You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.06 | আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা- বৈরাম খাঁ লস্কর | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

আওয়ামী লীগ সম্পর্কে কয়েকটি কথা
বৈরাম খাঁ লস্কর

আওয়ামী লীগ কি পাকিস্তানি ফৌজের বিরুদ্ধে জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে? এককথায় জবাব, না, বরং বিভ্রান্ত ও খণ্ড খণ্ড করেছে। আওয়ামী লীগ কী কী শয়তানি করেছে তার একটা ফিরিস্তি দেয়া গেল :
(এক) আগাগােড়া গান্ধীপন্থার ভড়ং দেখিয়ে শান্তিজল ছিটিয়ে শেষ সময়ে আচমকা সশস্ত্র লড়াইয়ের ডাক দিয়ে অসংগঠিত নিরস্ত্র জনতাকে হঠকারিতার সঙ্গে সশস্ত্র ফৌজের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে শােচনীয় মৃত্যুর মুখে।
(দুই) তখতে দখল কায়েম করে রাখার জন্য মুক্তি সংগ্রামের স্বার্থে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট গঠন না করে সাততাড়াতাড়ি কেবলমাত্র নিজ দলের লােকজন নিয়ে বাংলাদেশ সরকার গঠন করলেন।
(তিন) মুক্তি বাহিনীতে রিক্রুটিংয়ের ক্ষেত্রে নােংরা দলীয় রাজনীতির প্রকাশ দেখা যায়। আওয়ামী লীগ সমর্থক ছাড়া রিক্রুটমেন্ট হওয়া শক্ত।
(চার) নির্লজ্জের মতাে ও বেইমানের মতাে সংগ্রামরত অন্যান্য পার্টির অবদান অস্বীকার।
(পাঁচ) মন্ত্রিসভা গঠন, শপথ গ্রহণ ও বেতার প্রচারে সাম্প্রদায়িক ও প্রাদেশিক বিদ্বেষ সুস্পষ্ট। ইসলাম ছাড়া অন্য কোনাে ধর্মের প্রসঙ্গ ঐসব ব্যাপারে ছিল না বা নেই।
(ছয়) নগ্নভাবে আওয়ামী লীগ নেতারা এমন সব দেশের সাহায্য নিচ্ছেন ও চাচ্ছেন যারা নিজ নিজ দেশ গরিব জনতার স্বাধীনতা হরণ করেছে ও তাদের ওপর স্বদেশী মিলিটারি দিয়ে ইয়াহিয়ার মতােই অত্যাচার চালাচ্ছে।
এসবই অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ আওয়ামী লীগ আসলে কায়েমী স্বার্থের লীগ- জনদরদের সুগার কোচিং দেয়া। দুটি প্রদেশের মধ্যেকার অর্থনৈতিক ও সমাজসাংস্কৃতিক বৈষম্য পূর্বপাকিস্তানের জনগণের মনে যে বিদ্বেষ ও ক্রোধ সঞ্চিত করেছিল তাকে আওয়ামী লীগ সুকৌশলে নিজেদের গদি দখলের স্বার্থে চ্যানেলাইজ করতে পেরেছিল মাত্র। নির্বাচনী কর্মসূচি যা বহুপ্রচারিত ছয় দফা কর্মসূচি’ নামে পরিচিত তা আসলে একটি বিরাট ভাওতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সেখানে কিছু বাগবিভূতি ছড়ান যা দিয়ে শােষিত পাকিস্তানের বা পূর্ববঙ্গের গরিব জনতাকে শশাষণমুক্ত করার কোনাে সুনির্দিষ্ট পথ বা পদ্ধতি নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ঐ ছয় দফাতে পূর্ববঙ্গের জন্য বড় জোর একটি ফেডারাে ইউনিটারি গােছের শাসন ব্যবস্থার দাবি ছিল।
তারপর সহসা রাতারাতি স্বৈরাচার বিরােধী সংগ্রাম জঘন্য প্রাদেশিক ও ভাষাভিত্তিক দাঙ্গার চেহারা নিল। দরিদ্র শ্রমজীবী উর্দুভাষী জনতা উন্মত্ত অন্ধজাতীয়তাবাদের বলি হলাে মিলিটারি অত্যাচার শুরু হবার আগে, এ তথ্য সবারই জানা।
