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চাই। শহরভিত্তিক অর্থনীতি গড়তে চাইনা। এবং এখানে নীচের থেকে আরম্ভ হবে বাংলার উন্নতি – শহর থেকে নীচের দিকে যাবেনা। এইটা করতে হলে সকলের সাহায্য-সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি আপনাদের কাছে, আপনারা জানেন- যে দেশে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে সে দেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি, আমার সহকর্মীরা যারা আমার আদেশ চালিয়েছেন তারা হত্যাকাণ্ড চালাবার দেন নাই। আমি তা চাই না। নির্দয়, নিরাপরাধ মানুষ মরুক আমি চাই না। তার মানে এই না যে আমাদের দুর্বলতা আছে। আমাদের দুর্বলতা নাই। কাজ করেন, মন প্রাণ দিয়ে কাজ করেন। পয়সা খাওয়া ছেড়ে দেন। লোভ ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী ভাইরা, আবার বলে দিছি সাত দিন সময়, ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্সি, তেলের এজেন্সি, সাবান এজেন্সি, সিগারেটের এজেন্সি (অস্পষ্ট) আমি দশ দিন পরে ক্যানসেল করিয়া দিব। (জনতার করতালি।) যদি তাও না করেন, আপনারা তো জানেন, আমি মুজিবুর রহমান যেটা বলি সেটা করবার চেষ্টা করি।
এহিয়া খান আমারে কত তেলাইছে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য, ও প্রধানমন্ত্রী-টধানমন্ত্রী আমি হবার চাই নাই আপনারা জানেন। আমি মরতে গিয়েছি কিন্তু বাংলার সঙ্গে বেইমানি করি নাই। (জনতার করতালি)। আর এখনো বলতেছি আমি মরতে পারি, আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে বেইমানি করতে পারবো না। তাই আপনাদের কাছে আমার কথা অনুরোধ, আপনারা সংঘবদ্ধ হয়ে থাকেন। একজন লোক বলেছে – এটা হলো না, ওটা হলো না, ওটা হলো না, এটা হলো না, এটা হল না – তাদের কোথেকে নিয়ে আইছে এ? যুদ্ধের সময় তো চেহারা মুখ কিচ্ছু দেহি নাই – আন্দোলনের সময় দেখি নাই – করার মধ্যে এহিয়ার দালালী করছো – চোর – চোরাচালানি করছ – এখন চুপি চুপি করে বল এটা হলনা – ওটা হলনা। আড়াই মাসে কি তোমার বাড়িতে … (অস্পষ্ট)। কিচ্ছু দেবার পারবো না আমি বলেছি। কিচ্ছু আমার কাছে নাই। আমি দুনিয়ার কাছে ভিক্ষা করে আনতেছি। ভারতবর্ষ আমাকে সাহায্য না করলে গভার্মেন্ট চালাতে পারতাম না। একদল লোক আমার কটাক্ষ করার চেষ্টা করছেন। আমি সাবধান করে দেবার চাই, ভারতের সাথে আমার বন্ধুত্ব পুরা পোক্ত রয়েছে – আমি স্বাধীন দেশ – ভারতবর্ষ স্বাধীন দেশ – স্বাধীন দেশের বন্ধুত্ব – এর মধ্যে কোন গোলমাল- ঠোলমাল নাই। (জনতার করতালি।) আমার স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, আমি ভারতের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবো না। কিন্তু যারা আমার বন্ধুত্ব হটায় দেবার চেষ্টা করবেন, তারা মনে রাখবেন যে তারা জানেন না আমি হাত লাগাই না – একবার হাত লাগাইলে আমি কোনদিন পিছাই না। এটা এহিয়া খান জানে, আইয়ুব খানও জানে, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী জানে, নুরুল আমিনও জানে – দুনিয়ার সব জানে – সব মিয়াঁর আমলেই আমার কিসমতে কিছু লোকজন ফেলা হয়েছে। কিন্তু আমি ছাড়ি নাই। তাই বন্ধুগণ আপনাদের কাছে আমার আবেদন যে আপনারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। যা পারছি করছি, আমি মিথ্যা ধোঁকা দেবার পারবো না। তিন বৎসর, ধরেন তিন বৎসর যদি যুদ্ধ চলত আপনারা কী করতেন? যুদ্ধ করতেন না? (জনতা সমস্বরে – ‘হ্যাঁ’)। আপনারা না খেয়ে যুদ্ধ করতেন না? (জনতা সমস্বরে – ‘হ্যাঁ’)। ধরেন তিন বৎসর আরও যুদ্ধ করতে হবে। এ হল যা ধ্বংস করে গেছে সেই ধ্বংসটাকে ঠিক করে করতে আবার দশ বৎসর সময় লাগত। কিন্তু আমি মনে করি ইনশাল্লাহ তিন বৎসরের মধ্যে পারবো। (জনতার করতালি।) কিন্তু আপনাদের কাজ করতে হবে। একলা কেউ কিছু করতে পারেনা। তা আপনারা – আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা দোয়া করবেন। যে ভালোবাসা আপনারা আমাকে দিয়েছেন, আমার জীবনে যেন এটাই আমার জীবনে পাথেয় হয়ে থাকে। এর চেয়ে আর বেশি আপনাদের কাছে চাই না। আর আপনারা কাজ করে যান, ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা আবার হাসবে এ বিশ্বাস আমার আছে। যদি শোষণহীন সমাজ গড়তে পারি। তাতে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের কাছে আমার আরেকটা অনুরোধ হলো যে দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করতে রাজি আছেন কিনা? (জনতা সমস্বরে – ‘আছি’।) দুর্নীতি আর ঘুস, রাজি আছেন? (জনতা সমস্বরে – ‘আছি’।) হ্যাঁ।
খোদা হাফেজ।
জয় বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা’।)
জয় বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা’।)
জয় বাংলা। (জনতা সমস্বরে – ‘জয় বাংলা’।)
Reference:
বঙ্গবন্ধুর অডিও ভাষণ, পিপলস ভয়েস, প্রকাশনা – শেকড় সন্ধান
বঙ্গবন্ধুর ভাষণসমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক