You dont have javascript enabled! Please enable it!

আওয়ামী লীগ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা
বৈরাম খা লস্কর

গত ছয়ই আগস্ট দর্পণে প্রকাশিত আমার বক্তব্যের জবাবে বীরভূমের জনৈক রবিউল কামাল যে বক্তব্য পেশ করেছেন (বিশে আগস্টের দর্পণ) তা কিন্তু আমার বক্তব্যকেই প্রমাণ করছে। কামাল সাহেব লিখেছেন এবং এটা ঘটনাও যে সাতই মার্চ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বললেন, “তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে তৈরি হও, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়।’ আর আমিও বলেছি যে, আগাগােড়া গান্ধীপন্থার ভড়ং দেখিয়ে শান্তিজল ছিটিয়ে শেষ সময়ে আচমকা সশস্ত্র লড়াইয়ের ডাক দিয়ে অসংগঠিত নিরস্ত্র জনতাকে হঠকারিতার সঙ্গে সশস্ত্র ফৌজের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে…।’ সাতই মার্চের আগে পর্যন্ত ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ার চিন্তা মুজিবুর রহমানের তার বুর্জোয়া উগ্র জাতীয়তাবাদী পার্টি আওয়ামী লীগের ছিল না। মুজিবুর রহমান অত্যন্ত স্পষ্টভাবেই ‘অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন এবং জনগণ যাতে শত প্ররােচনাতেও হিংসার পথে পা না বাড়ায় সে জন্য মুজিবর রহমান বারংবার উদ্বেগাকুল আবেদন প্রচার করেছেন। কামাল সাহেব নিজেই জানাচ্ছেন যে, পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তানি জঙ্গি বাহিনী বাংলাদেশের জনগণকে আচমকা আক্রমণ করেছে— এ সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরই মুক্তিবাহিনী গঠন করা হতে থাকে। আমারও সেই একই বক্তব্য যে আক্রান্ত হবার আগে আত্মরক্ষা বা পাল্টা আঘাতের কোনাে পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না। না কামাল সাহেব ‘আক্রান্ত হওয়াই অপরাধ নয়, আক্রান্ত হতে দেয়া আপনার ভাষায় ‘আচমকা আক্রমণ করতে দেয়া আমার আপনার মিশ্র বক্তব্য অনুযায়ী ‘অসংগঠিত নিরস্ত্র জনতাকে আচমকা আক্রমণের মুখে ঠেলে দেয়াটাই হঠকারিতা বা অপরাধ এবং জঘন্যতম অপরাধ।
আমার বক্তব্যে রিক্রুটিং বলতে আমি পশ্চিমবঙ্গে যেসব রিক্রুটিং সেন্টার খােলা হয়েছে সেগুলাের কথাই বলেছি। আমি ক্যাম্পওয়ারি রিকুট শিকারদের তালিকা পেশ করতে প্রস্তুত আছি যারা দলীয় নােংরা রাজনীতির জন্য সেই সময় মুক্তি বাহিনীতে যােগদান করতে পারেনি। অতি সম্প্রতি সাপ্তাহিক পিপলস ডেমােক্রেসি (হাতের কাছে সংখ্যাটি না থাকায় তারিখটা দিতে পারলাম না) পত্রিকায় শরণার্থী শিবিরে উপদেষ্টা নিয়ােগ সংক্রান্ত ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উচ্চতম আমলাদের সঙ্গে কিছু গােপনীয় পত্র বিনিময়ের ফটোস্ট্যাট কপিসহ চাঞ্চল্যকর সংবাদ বেরিয়েছে। আওয়ামী লীগ এ দেশের প্রতিক্রিয়াশীলদের ও শােধনবাদীদের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে শিবিরগুলাের ওপর রিক্রুটমেন্টের ওপর যে নিরন্ত্রণ রাখতে চায় তা ঐ তথ্য থেকে দিবালােকের মতাে স্পষ্ট। কারণ আওয়ামী লীগ মনেপ্রাণে আপােসপন্থীবিপ্লবী গণমুক্তি সংগ্রামের পথে এ লড়াই যাক এটা তার কাম্য নয়। মুজিবুর-ইন্দিরা ভাই বােন’- এই স্লোগান নিতান্ত আবেগ প্রসূত নয় বরং গভীর অর্থবহ।