আওয়ামী লীগ লড়াই করছে কার বিরুদ্ধেঃ ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সর্বস্তরের জনগণের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ কার পক্ষে লড়ছে? বাঙালির পক্ষে যার মধ্যে সেইসব বড় বড় ধনীরা রয়েছেন যারা আওয়ামী লীগের নির্বাচনী নৌকা অর্থে ভরেছিলেন। তাই বাঙালি শশাষকদের বিরুদ্ধে তার কোনাে বক্তব্য নেই। আওয়ামী লীগকে সাহায্য করছে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে কারা? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সােভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র হয় প্রত্যক্ষভাবে নয় ভারতের মাধ্যমে পরােক্ষভাবে। তাই আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনাে বক্তব্য নেই, বরং কিছু অভিমান ভরা অনুরাগ আছে। বিপ্লবী লড়াই করা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য ছিলও না এবং এখনাে নেই। আসল কথা, যেনতেন প্রকারে গদি দখল করে রাজা হওয়া। তাই স্বকণ্ঠে ও বন্ধুকণ্ঠে ওঠানাে হচ্ছে আপােসের সুর।
তাই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা সাবধান! মিষ্টি বুলির ভাঁওতার আড়ালে চিনতে ভুল করবেন না যাত্রাদলের সেনাপতিদের যুদ্ধের চেয়ে হাততালি, হাততালির চেয়ে রােজগার যাদের বেশি কাম্য। মনে রাখতে হবে যে, সব দেশের সরকার ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকার, পূর্ব জার্মানির সরকার বা কোনাে দেশের কোনাে সত্যিকার মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন বা স্বীকার করে না বরং ধ্বংস করার পক্ষে তারা আজ কোন জাদুমন্ত্র বলে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থক হয়ে গেল?
আওয়ামী লীগের অদূরদর্শী স্বার্থান্ধ নেতাদের ইতিহাসের শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত। নির্বাচনে বাক্সবােঝাই ভােট পেলেই গণভিত্তির প্রমাণ হয় না। তাই যদি হয়, তবে কামারুজ্জামান সাহেবের কথা মতােই বিশ্বাস করলে মাত্র তিনটি সিটের অধিকারী বজ্জাতদের ভােটদাতা জনসংখ্যার শতকরা একভাগ বেইমানদের ক্ষমতার সীমা নেই। সেই শতকরা একভাগ বেইমান সহসা কেমন করে এত প্রবল হলাে যে, ই পি আর, আনসার, মুজাহিদ বাহিনীসহ শতকরা নিরানব্বইকে বিশবাও জলের নিচে ঠেলে দিল? তাই বলা যায় বুর্জোয়া গণতন্ত্রের ব্যালটবক্স ওজন করে বিপ্লব বা জনমানসের মাপ কষেন যারা তারা হয় বজ্জাতি করছে, নয় মুখের স্বর্গরাজ্যে বাস করছে। আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে যদি দ্বিতীয়টা সত্য হয়, তবে বলি এখনাে সময় আছে।
পৃথিবীর কোনাে দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস একক লড়াইয়ের ইতিহাস নয়। সর্বত্রই দেখা যায় সংগ্রামী জনতার মুক্তি ফ্রন্ট সম্মিলিতভাবে লড়াই করে জিতেছে। আওয়ামী লীগ যদি ইতিহাসের এই শিক্ষা গ্রহণ না করে তবে জনগণই পরিণামে তাকে ছেড়া সুকতলার মতাে পরিত্যাগ করবে। কারণ পরিশেষে বিপ্লবী জনতার জয় অনিবার্য এবং সেই বিজয়ী বিপ্লবী জনতার গণআদালতে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামের মতাে বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতা সাহেবদেরও বিচার হবে। অতএব সাবধান।

সূত্র: দর্পণ
০৬.০৮.১৯৭১