You dont have javascript enabled! Please enable it!

আকাশ পথে দৌরাত্ম

পাকিস্তানের গত সাধারণ নির্বাচনে যখন সেখানকার জনসাধারণ জঙ্গি শাসনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছে এবং গণতান্ত্রিক শক্তির এই জয় যখন পাক-ভারত সম্পর্কের উন্নতির পূর্বাভাস দিচ্ছে তখন কাশ্মীর ও জম্মু নিয়ে পাকিস্তানের একটি দুষ্ট চক্র শুরু করেছে অন্তর্ঘাতী কাজ। শ্রীনগর থেকে জম্মুগামী একটি ভারতীয় বিমানকে ছিনতাই-এর কায়দায় লাহােরে নিয়ে যাওয়া এই ষড়যন্ত্রকারীদের স্বরূপ প্রকাশ করে দিয়েছে। যে দু’জন এই বিমান ছিনতাই-এর পাণ্ডা তাদের একজন সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সাব-ইনসপেক্টর। তার নাম মহম্মদ কোরেশী নিজের নাম গােপন করে মহম্মদ হুসেন ছদ্মনামে সে বিমানে আরােহণ করে। সুতরাং সীমান্ত রক্ষী বাহিনীতে থেকে সে যে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীদের গুপ্তচর হিসেবে কাজ করছিল এ বিষয়ে সন্দেহ নেই।
পাকিস্তানের ‘আল ফতেহ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এ ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে কাশ্মীর সরকার যথাসময়ে সতর্ক হয়ে যান সরকারের কাছে এমন খবরও আসে যে কাশ্মীর গণভােট ফ্রন্টের সঙ্গে ‘আল ফতেহ’ দলের যােগাযােগ আছে। এর ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেবার জন্য কাশ্মীর সরকার শেখ আবদুল্লাহ এবং গণভােট ফ্রন্টের সভাপতি ও সম্পাদক মীর্জা আফজল বেগ এবং জি এম শাহকে কাশ্মীর থেকে বহিষ্কার করেন ও গণভােট ফ্রন্টের প্রায় তিনশত জনকে আটক করে রাখেন। এ করেও ষড়যন্ত্রের মূলােৎপাটন করা যায় না। ভারতস্থিত পাক হাইকমিশনের প্রথম সচিব জাফর ইকবাল রাঠোরের সঙ্গে ‘আল ফতেহ’ দলের যােগাযােগ আছে বলে ভারত সরকার অবগত হন এবং ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ভারত ত্যাগের আদেশ দেন। পালটা জবাব হিসেবে পাক সরকারও পাকিস্তানস্থিত ভারতীয় হাইকমিশনের প্রথম সচিব শ্রী বি যােশীকে ‘অবাঞ্ছিত’ জন বিবেচনায় ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগ করতে বলেন।
পাক-ভারত সম্পর্ককে আরাে তিক্ত করে তােলার জন্য এই যে, একটি গােষ্ঠীর ষড়যন্ত্র এর দ্বারা এই উপ-মহাদেশের কোনাে অংশেরই কল্যাণ হবার নয়। পাকিস্তানের পূর্বাংশে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ যে নীতির ওপর দাঁড়িয়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিকে কবর দিয়েছে সেই নীতি তিক্ততা দূর করে ভারত ও পাকিস্তানের মৈত্রী স্থাপনে প্রতিশ্রুত। পশ্চিম পাকিস্তানে অবশ্য পিপলস পার্টির নায়ক জুলফিকার আলি ভুট্টো ভারত বিরােধী জেহাদী জিগির ছাড়েন নি এবং কাশ্মীরকে রাজনীতির দাবাখেলার ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করার অসদাভিপ্রায়ও তার আছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের চলার সাধ্য নেই। তা করতে গেলে গােটা পাকিস্তানের জাতীয় সমস্যা দেখা দেবে আর খণ্ডিত পাকিস্তান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্ত নের জনসাধারণও নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট হবে না। সুতরাং ভুট্টো সাহেবের যত ওজর আপত্তি থাক শেষ পর্যন্ত মুজিবর সাহেবের সঙ্গে একটি রফায় তাকে আসতেই হবে আর মুজিবর সাহেবের হাতে পাকিস্তানের শাসনভার পড়লে পাক-ভারত মৈত্রীর পথে কাশ্মীরকে অন্তরায় করে তিনি তুলবেন না বলেই মনে হয়।
সুতরাং পরিবর্তিত অবস্থায় কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ বাধার সম্ভাবনা পূর্বের তুলনায় অনেকখানি কম। পাকিস্তানের যে গােষ্ঠী কাশ্মীরে অন্তর্ঘাতের জন্য ব্যস্ত তারা যেমন স্বরাষ্ট্রের বাস্তব অবস্থাকে অস্বীকার করে জাতীয় স্বার্থের অবনতি ঘটাচ্ছে তেমনি কাশ্মীরে গণভােটের ধুয়া তুলে যারা সেই ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যােগাচ্ছে তারাও ভারতের জাতীয় স্বার্থের মূলে কুঠারাঘাত করছে। যাদের জাতীয় স্বার্থবােধ নেই তারাই এর মধ্যে রাজনৈতিক অভিসন্ধি খুঁজে বেড়ায়। কাশ্মীর থেকে শেখ আবদুল্লা ও গণভােট ফ্রন্টের নেতৃদ্বয়কে বহিষ্কৃত করায় এবং গণভােট ফ্রন্ট অবৈধ ঘােষিত হওয়ায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও এস এস পি ব্যঙ্গাত্মক ভাষায় মন্তব্য করেছিল, নির্বাচনে জেতার জন্য ইন্দিরা সরকারের এটাও একটি রাজনৈতিক চাল। এটা যে চাল নয়, বাস্তব ঘটনা, পাক গুপ্তচরদের তারা বিমান ছিনতাই-ই তাে স্পষ্টরূপে তা প্রমাণ করে দিল।
ইন্দিরার সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলতে হবে তাই ভালাে কাজ করলেও তার মধ্যে একটা অভিসন্ধি খুঁজে বার না করলে চলে কেমন করে! একেই বলে যে-যারে দেখতে নারি তার চলন বাঁকা।
জনসংঘওয়ালারা হয়তাে এর মধ্যে পাক সরকারের একটি ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলতে পারেন। কিন্তু পাক সরকার বিমানযাত্রীদের ও বিমান চালকদের নিরাপত্তার ও তাদের নিরাপদে স্বদেশে ফিরিয়ে দেবার যেরূপ ব্যবস্থা করেছেন তাতে তাদের সততায় সন্দেহ করার কোনাে অবকাশ নেই। পাক-ভারত সম্পর্ক তিক্ততর করার জন্যে এই দৌরাত্ম একটি প্ররােচক গােষ্ঠীর। পাক সরকারের উচিত এদের খুঁজে বের করে শায়েস্তা করা। আর ভারত সরকারের কর্তব্য এরূপ ঘটনা যাতে আর না ঘটতে পারে তার জন্যে সর্বতােভাবে সতর্ক হওয়া।

সূত্র: কালান্তর
০১.০২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!