পূর্ববঙ্গের গণমুক্তি সংগ্রামের প্রতি আমার মনােভাব বিদিষ্ট নয়, কারণ আমিও একজন সংগ্রামী। আমার বক্তব্য যে, মুজিবনগরে যে স্বাধীন বাংলা সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করলেন, সেখানে কোনাে ধর্মশাস্ত্রই পাঠ করা উচিত নয়, তবুও দেখলাম, পাঠ হলাে এবং কেবলমাত্র কুরআন শরীফ, অন্যান্য ধর্মমতকে সেখানে অগ্রাহ্য করা হলাে অর্থাৎ সােশাল ডেমােক্রেটরা, যে সেকুলারিজমের কথা বলেন, আওয়ামী লীগের তাতে বেশ কুণ্ঠা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়মিত শােনার অবকাশ নেই, লড়াইয়ের জীবনে তবুও প্রায়ই যা শুনি তাতে দেখি শুরু হয় ‘আসসালামু আলাইকুম’ (বঙ্গ সংস্কৃতির কোনাে অঙ্গ জানি , জানি না এটা কেমন বাংলাভাষা), কখনাে শুনি ‘আল্লাহ রাব্বল আলামিন বলেছেন’ ইত্যাদি (এসব ধর্মীয় প্রচারের উদ্দেশ্য আমার অজ্ঞাত), কখনাে কখনাে গ্রাম-বাংলার মানুষের জন্য অনুষ্ঠান ‘সােনার বাংলা’ যাতে কোনােদিনই কোনাে অমুসলমান চরিত্রের নাম শুনিনি (হয়তাে ওদের সােনার বাংলার সােনারা কেউ অমুসলমান নয়)। যাই হােক মাঝে মাঝে গীতা বা ত্রিপিটক বা বাইবেল পাঠ করে তীব্র ঐশ্লামিক অন্ধতা (যা ইয়াহিয়ারও ডােজ) যদি ডায়েলুট করার চেষ্টা হয় কামাল সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী তবে নিশ্চয়ই তা মন্দের ভালাে। কিন্তু কামাল সাহেব বাংলাদেশের অস্থায়ী মন্ত্রিসভাতে একজনও অমুসলমান কেন নেই তার জবাব দিতে আপনি পারেন নি। যদিও অন্তত পনেরাে-বিশ জন অমুসলমান এম এল এ, এম পি ও ছিলেন আওয়ামী লীগে নয় কি?
কামাল সাহেব আবার সিংহলের প্রসঙ্গ আনলেন কেন? আওয়ামী লীগ বা তার মন্ত্রীরা আজ অবধি সিংহলের গণহত্যা সম্পর্কে কিছু বলেছেন বলে মনে পড়ছে না।
ভাষাভিত্তিক প্রাদেশিক যে দাঙ্গার কথা আমি বলেছি কামাল সাহেব তা বেশ আবেগের সঙ্গেই সমর্থন করেছেন ন্যায়সংগ্রামের নামে, অন্ধ জাতীয়তাবাদের চশমা পরে। উর্দুভাষী লােকেরা’- এই বন্ধনীর মধ্যে উর্দুভাষী জনতার কথা। শ্রমিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার এবং শােষণ বিরােধী সংগ্রামের অংশীদার হিসেবে যদি জাতি-ধর্ম-ভাষা নির্বিশেষে সকল মেহনতি মানুষকে একটি পতাকার তলে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারা যায়, তবে তার জন্য দায়ী নেতৃত্ব ও তার নীতি-মেহনতি জনতা নয়। শােষক শ্ৰেণী ভাষাকেও যে ধ শােষণের হাতিয়ারূপে ব্যবহার করে থাকে, এই ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে যে আওয়ামী লীগের ঝানু নেতারা অচেতন ছিলেন তা মােটেই নয়, বরং তারা অত্যন্ত সচেতনভাবেই বাংলাভাষা তথা উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদকে তাদের রাজনীতির মূলধন করেছিলেন। কাজেই অবাংলাভাষী দরিদ্র মানুষরাও তাদের দৃষ্টিতে শত্রু হয়েছিল- আরাে স্পষ্ট করে বলা যায়, তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই অবাংলাভাষী মেহনতি মানুষকে শােষক শ্রেণীর অপর ক্যাম্পে ঠেলে দিয়েছিলেন। কামাল সাহেব তাে এখন পশ্চিম বাংলায় বসে আছেন ভালােভাবে চোখ খুলে সে দেশের রাজনৈতিক সংগ্রামকে দেখলেই দেখতে পাবেন হিন্দু-মুসলমান বাঙালিঅবাঙালি নেপালি সাঁওতাল সকল জন বা ধর্ম ভাষা গােষ্ঠীর শ্রমজীবী মানুষ কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াই করছেন। কামাল সাহেব উর্দুভাষী জনতাকে এক কথায় শাসক শ্রেণীর তাঁবেদার বানিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছেন এবং এই তাঁবেদারির পেছনে ‘বন্দুকের নলে’র তত্ত্বকে লাগান নি। এবার আমি সবিনয়ে কামাল সাহেবকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে পারি কি?
