You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.05 | স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন

আজ শনিবার পাঁচই জুন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আসবেন কলকাতায়। কি দেখবেন তিনি? গীমান্তে নেই তিল ধারণের স্থান। কলকাতার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছেছে শরণার্থীর ঢেউ। পাক লুঠেরা রাস্তায় কেড়ে নিয়েছে তাদের সর্বস্ব। প্রাণে মরেছে অনেকে। নিখোঁজ হয়েছে স্ত্রী-কণ্যা। এপারে এসেও স্বস্তি নেই। মহামারীরূপে দেখা দিয়েছে কলেরা। রাজ্য সরকার দিশাহারা। শরণার্থীর সংখ্যা চর লক্ষ ছাপিয়ে উঠেছে। অন্যান্য রাজ্যে না পাঠালে বাঁচবে না এই হতভাগ্যের দল। দু’মাস অপেক্ষা করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। কি পেয়েছেন তাঁরা? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের চরম ঔদাসীন্য এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের অসহনীয় নীরবতা। ইয়াহিয়া আগের চেয়ে বেশী বেপরােয়া। বাংলাদেশে জ্বালাচ্ছেন তিনি সাম্প্রদায়িকতার আগুন। পুড়ছে অনেকে। যারা কোনমতে বেঁচেছে তারা আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। যত দিন যাবে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। ওদের ফেরার পথ বন্ধ। বন্দুক উঁচিয়ে আছে ইয়াহিয়ার বাহিনী। তাদের ইন্ধন জোগাচ্ছে স্থানীয় ধর্মান্ধের দল। গােড়ার দিকে বাংলাদেশ সরকারকে যদি স্বীকৃতি দিতেন নয়াদিল্লী তবে ঘটত না অবস্থার এমনিতর অবনতি। মুক্তিযােদ্ধারা পেতেন দ্বিগুণ মানসিক বল। বাড়ত সংগ্রামের তীব্রতা। গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠত প্রতিরােধ ব্যুহ। সাম্প্রদায়িক নেতাদের মধ্যে দেখা দিত সন্ত্রাস। কমত লুঠপাটের ব্যাপকতা। বিপুল সংখ্যায় শরণার্থীরা হয়ত ভিড় করত না। ভারতের সীমান্ত অঞ্চলগুলােতে। কেন্দ্রীয় সরকারের ‘দেখি কি হয় নীতি’ এনেছে নৈরাশ্য। বারিয়েছে ইয়াহিয়ার স্পর্ধা এবং ভারতকে নিয়েছে আর্থিক সঙ্কটের মুখে।
বন্ধ হবে না শরণার্থীর স্রোত। পূর্ব বাংলায় থাকতে পারবে না অসাম্প্রদায়িক সাধারণ মানুষ। কিসের আশায় দিন গুণছেন প্রধানমন্ত্রী? বৃহৎ শক্তিগুলাে কি লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাত ধরে তাদের নিজেদের বাড়ী-ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসবে? তারা কি এদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি দেবে? আর্থিক চাপে ইয়াহিয়র নাকে খত আদায় করবে? গত দু’মাসের আন্তর্জাতিক প্রতিকিয়ায় তিনি কি বুঝতে পারেন নি জল কোথায় গড়াচ্ছে? জিইয়ে রাখবে তার ইসলামাবাদকে। শক্তিসাম্য ভাঙতে দেবে না। এশিয়ার এ অঞ্চলে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তব। অখণ্ড পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটেছে। পূব এবং পশ্চিমের বােঝাপড়া অসম্ভব। স্বাধীন বাংলাদেশ ছাড়া শরণার্থীরা ফিরতে পারবে না। নিজেদের বাড়ী-ঘরে। এই সহজ সত্য মেনে নিতে কর্তৃপক্ষের দ্বিধাগ্রস্ত মনােভাবই সৃষ্টি করছে যত জটিলতা। শ্রীমতী গান্ধী আশায় আশায় অনর্থক সময় কাটাচ্ছেন। এখন যে অবস্থা চলছে তার ব্যাতিক্রম না ঘটলে ছ’মাসে কেন, ছ’বছরেও শরণার্থীরা ছাড়বেন না ভারতের মাটি। পূর্ব বাংলায় শক্তি সংহত করবেন ইসলামাবাদ। মুক্তিসংগ্রামীরা পাবেন প্রচণ্ড বাধা। আর ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর বােঝা নিয়ে ভারত খাবে হাবুডুবু। সমূহ বিপদ সামনে দেখেও মন স্থির করতে পারছেন না কেন্দ্রীয় সরকার। গােটা জাতিকে কোন অন্ধকার গুহায় টেনে নিচ্ছেন তারা।
বিভিন্ন রাজ্যে শরণার্থীদের অবিলম্বে সরিয়ে দেওয়া খুবই দরকার—সন্দেহ নেই। এ ব্যবস্থা অবশ্যই সাময়িক। তাতে পাওয়া যাবে না সমস্যার স্থায়ী সমাধান। গোঁজামিল দিয়ে সময় কাটাবার পালা শেষ হয়েছে। দেশবাসীর ধৈর্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জবাব দিন নয়াদিল্লী—শরণার্থীদের নিয়ে তারা কি করবেন? কি করে থামাবেন বন্যার স্রোত? কিভাবে পাঠাবেন তাদের বাংলাদেশে? বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের কাছে। নয়াদিল্লীর আকুতি-মিনতি ব্যর্থ। প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত পত্রে এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় যাদের টনক নড়ে নি পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিংহের সম্ভাব্য সফরে তাদের ঘুমের নেশা কাটবে না। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বুকে ধরে অনন্তকাল বসে থাকতে পারে না ভারত। নিরাপত্তা এবং বাঁচার তাগিদেই কেন্দ্রীয় সরকারকে নিতে হবে। নিজস্ব পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার প্রাথমিক অঙ্গ—স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান। বাড়ান দরকার তাদের সংগ্রামী শক্তি। ওদের জয় ত্বরান্বিত হলেই স্বদেশে ফিরবেন শরণার্থীরা। নইলে তারা থাকবেন ভারতে। একথা সত্য, কোন শান্তিবাদী রাষ্ট্র সহজে বলপ্রয়ােগ করতে চায় না। ইয়াহিয়া খান নয়াদিল্লীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর নির্ভর করছেন না। বাংলাদেশের সমস্যার সঙ্গে অশান্তির দুর্লক্ষণ। মুখ। বুজে থাকলেই বিপদ এড়ান যাবে না। বাস্তব অবস্থার মােকাবিল করুন কর্তৃপক্ষ। অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন স্বাধীন বাংলাদেশকে। প্রশস্ত করুন ইয়াহিয়ার চরম পরাজয়ের পথ। এতেই আসবে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ শান্তি। শরণার্থীরা পাবেন স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের প্রেরণা।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৫ জুন ১৯৭১