(এক) মহাবিপ্লবী মুজিবর রহমানের পার্টি আওয়ামী লীগের নেত্রী বেগম বদরুন্নেছা আহমেদ এম এল এ প্রমুখ বেশ কিছু নেতার সিট বাতিল নয় বলে ঢাকা বেতার ঘােষণা করেছে অনেকদিন ধরে বেগম সাহেবা ইয়াহিয়ার বন্দুকের নল থেকে নিরাপদ দূরত্বে থেকেও আজ পর্যন্ত তার প্রতিবাদ করছেন না কেন?
(দুই) খােদ মুজিবুর রহমানের আসনই বা বাতিল ঘােষিত নয় কেন? একনম্বর প্রধান দেশদ্রোহী’ হওয়া সত্ত্বেও?
(তিন) আওয়ামী লীগের কয়েকজন বিপ্লবী (যথা ওবাইদুল্লা সরকার, সামসুল হক) ইয়াহিয়ার পুতুল মন্ত্রিসভায় স্বেচ্ছায় যােগ দিলেন কেন? এবং আওয়ামী লীগ তাদেরকে আজো দল থেকে বহিষ্কার করেনি কেন?
(চার) মুজিবুর রহমানকে ইয়াহিয়া খা শেষ করেন নি বা করছেন না কেন? মুজিবুর নাকি পাকিস্তানের পয়লা নম্বর দুশমন, কাফের হিন্দুস্তানের চর আর মুজিবুর গ্রেপ্তার হবার তিন চারদিন পর পর্যন্তও তার হদিস ছিল অজ্ঞাত (অন্তত দেশবাসীর কাছে)। কয়েক লক্ষ নিরাপরাধ নিরস্ত্র অসহায় নাগরিককে খুন করতে যার হাত কাঁপে না, বিশ্ববিবেক, আন্তর্জাতিক মতামতের ধার ধারতে হয় না সে তার প্রধান দুশমনকে জিইয়ে রেখেছে কেন? বিশ্ব জনমতের চাপের ভয়ে অথবা দরকষাকষির সুবিধার জন্য? লুমুম্বা প্রমুখ বহু নেতাকে সবকিছু উপেক্ষা করে হত্যা করতে তাে সাম্রাজ্যবাদী ও তার অনুচরদের বাঁধে নি! ইয়াহিয়ার এবারের বেতার ভাষণে আওয়ামী লীগ বা মুজিবুর বিরােধী কোনাে তিক্ত কথা নেই কেন?
মুজিবুর রহমান কি মনেপ্রাণে কমিউনিস্ট বিদ্বেষী নন? তিনি কি বলেননি যে পাক ভারত উপমহাদেশের এই অংশে একমাত্র তিনিই কমিউনিজমকে রুখতে পারতেন? মুজিবুর রহমান কি ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে নিয়মিত ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রেখে চলছিলেন না? মার্কিন দূত মি. ফারল্যান্ড কি প্রথমাবস্থায় মুজিবরকে সাহস ও মদদ দেয়নি?
শােষক শ্রেণীর ক্ষমতার উৎস চিরকালই বন্দুকের নল, কারণ রাষ্ট্র হচ্ছে এক শ্রেণী কর্তৃক অপর শ্ৰেণীকে বলপূর্বক শাসনে রাখার ও শােষণ করার যন্ত্র। তাই শ্রমিক শ্রেণীর জনশক্তির ও ক্ষমতার উৎস কাজে কাজেই বন্দুকের নল। তবে এক ক্ষেত্রে বন্দুক নিয়ন্ত্রণ করে চালককে আর অপর ক্ষেত্রে চালক নিয়ন্ত্রণ করে বন্দুককে।
তবে একটা কথা কি জানেন, ঐ যে জনশক্তির কথা বলেছেন ঐ জনশক্তিটা আসমান থেকে আসে না। জনতাকে রাজনীতি, রণনীতি, রণকৌশল ও অস্ত্র দিয়ে বহুদিন ধরে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সংগঠিত করতে হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যারা সংগ্রাম করছে তারা আওয়ামী লীগের মুরােদ ও উদ্দেশ্য বুঝে গিয়েছে, তারা তাদের নিজেদের কায়দায় নতুন করে সংগঠিত হয়ে গণমুক্তি ফৌজ গঠনের পথে এগিয়ে চলেছে। এই ফৌজ জানবেন একাধারে ইয়াহিয়া ও আওয়ামী লীগ উভয়েরই শত্রু। আমরা জনতার সঙ্গে আছি ও থাকব। আওয়ামী লীগ তার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াশীল বন্দুকের সহযােগিতায় পশ্চিমী খান সেনা তাড়াবার নাম করে যাতে আবার বাংলার মেহনতি মানুষের মুক্তি সংগ্রামকে আক্রমণ করতে না পারে সে সম্পর্কে আমরা সচেতন এবং জনতাকেও সচেতন করেছি।

দর্পণ ২৯.১০.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!